Advertisement
২২ মে ২০২৪

অটোগ্রাফ দিয়ো

ঝুরঝুরে হলদেটে কাগজ। কালির ম্লান আঁচড়। তাতে জ্বলজ্বল করছেন নেহরু, সুভাষ, সত্যেন বসু থেকে পেলে-লতা-অমিতাভ। এই সেলফি-জমানায় সই-শিকারিদের পুরনো খাতায় চোখ রাখলেন ঋজু বসু ঝুরঝুরে হলদেটে কাগজ। কালির ম্লান আঁচড়। তাতে জ্বলজ্বল করছেন নেহরু, সুভাষ, সত্যেন বসু থেকে পেলে-লতা-অমিতাভ। এই সেলফি-জমানায় সই-শিকারিদের পুরনো খাতায় চোখ রাখলেন ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ৩১ ডিসেম্বর ২০১৬ ০০:১৮
Share: Save:

পেলের স্বাক্ষর পেতে এক সইশিকারি রপ্ত করে নেন পর্তুগিজ ভাষা!

তাঁর অটোগ্রাফ পেতে নাগাড়ে যে ঝুঁকি নিয়েছেন দুই ভক্ত, দেখে চমকে যান খোদ অমিতাভ বচ্চনই!

বইমেলার মাঠে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সই জনে জনে স্বহস্তে লিখে বিলিয়েছিলেন এক বিখ্যাত বন্ধু-সাহিত্যিক!

সই-সংগ্রহের এমন সব অদ্ভুতুড়ে গল্পে জড়িয়ে নেতাজি-নেহরু-সত্যেন বসু হয়ে সত্যজিৎ রায় কী উত্তমকুমার, এমনকী টিনটিন স্রষ্টা অ্যার্জের কাহিনি!

স্যুইটের দরজাটা ক্যাঁচ করে খুলে ভূত দেখার মতো চমকে উঠেছিলেন ‘অ্যাংরি ইয়ংম্যান’!

কড়া নিরাপত্তা। হোটেলের ফটকে পুলিশ। সব পার হয়ে ছেলে দু’টো এখানে এল কী করে?

সেটা ১৯৯০।

মাস কয়েক আগে ‘অগ্নিপথ’ রিলিজ করেছে। তখনও একবার কলকাতায় এসেছিলেন উনি। ওরা সে বারও চেষ্টা করেছিল। ডিরেক্টরের সঙ্গে ভাবসাব করে ফিল্ম ইউনিটের বাসে করেই হোটেল থেকে নন্দন-এ শো দেখতে হাজির হয় একজন। কিন্তু একটুর জন্য মিস্‌ হয়ে যায় সব। কিছুটা দূর থেকে একবারটি দেখা মিলেছিল। কাছে ঘেঁষা যায়নি।

এ যাত্রা, আগের দিন সান্ধ্য কাগজে খবরটা পেয়েই তাই মরিয়া হয়ে ওঠে মানিকজোড়। ‘দ্য টেলিগ্রাফ’ পত্রিকার ডিবেট উপলক্ষে কলকাতায় ফের আসছেন অমিতাভ বচ্চন।

‘এ বার, নয় নেভার’-মেজাজে দু’জনে ফের তৈরি। কেউকেটা অতিথিরা তখন সচরাচর ধর্মতলার পাঁচতারা হোটেলটিতেই ঘাঁটি গাড়তেন। ভোর সাড়ে পাঁচটার মধ্যে দু’জনে পৌঁছে যায় সেখানে।

কিন্তু ভেতরে ঢোকা যাবে কী ভাবে?

ওই চত্বরে তখন সার-সার গাড়ি পার্ক করে থাকত। এক কনটেসার ড্রাইভারকে পটাতে মূল্যবান ৫০ টাকা খরচ করে দুই বন্ধু। তাঁর কাজ শুধু দু’জনকে রাস্তার ও পার থেকে হোটেলের ভিতরে নিয়ে যাওয়া। তার পর গাড়ি থামিয়ে দরজা খুলে একটা ম-স্ত সেলাম ঠুকতে হবে।

এত করেও কিন্তু চিঁড়ে ভেজেনি সে-দিন! সবে গোঁফ-ওঠা দুই ছোকরার হোটেলে ঢোকার কারণ বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে হয়নি নিরাপত্তাকর্মীদের। কিন্তু ঠোক্কর খেলেও সে-দিন হার স্বীকার করতে রাজি হয়নি দু’জন।

হোটেলের পিছন দিকে কলকাতা পুরসভার উল্টো দিকে কর্মীদের ব্যবহারের দরজাটার খবর রাখত ওরা। হোটেলের এক কর্মচারীর নামটিও জানা ছিল। এটুকু পুঁজি করেই এ বার ‘প্ল্যান বি’ প্রয়োগ।

এবং কী আশ্চর্য, সাত-সকালে সেটাই খেটে গেল!

অতঃপর এক বুক উত্তেজনা চেপে দু’জোড়া পায়ের গটগটিয়ে হোটেল-কাম-দুর্গের অন্দরে প্রবেশ। রান্নাঘর, ডাঁই করা এঁটো বাসন, গ্যাসওভেন পেরিয়ে চোখ বুজে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ হাউজকিপিং কর্মী জনৈক মহিলার মুখোমুখি।

লাখ টাকার খবরটা তিনিই দিলেন!

ফোর্থ ফ্লোর। রুম নাম্বার ফোর জিরো ওয়ান! তাঁর স্যুইটের নম্বরটা মন্ত্রের মতো জপতে জপতে দু’জনে এ বার ঠিক জায়গায় হাজির। মিনিট ৪০ করিডরে ঘাপটি মেরে থাকার পরে ঈশ্বরের দেখা মিলল। এবং দু’জনকে দেখে শেষটা হেসেই ফেললেন অমিতাভ বচ্চন।

দু’জনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে অটোগ্রাফ বইয়ে সই করা তো বটেই। ক্যামেরা নিয়ে আসা দুই বন্ধুর সঙ্গে গাদাখানেক ছবিও তোলেন তিনি। শ্রীবচ্চন সে-দিন সাক্ষাৎ কল্পতরু। জনে-জনে ডেকে বলছেন, দুই বিচ্ছুর কাণ্ডকারখানা।

তিন দশক বাদে ওই হোটেলেই একটি ব্র্যান্ডের ইভেন্টে অমিতাভের সঙ্গে ফের দেখা হয়েছে শিলাদিত্য চৌধুরী ও শ্রীরাজ মিত্রের। এখন সফল ব্যবসায়ী, ভারিক্কি শিলাদিত্য হাসেন, ‘‘অমিতাভজিকে দেখলে মনে মনে আমরা সেই সাউথ সিটি কলেজের ক্লাস ইলেভেনে ফিরে যাই!’’

আসলে কেউ বড় হয় না

স্বপ্নের নায়ক বা গুণিজনকে নিয়ে এ সব আবেগ কেউ ছেলেমানুষি ভাবতে পারেন, তাতে কিচ্ছু এসে যায় না তাঁর। বলছিলেন, সদ্য ৪০ পার করা শঙ্কর ভেম্বুর।

পেলে যখন প্রথমবার কলকাতায় আসেন, চেন্নাইয়ের ছেলেটি তখন একরত্তি শিশু। সেই আফসোস দশকের পর দশক বয়ে বেড়িয়েছেন।

গত বছর আইএসএল-এর ম্যাচ দেখতে বিশ্ব ফুটবলের ‘কালো মানিক’ ফের কলকাতায় আসছেন শুনে তাই সুযোগটা ছাড়তে চাননি তিনি।

শঙ্করের চাকরির পোস্টিং তখন মধ্য ভারতে। কিন্তু সটান কলকাতায় চলে আসেন। তবে এলেই তো হল না! শঙ্করের কথায়, ‘‘দামি একটা অটোগ্রাফ বাগাতে সব সময়ে গোছানো প্ল্যানিং লাগে! ঠিক যেন নিখুঁত অপারেশন!’’

অত লোকের ভিড়ে, নিরাপত্তার কড়াকড়িতে কাজ হাসিল করা চাট্টিখানি কথা নয়। পেলের ডিফেন্স ভাঙতে শঙ্কর তাই অন্য স্ট্র্যাটেজি নিলেন।

কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে খেটেখুটে পেলের মাতৃভাষা পর্তুগিজে প্রায় ‘ক্র্যাশকোর্স’ করে নিয়েছিলেন শঙ্কর।

পরের ঘটনা, সত্যিই অবিশ্বাস্য!

পেলে তখন ব্যাটারি চালিত কার্টে বসে নেতাজি সুভাষ বিমানবন্দরের লাউঞ্জ পার হচ্ছেন। নিখুঁত নিশানায় কয়েকটা শব্দ তাঁর মনের গোলপোস্ট ভেদ করে জালে গিয়ে জড়াল।

পারাবেন্‌স রেই পেলে, পারাবেন্‌স রেই পেলে!

কে বলছে এ সব?
ফুটবলসম্রাট শুনে থমকে গেলেন। ঠিক ক’দিন বাদেই তাঁর জন্মদিন। এই বিদেশ-বিভুঁয়ে কে তাঁকে তাঁর মাতৃভাষায় অভিনন্দন জানাচ্ছেন! পেলে এ বার নিজেই তাঁর সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন।

পর্তুগিজে আলাপের দৌড় খুব বেশি এগোয়নি, ঠিকই। তবে অটোগ্রাফ জোগাড় বা ছবি তোলায় অসুবিধে হয়নি।

পেলের একটি কার্টুনের গায়েও সই নিয়েছিলেন শঙ্কর। এক বন্ধুকে দিয়ে মুহূর্তগুলো তিনি ভিডিয়ো-য় ধরে রেখেছেন।

সেই ছোটবেলা থেকে আজ অবধি অটোগ্রাফের নেশা তাঁর রক্তে মিশে। দলাই লামা, বরিস বেকার, মহম্মদ আলি, লতা মঙ্গেশকর বা প্রিয় লেখক রাস্কিন বন্ড— সবার সই রয়েছে সংগ্রহে।

লতা নাগপুরে যাচ্ছেন খবর পেয়ে সেখানকার সব হোটেলে অটোগ্রাফের কাগজ পাঠিয়ে দেন শঙ্কর।

তাতেই কিস্তি মাত।

তবে সেনাবাহিনীর কর্নেল শঙ্কর ভেম্বুরের কাছে সেরা সম্পদ, এই সইগুলোর কোনওটাই নয়। ‘‘কলকাতাতেই এক অনুষ্ঠানে এ দেশের তিন জন জীবন্ত ‘পরমবীর চক্র’-কে এক সঙ্গে পেয়ে গিয়েছিলাম।’’

শঙ্করের অটোগ্রাফ-খাতার একটি পাতায় সিয়াচেন অপারেশনের নায়ক সুবেদার মেজর (অনারারি ক্যাপ্টেন) বানা সিংহ এবং কার্গিল যুদ্ধের নায়ক রাইফেলম্যান সঞ্জয় কুমার ও সুবেদার যোগেন্দ্র সিংহ যাদব, তিন জনের সই-ই একযোগে বন্দি।

আবেগের কোনও অভিধান নেই

নিখুঁত ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’-এর ছকটা কষতে ভুল হয়নি মাধব চট্টোপাধ্যায়ের। তা-বলে পিঠে লাঠির বাড়ি এক ঘা এড়াতে পারেননি।

ফাটাকেষ্টর পুজোর গলি সীতারাম ঘোষ স্ট্রিটের বাসিন্দা অশীতিপর ঋজু চেহারা মিটিমিটি হাসেন, ‘‘জওহরলাল নেহরু বলে কথা! ওইটুকু তো হতেই পারে!’’

তখন দেশ স্বাধীন হব-হব করছে। সাবেক প্রেসিডেন্সি কলেজের মাঠে আসছেন জওহরলাল।

কড়া পাহারার ব্যূহের আড়ালে কার্যত অধরা দেশের হবু প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মাধববাবুকে ঠেকানো দায়।

তখন বছর দশেকের বালক, হেয়ার স্কুলের দিকের পাঁচিলের আশপাশে চুপিচুপি লুকিয়ে। মিটিং সেরে নেহরুজি তো ও দিকটাই ধরবেন।

মোক্ষম সময়ে তাঁর মুখোমুখি রিনরিনে গলার বালক।

ভিড়ের মধ্যে পুলিশের লাঠি বেমক্কা পিঠে পড়লেও নেহরুর আদর ব্যথায় মলম দিয়েছিল। হিন্দিতে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন তিনি।

রেক্সিনের কাপড়ে মোড়া সবুজ অটোগ্রাফ বুকটায় পরম মমতায় হাত বোলান বৃদ্ধ। বাইরে অস্পষ্ট অক্ষরে লেখা, ‘স্বহস্ত লিপিকা’।

হলদেটে ভঙ্গুর কাগজের পাতায় এক-একটা মহার্ঘ সই। তার উপরে বিছানো ট্রেসিংপেপারের কোণে, কোথায় অটোগ্রাফ নেওয়া হয়েছিল, সেটাও লেখা রয়েছে।

পাতা উল্টোতে উল্টোতেই রঙিন হয় সিপিয়া-আভার অতীত। সুভাষচন্দ্র বসুর সইটা ’৪১ সালে ডালমিয়া পার্কে নেওয়া। শুধু সেটিই মাধববাবুর দাদা দিলীপ চট্টোপাধ্যায় নিয়েছিলেন। বাকি সবই তাঁর নিজের সংগ্রহ।

তখন স্মার্টফোনে খচাখচ নিজস্বী তোলা তো দূর অস্ত্‌! ক্যামেরাও ছিল ডুমুরের ফুল। প্রিয় তারকার ছোঁয়া মিশে থাকা সই জুড়েই আশ্চর্য রোম্যান্স।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বড়লাট জ্যাকসনকে গুলি করতে গিয়ে ধরা পড়া বীণা দাসের সইটা দেখে এখনও গায়ে কাঁটা দেয় মাধববাবুর।

কৈলাসনাথ কাটজুর সই ছিনিয়ে নিতে আবার সেনেট হলের পাঁচিলে চড়েছিলেন। ঠিক সময়ে লাফিয়ে নেমে কাজ হাসিল করলেও সাধের শেফার্ডস লাইন পেনটা সে-দিন বিশ্বাসঘাতকতা করে। সইয়ের রেখা আবছা দেখে অনুযোগ করায় কাটজু নাকি বলেছিলেন, ‘‘পেন তুমহারা, মেরা কেয়া কসুর বাবু!’’

আর তার বেশ কয়েক বছর বাদে ’৬৫ সালে ইউনিভার্সিটি ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে সত্যেন বসুর ওই কলমটাই দারুণ পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। সোনালি নিবটা খুলে নেড়েচেড়ে, গোটা পেনটা ঘুরিয়ে-ঘুরিয়ে দেখছিলেন ক-ত-ক্ষ-ণ। মাধববাবুর ভয় করছিল, পেনটা না উনি নিয়েই নেন!

‘‘ভাবুন তো কী সব মানুষের স্পর্শ মাখা খাতাটায়।’’ অমূল্য খাতাটা নিজের ব্যক্তিগত সিন্দুকে আগলে রেখেছেন তিনি।

আপনাকে দেখে তো ঠিক সই-নেওয়া মেয়ে...

তবে সবটাই নিছক আবেগ নয়। জনৈক বাঙালি গায়ক নাকি অটোগ্রাফ পিছু ১০০ টাকা নিতেন কিছু দিন আগে। তাঁর কাছে, এটা নাকি প্রেমের মূল্যের দাবি! যদিও বিষয়টা সামান্য ক’টা টাকার নয়! অটোগ্রাফ-শিকার ক্রমশ বিশাল ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে।

অটোগ্রাফ-শিকারের কালচারটা জাঁকিয়ে বসেছিল গত শতকের ৮০-৯০-এর দশক অবধি। এ দেশে তার পরেও ‘চ্যারিটি’র জন্য ব্যাটে-বলে সচিন-সৌরভ-কুম্বলেদের অটোগ্রাফ চড়া দরে নিলামে উঠেছে।

গত শতকের শেষে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই-এর রিপোর্ট বলছে, বাজারের শতকরা ৭০ ভাগ অটোগ্রাফই নাকি জাল! আর বীরপুজোর হিড়িকে বেঠোফোন ও নিহত মার্কিন প্রেসিডেন্ট কেনেডির সুন্দরী বউ জ্যাকি কেনেডির ‘হাতে-লেখা চিঠি’— দু’টোই কয়েক লক্ষ ডলারে বিকিয়েছে।

তবে ভক্তেরা অটোগ্রাফের নেশায় উন্মাদ হওয়ার মতোই, তারকাদের কাছেও অটোগ্রাফের দাম নেহাত কম নয়।

সত্যজিতের ‘নায়ক’-এ ট্রেনের কামরায় হঠাৎ ফিল্মি নায়ককে দেখতে পেয়ে খুড়তুতো বোনের জন্য অটোগ্রাফ চাইতে গিয়েছিলেন ‘শর্মিলা ঠাকুর’।

সুন্দরী এক নারী তাঁর নিজের জন্য না-চেয়ে বোনের জন্য চাইছেন শুনে ‘নায়ক’ মানে উত্তমকুমারের চাউনিটা দেখার মতোই হয়েছিল।

হতাশ ভঙ্গিতে অস্ফুটে তিনি শুধু বলেন, ‘হুঁ, আপনাকে দেখে ঠিক সই-নেওয়া মেয়ে মনে হয় না!’

অটোগ্রাফ তাই স্রেফ ফ্যানের পরম কাঙ্ক্ষিত সম্পদ নয়। তারকার কাছেও তাঁর স্টার-পাওয়ারের প্রতীক।

তবে সকলে যে বিষয়টা এক দৃষ্টিকোণে দেখেছেন, ঠিক তা নয়। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এ বিষয়ে বড়ই উদার। এ যুগে অটোগ্রাফের চাহিদা অনেকটাই বদলে গিয়েছে নিজস্বী বা সেল্‌ফিতে। সৌরভের ঘনিষ্ঠজন জানেন, এয়ারপোর্টে ফ্লাইট ধরার আগের মুহূর্ত অবধি তিনি ফ্যানেদের বাঞ্ছা পূরণ করেন।

তারকার এই উদারতা সব সময়ে যে খুব সুখকর হয়, তাও বলা যাচ্ছে না। খোদ উত্তমকুমার তা হাড়ে হাড়ে জেনেছেন।

’৬৯-’৭০ সাল।

রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি স্টারে শ্যামলী-র শো দেখতে গিয়েছিলেন। বিপুল জনতাকে ঠেকিয়ে গুরুর গাড়ি বের করার সময়ে জনৈক ভক্তের ছুড়ে দেওয়া সোডার বোতল পুলিশের গায়ে না-লেগে লাগল একেবারে তাঁর থুতনিতে। গাড়িতে বসা উত্তমের সারা গা তখন রক্তে ভেসে যাচ্ছে।

উত্তমের বেয়াইমশাই ডাক্তারবাবু লালমোহন মুখোপাধ্যায় সেলাই করে সে-যাত্রা সামাল দিয়েছেন। পরের দিন ন’পাতার চিঠি লিখে ভবানীপুরের বাড়ির সামনে ঠায় দাঁড়িয়ে ক্ষমা চাইতে এসেছিল ভক্তপ্রবর।

উত্তম তাঁকে বলেন, ‘‘দেখো বাবা, আমাদের স্টারদের মুখটাই সব। এমন কিছু কোরো না, যাতে সেটার ক্ষতি হয়।’’

বলা বাহুল্য, সেই ছেলেটিকেও অটোগ্রাফে বঞ্চিত করেননি তিনি।

যদি কাগজে লেখো নাম

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে কাছ থেকে দেখেছেন, এমন কেউ কেউ বলেন, উনি নাকি যে-কোনও ছেঁড়া কাগজের টুকরোয় সই দিতে পছন্দ
করেন না।

মাধববাবুর কাছে শোনা গল্প, একবার দার্জিলিংয়ে তেনজিং নোরগের সই চাইলে তিনি বলেছিলেন, ‘আমার একটা ছবি নিয়ে এসো, শুধু তাতেই অটোগ্রাফ দেব!’ তেনজিংয়ের ছবি খুঁজে পাননি। তবে বরফ-মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘার একটা পিকচার পোস্টকার্ড আনলে খুশি হয়ে তাতেই সই করেন তেনজিং।

সত্যজিৎ রায়-পুত্র চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়ের কথায়, ‘‘বাবা সাধারণত অটোগ্রাফ চাইলে কাউকে ফেরাতেন না। এর একটা কারণ, উনি সব সময়ই যে-কোনও মানুষকে খুঁটিয়ে দেখতে ব্যস্ত থাকতেন। ওঁর সঙ্গে দেখা করতে আসা কত লোকের কত ম্যানারিজম এ ভাবেই চিত্রনাট্যে ঢুকে পড়েছে।’’

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও অক্লান্ত ভাবে সই বিলোতেন। তবে সে-যুগে লেখকের মুখটা অনেক পাঠকের চেনা ছিল না। বইমেলায় শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তাই সইশিকারি পাঠকের বইয়ে মজা করে ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’ নামে ভুরি ভুরি অটোগ্রাফ দিতেন।

কই সে আগের মানুষ কই

ভবানীপুরের গিরীশ মুখার্জি রোডের বাড়িতে সকালে মায়ের সঙ্গে কখন দেখা করতে যেতেন উত্তমকুমার, তা হিসেব কষে রোজ নির্দিষ্ট সময়ে ফিল্ডিং খাটতেন যোগমায়া দেবী কলেজের মেয়েরা।

ইডেনে ক্লাবহাউজ গেটে বা হোটেলে ইমরান, গাওস্কর, রিচার্ডস, মার্শালদের পাকড়াও করতে নিখুঁত স্ট্র্যাটেজি বুঝতেন পাগল ফ্যানেরা।

তবে শুধু তাঁরাই নন!

যুগ যুগ ধরে বাঙালির আবেগের অনেকটা জুড়ে রাজত্ব করেছেন, কবি-লেখকেরা।

ঠিকানা লেখা রিপ্লাই পোস্টকার্ড সুদ্ধ খোলা চিঠি একদা ভুরি ভুরি জমা হতো নামী লেখক, শিল্পীদের ঠিকানায়। কখনও নিছক সই ছাড়াও মিলত আরও বেশি। কোনও স্মরণীয় উদ্ধৃতি বা টুকরো ছড়া লিখে পাঠাতেন কেউ কেউ। অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্তের এমন একটি অটোগ্রাফে যেমন, শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী। ‘ঈশ্বরকে তোমার আমমোক্তারি (অ্যাটর্নি) দাও।’

৮৭ বছরের রেবা মৈত্র (এখন রায়)-এর স্কুলবেলা এমন অজস্র পোস্টকার্ডের সম্ভারে পরিপূর্ণ।

রাজশাহির নওগাঁতে রেবাকে চিঠির জবাব দিয়েছেন অনেকেই।

ভাগলপুর থেকে বনফুল লেখেন, ‘আশীর্বাদ করি হও বীরজায়া, বীরের জননী’।

রিপ্লাই পোস্টকার্ডটি কোনও কারণে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় অন্য একটি পোস্টকার্ডে লিখে জবাব দেন তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর, রাধাকৃষ্ণান, শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়দের চিঠিও তিনি পেয়েছেন।

গাছের ছবি এঁকে অটোগ্রাফ দিয়েছিলেন নন্দলাল বসু। আর রেবার জন্য নরেন্দ্র দেবের মজার ছড়া, ‘হাতের লেখা চাইছ রেবা, দু’দিন পরে পুছবে কেবা’।

মুখোমুখি মোলাকাতেও কোনও লেখক চটজলদি ছড়া কেটে খসখসিয়ে লিখে দিতেন।

মহাবোধি সোসাইটিতে এমনই একটি দুর্লভ প্রাপ্তিযোগ ঘটে কলেজ স্ট্রিটের সন্তোষ দাসের। ‘সন্তোষে থেকো, সন্তোষে রেখো সবারে, উন্নত হয়ো বিশ্ব জগতমাঝারে’— লিখে দিয়েছিলেন আশাপূর্ণা দেবী।

নীচে তাঁর সই।

যা হারিয়ে যায়

’৭০-৮০-র দশকে ব্রাসেলসে বসে কলকাতার অনেক স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ের চিঠি পেতে অভ্যস্ত ছিলেন টিনটিন-স্রষ্টা জর্জ রেমি
ওরফে অ্যার্জে। তাঁদের অনেককে উত্তরও দিয়েছেন তিনি।

ডাক্তারবাবু কাম লেখক ইন্দ্রনীল সান্যাল সেই ভাগ্যবানদের একজন। ক্লাস সিক্সে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে এক দুপুরের রংটাই পাল্টে যায় এমন পত্রাঘাতে।

ইন্দ্রনীলকে টাইপ করা চিঠির সঙ্গে অ্যার্জে পাঠিয়েছিলেন তাঁর ছবিসুদ্ধ কালো কালির অটোগ্রাফ।

সে চিঠিটা এখনও আগলে রাখলেও একটা অটোগ্রাফ হারিয়ে যাওয়ার জন্য ভিতরটা হাল্কা চিনচিন করে সেই কিশোরের।

’৭০-এর দশকের শেষ দিকেই আকাশবাণীর ‘গল্পদাদুর আসর’-এ গিয়ে জটায়ুকে দেখে উদ্বেল হয়েছিলেন ইন্দ্রনীল।

সন্তোষ দত্ত-র ট্রেডমার্ক কায়দায় প্রশ্ন, বলো তো আমি কে? শুনে ইন্দ্রনীল বলে ফেলেন, ‘‘জটায়ু! আসল নাম, লালমোহন গাঙ্গুলি!’’

কোত্থেকে জোগাড় করা ফিনফিনে ট্রেসিংপেপারে নেওয়া সন্তোষ দত্তের অটোগ্রাফখানা হারিয়ে ফেলেছেন ইন্দ্রনীল।

চেন্নাইয়ে রিচার্ড হ্যাডলির অটোগ্রাফখানা পাওয়ার দিনেই যেমন খাতাটা কী ভাবে বেহাত হয়েছিল কর্নেল ভেম্বুরের।

আর এখন মাঝবয়সি ব্যারি ও’ব্রায়েন বলেন, ‘‘আমাদের জামির লেনের বাড়ির একতলার ঘরে গচ্ছিত কৈশোরের একটা টুকরো ভাসিয়ে নিয়ে গিয়েছে ’৭৮-এর বন্যা।’’ ইডেনের বহু
ক্রিকেট-স্মৃতি মিশে ব্যারির সেই হারানো অটোগ্রাফ-বইয়ে।

আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে দীপ্তি চট্টোপাধ্যায়ের মেরুনরঙা খাতাটাও এখনও চোখে লেগে তাঁর কন্যা উর্মিমালার। মলাটে সোনার জলে লেখা ‘অটোগ্রাফ’!

অবন ঠাকুরের মেয়ে ‘সুরূপামাসি’ ব্রাহ্ম গার্লস শিক্ষালয়ে মায়ের স্কুলতুতো দিদি। ওঁর সঙ্গেই জোড়াসাঁকোয় কোনও এক অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন মা। দীপ্তি সবাইকে বলতেন, রবীন্দ্রনাথের ঠিক পিছনে ওঁর খুব কাছে মাটিতে বসেছিলেন ওঁরা। তাঁর পিঠ ছোঁয়া লম্বা চুল হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারা যেত।

অনুষ্ঠান শেষ হতে একটু বাদে উঠে গিয়ে নিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের অটোগ্রাফ। সুনির্মল বসু, উদয়শঙ্কর, রামকিঙ্কর বেজ— আরও কত জনের সই, ছবি ছিল সে খাতায়। আমৃত্যু সবাইকে তা দেখাতে ভালবাসতেন দীপ্তি।

সে-দিন বাড়ি গোছগাছের সময়ে মায়ের আলমারি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও খাতাটা পাওয়া গেল না। তার প্রতিটা পাতা যদিও মেয়ের মনে গেঁথে আছে।

তারকাদের দূরত্ব ক্রমশ যেন মুছে আসছে এখন। টুইটারে বা ফেসবুকে আমনাগরিকদের পক্ষেও সম্ভব সেলেব্রিটি-দের নাগাড়ে নজরদারি। পাতলা কাগজে অস্পষ্ট হয়ে যাওয়া অক্ষরে সইয়ের থেকে ঢের টেকসই নিজস্বী।

ইনস্টাগ্রামে, সোশ্যাল মিডিয়ায় তা ছড়িয়ে দিলে মুহূর্তেই গায়ে ঠিকরে পড়বে তারকার ‘রিফ্লেক্টেড গ্লোরি’। অথচ, সে-যুগের আবছা দুষ্পাঠ্য অক্ষরগুলোর মধ্যে কত কী যে মিশে থাকত!

সে-দিনের সামান্য একটা অটোগ্রাফের মূল্য বোঝবার ক্ষমতাই কি ফিকে হয়ে আসছে এই সব-পেয়েছির যুগে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

autograph
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE