Advertisement
E-Paper

অনবদ্য যুগলবন্দি

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দেবশঙ্কর হালদারের। নাটক ‘ফেরা’ দেখলেন কৌশিক সেন।সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দেবশঙ্কর হালদারের। নাটক ‘ফেরা’ দেখলেন কৌশিক সেন।

শেষ আপডেট: ০৫ মার্চ ২০১৬ ০০:০০
ফেরা। ছবি: প্রণব বসু।

ফেরা। ছবি: প্রণব বসু।

দ্রুতগামী ট্রেনগুলি না থেমে হাওয়ার বেগে চলে যায় একে একে— ‘স্টিল এক্সপ্রেস-ডাউন’, ‘বোম্বাই এক্সপ্রেস’...বনপাহা়ড়ীর মানুষজন অসহায় চোখে দেখে আর ভাবে একসময়ে এই বনপাহাড়ি-র কী রমরমাটাই না ছিল! তারপর...

‘‘তামার কারখানা সরকার নিয়ে বন্ধ হুয়ে গেল।’’

‘‘মণ্ডল কোম্পানির চিনেমাটির কারখানাও লালবাতি জ্বলল।’’

‘‘মুখুজ্জেবাবুদের রোলিং মিলও চলল না...।’’

‘‘এখন খরাত্রাণ ভরসা।’’

‘‘সরকারি মাটি কেটে অন্ন।’’

‘‘একে বাঁচা বলে?’’

‘‘ধুঁকছি-ধুঁকছি। পুরো গ্রাম ধুঁকছে।’’

‘‘বনপাহাড়ি শেষ।’’

মঞ্চে যখন অভিনেতারা এই সংলাপগুলি বলছেন, তখন অনুভবী দর্শকদের আর কোনও ভাবে জোর করে চিনিয়ে দিতে হয় না ‘সময়’কে। পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষের বহু পিছিয়ে পড়া অনুন্নত রাজ্য, বহু ধুঁকতে থাকা গ্রাম, মফস্‌সল ও শহরকে আমরা সহজেই চিনে নিতে পারি।

আরও অনুভব করতে পারি যখন বনপাহাড়ির মানুষজনের স্বপ্নে পোলাও কালিয়ার বাস ভুর ভুর করে ওঠে। দেবী এসে পৌঁছন— প্রতিমাদেবী— এক সময়ে তিনি ছিলেন এই গ্রামেরই মেয়ে— প্রতিমা মণ্ডল— ডাক নাম প্রীতি।

শরীরটা যার ছিল কচি শালের চারার মতো তেজী, ছিপছিপে, মাথায় একরাশ কালো চুল। সেই ‘প্রতিমা’ সাক্ষাৎ ‘দেবী’ হয়ে এসে পড়েন ধুঁকতে থাকা বনপাহা়ড়িতে। সঙ্গে কোটি কোটি টাকা ও উন্নয়নের অঢেল প্রতিশ্রুতি। পুঁজি আসে এবং ইতিহাসের নিয়ম মেনেই পুঁজি শর্ত দেয়...

প্রতিমাদেবী শর্ত দেন যে তিনি বনপাহাড়ির দুঃখ দুর্দশা দূর করবেন, পরিবর্তে গ্রামবাসীদের হত্যা করতে হবে কাশীনাথকে— যে কাশীনাথ এক সময়ে ছিল প্রতিমার প্রথম প্রেম। যে কাশীনাথের সঙ্গে কনকদূর্গার জঙ্গলে, সবুজ শ্যাওলার ওপর প্রতিমার প্রথম ভালবাসা হয়েছিল। যে কাশীনাথের বয়স ছিল বাইশ। যে কাশীনাথ ঠকিয়েছিল প্রতিমাকে। যে কাশীনাথ এই এঁদো গ্রামের এক অতি নগণ্য দোকানদার... সেই কাশীনাথকে গ্রামবাসীরা হত্যা করে ‘ন্যায়বিচার’ করলে, তবে মিটবে প্রতিমা সিংহের প্রতিশোধের আগুন, তবে মিটবে বনপাহাড়ির দুর্দশা।

নাটকের যতটুকু আপনাদের কাছে মেলে ধরলাম, তার বাকিটা জানার জন্য আপনাদের নিশ্চিতভাবে ‘শ্যামবাজার মুখোমুখি’র এই প্রযোজনাটি দেখতে হবে।

এ-নাটক দেখতে যাবেন নানা আকর্ষণ থেকে। এক, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও দেবশঙ্কর হালদারকে একসঙ্গে দেখা। দুই, এক ঝাঁক গুণী অভিনেতা-অভিনেত্রীর সম্মিলিত চমৎকার অভিনয় দেখা। এবং তিন, অবশ্যই পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের (প্রতিমা) গভীর ও বিশ্বাসযোগ্য চরিত্রায়ণ প্রত্যক্ষ করার টানে।

যে মানুষের দুনিয়ার যাবতীয় নোংরামো ও পচে যাওয়া দিকগুলি দেখা হয়ে গিয়েছে, যে মানুষ প্রচুর ঝড়ঝাপটা পার হয়ে কিনে ফেলেছে সেই ভ্রষ্ট দুনিয়াটাকে, ভালবাসা যার বাড়তে না পারা বাঁকা দোমড়ানো গাছের মতো বীভৎস— সেই ভয়ঙ্কর চরিত্রটিকে পৌলমী ফুটিয়ে তুলেছেন এক ইস্পাতকঠিন হিমশীতলতায়, যার অভিঘাত হয়েছে অব্যর্থ ও অনিবার্য।

পৌলমী চট্টোপাধ্যায়ের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, নির্দেশক হিসেবে ওঁর সামগ্রিক কাজ কিন্তু আমার তত ভাল লাগেনি। আলো-মঞ্চভাবনা, আবহ, নাটকের (Text) পরতে পরতে লুকিয়ে থাকা যে আদিম অন্ধকার, নষ্ট সময়ের গা গুলিয়ে ওঠা যে দুর্গন্ধ— তাকে ব্যক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছে। সামগ্রিকভাবে তার দায় নির্দেশককেই নিতে হবে।

ফলে কনকদুর্গার বনে গাছরূপী অভিনতা-অভিনেত্রীদের নৃত্যভঙ্গিমা বাড়তি বলে মনে হয়, বিচ্ছিন্ন হয়েই থাকে।

বরং বনপাহাড়ির ভিতর ঘনিয়ে ওঠা যাবতীয় আশা ও আশঙ্কার ঝড় ধারণ করেন কাশীনাথরূপী দেবশঙ্কর হালদার। এক সময় যাঁর সম্ভাবনা ছিল, কিন্তু এখন তিনি দারিদ্র ও সংসারের নিত্যচাপে নুয়ে পড়া এক সাধারণ দোকানদার।

এহেন মানুষটির জীবনে যখন ঝড় ওঠে, দুলে ওঠে পৃথিবীটা, প্রচণ্ড ভয় যখন গ্রাস করে তাঁকে, তখন সেই বিপন্ন মানুষের ভীরু চাহনি, অসহায় ক্রোধ, বেঁচে থাকার প্রবল ইচ্ছা— এই সব কিছুকে নিয়ে দেবশঙ্কর তাঁর কণ্ঠে, শরীরে ধারণ করেন এই বিপন্ন সময়কে।

বনপাহাড়ি সম্পর্কে বারংবার ব্যবহৃত হয়েছে ‘পচা’, ‘এঁদো, ‘গণ্ডগ্রাম’— শব্দগুলি, এই শব্দগুলিকে বাচনে, শরীরে মূর্ত করেন অঞ্চলপ্রধানের চরিত্রে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

নাসিরুদ্দিন শাহ বেশ কিছুকাল যাবৎ মঞ্চে অভিনয়-এর প্রসঙ্গে বিভিন্ন জায়গায় বলেছেন— ‘‘দ্য জব অব দ্য অ্যাক্টর ইজ্ টু বি আ মেসেনজার— ইউ নেভার বিকাম দ্য ক্যারেক্টার। ইউ ক্যান নট। ইউ শ্যুড নট।’’— কথাটা নিয়ে তর্ক চলতে পারে, কিন্তু কথাটা গভীর। একজন অভিনেতা কি সত্যিই একটি ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠেন? হওয়া সম্ভব?

সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় সারাজীবন এই দুরূহ কাজটাই করেছেন। ‘চরিত্র’ হয়ে ওঠার পাশাপাশি চরিত্রের সঙ্গে একটা অদ্ভুত দূরত্বও বজায় রেখেছেন, যার ফলে শুধু চরিত্রটির ব্যক্তিগত হাসি-কান্না-ব্যথা-আনন্দ নয়, আমরা চরিত্রটির আর্থ-সামাজিক চেহারাটাও বুঝতে পারি। বুঝতে পারি আমাদের চারপাশটাকে।

তার সঙ্গে আরেকটি কথাও বলি। বিদেশি নাটক অবলম্বনে বাংলা থিয়েটার করার দক্ষতায় দু’জন মানুষকে আমি সব সময় অন্যদের থেকে এগিয়ে রাখি।

তার একজন যদি হন, রুদ্রপ্রসাদ সেনগুপ্ত, তো অন্য জন অবশ্যই সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়।

ওঁরা যে ভাবে তাঁদের রূপান্তরে দেশজ ভাবটি নিয়ে আসেন, সেটি দেখতে বসলে মুগ্ধতা ছাড়া আর কোনও অনভূতি হয় না।

ওঁদের প্রাজ্ঞতা, ওঁদের বোঝাপড়া ভিনদেশি নাটককে ওঁদের মধ্যে এমন ভাবে আত্তীকরণ ঘটায়, বারবার নতজানু হতে হয়। এই ‘ফেরা’ও তাই।

‘বাংলা থিয়েটার’ নিয়ে নানান সমালোচনা, আক্ষেপ, অভিযোগ করার অবকাশ নিশ্চয়ই আছে, কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে কলকাতা ও মফস্‌সলে বেশ কিছু নাট্যদল, নির্দেশক, নেপথ্যশিল্পী ও অভিনেতা অভিনেত্রীরা নানান ভাবে বিশ্লেষণ করছেন ‘সময়কে’।

‘মুখোমুখি’র এই সাম্প্রতিক প্রযোজনা যা একটা সময় বনপাহাড়ির মতোই ভগ্নপ্রায় শ্যামবাজার-এর পেশাদারি রঙ্গালয়ে আশার আলো জ্বালিয়েছিল, সেই ফ্রিডরিখ ডুরেনমার্ট-এর ‘দ্য ভিজিট’ অবলম্বনে সৌমিত্রবাবুর চমৎকার রূপান্তর ‘ফেরা’ নাটকের পুনরাবিষ্কার—সাম্প্রতিক বাংলা নাটকের চালচিত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন।

Fera Soumitra Chattopadhyay Debshankar Halder play review
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy