আষাঢ়সন্ধ্যা। কলকাতা। কলামন্দির। সরোদ। শিল্পী আমান আলি খান। শুধু ভরিয়েই দিলেন না, নিঃস্বও করে দিলেন শ্রোতার মনকে দিনযাপনের বেদনাভার থেকে। এমন পরিসর তৈরি করার জন্য শুধু ধন্যবাদই প্রাপ্য নয় আয়োজক ‘পি কে ব্যানার্জি ফাউন্ডেশন’-এর, দাবিদার কৃতজ্ঞতারও। অল্প কথায় সূচনাপর্বকে বাঁধতে হয় কী ভাবে, শিক্ষণীয় এ-সন্ধ্যার উপস্থাপনা থেকে।
শিল্পী শুরু করলেন শ্রী দিয়ে। প্রাচীন রাগ। তার ইতিহাসও বহুমাত্রিক। নানা কালে নানা স্বরসঙ্গতিতে নানা ঠাট-পরিবারের সদস্য। কখনও কাফি ঠাটের। কখনও খাম্বাজগন্ধি। তীব্র মধ্যম আর কোমল ঋষভের আবেশে সেই রাগই এখন পুরবি গোত্রের। এ রাগের শরীর গম্ভীর। মন বিষাদনির্মিত। সন্ধিসময়ের পূর্বাঙ্গ চলন। এ-সন্ধ্যায় শ্রীমণ্ডিত হলেন আমান। সমাহিত ভঙ্গিতে আলাপ। কঠিন এই রাগ তার বাঁকা চলনে যে সম্ভ্রম, বেদনা এবং ভয়ে-ভক্তি জাগিয়ে তোলে, আমানে তারই উদ্ভাস। এবং বারে বারেই যেন উঁকি দিয়ে গেলেন রবীন্দ্রনাথ। সরাসরি একেবারেই নয়। তবে, কানের কাছে যেন শোনা গেল, ‘ওরে মাঝি, ওরে আমার মানবজন্মতরির মাঝি’। সম্ভব হল, আমানের পারিবারিক পরম্পরায়। মধ্য এবং তারসপ্তকে রাগ-কাঠামোর বিস্তারে তুমুল ধৈর্য। বিস্তার-আলাপের পাশাপাশি কয়েদ-আলাপনকেও পোষ মানাচ্ছেন ঐন্দ্রজালিক। নিছক প্রকরণ-ব্যবহার নয়, শিল্পী রসসমুদ্র ছেঁচে তুলে আনছেন বিষাদ। জোড় এবং ঝালা পর্বে তারই অনুরণন। স্বরের কাটাকুটি, ধ্বনির সম্মিলন এবং তা থেকে তৈরি হয়ে ওঠা আলপনা।
শ্রী থেকে আমান এলেন রাগেশ্রীতে। দশ মাত্রায়, ঝাঁপতালে। মধ্য লয়ে শুরুতেই অনায়াস রাগরূপ প্রতিষ্ঠা। ধরলেন তাঁর গুরু এবং বাবা আমজাদ আলি খানের কম্পোজিশন। খাম্বাজ ঠাটের প্রশান্তি ফুটে উঠল ওজস্বিতা আর মাধুর্যের বুননে। বাগেশ্রীর বাগান থেকে রাগেশ্রীকে বার করে আনতে তীব্র গান্ধারের ব্যবহারে অনেকেই অতিসচেতন নজর দিয়ে বিষয়টিকে প্রকট করে তোলেন। আমানে তার আপনি-প্রকাশ। তিন তাল দ্রুতে মঞ্চে অপেরা তৈরি হল। অপেরা, কারণ, একক শিল্পীর যে বাজনা পৌঁছচ্ছে শ্রোতার কানে, তাকে শতজল ঝরনার ধ্বনি মনে হচ্ছে। সঙ্গী দু’জন, তবলায় ওজস আধ্যা এবং আর্চিক বন্দ্যোপাধ্যায়, যাঁদের বিষয়ে অবশ্যই আসতে হবে পরে, তাঁরা মেধা-বাদনের অনুচ্চকিত শিল্প গড়ে তুললেন। পূর্ণগতির রেলগাড়ির চলনে যেমন একটানা ছন্দ-তাল জেগে ওঠে, তেমনই। সেই ধারাতালে একহারা তানের দ্রুতি আর সুস্পষ্ট ধ্বনিতে ঘোর তৈরি করলেন আমান।