Advertisement
০৬ অক্টোবর ২০২৪

কালীপ্রসন্নর কথা অমৃতসমান

মহাকাব্যিক তাঁর জীবন। তাঁর দয়াদাক্ষিণ্য, অনাচার দেখলেই খড়্গহস্ত হওয়া, তাঁর হুতোমের নকশা, তিরিশ বছরের জীবনে দেউলিয়া হয়ে অকালপ্রয়াণ। তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁর অনূদিত মহাভারতের ১৫০ বছরে লিখছেন বিনোদ ঘোষাল কেউ বিপাকে পড়লেই ছিলেন উদারহস্ত। আক্রান্ত মাইকেলের পাশেও তিনি, আবার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহেও তাই। দেউলিয়া খবরের কাগজকে বাঁচিয়েছেন, আবার অকাতরে দান করেছেন দুর্ভিক্ষেও।

শেষ আপডেট: ২০ অগস্ট ২০১৬ ০০:০১
Share: Save:

কেউ বিপাকে পড়লেই ছিলেন উদারহস্ত।

আক্রান্ত মাইকেলের পাশেও তিনি, আবার বিদ্যাসাগরের বিধবা বিবাহেও তাই। দেউলিয়া খবরের কাগজকে বাঁচিয়েছেন, আবার অকাতরে দান করেছেন দুর্ভিক্ষেও।

মহাভারতের অনুবাদ করে জনস্বার্থে গ্রন্থ বিলিয়েছিলেন বিনামূল্যে।

শেষ জীবনে তিনিই কিনা ঋণজর্জর। নিঃসঙ্গ। অভিযুক্ত হয়ে আদালত ছেড়েছিলেন মাথা নিচু করে।

তিনি কালীপ্রসন্ন সিংহ!

কপালে সুখ কই

সময়টা ঠিক একশো বাষট্টি বছর পিছনে। বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় একটি বিয়ের খবর।

যে সে বিয়ে নয়, জোড়াসাঁকোর এক রাজপরিবারের ছেলের বিয়ে।

পাত্রের বয়স মাত্র তেরো।

আর পাত্রী তখনও বড়দের কোলে পিঠেই ঘুরে বেড়ায়।

খবরটা ছিল এই রকম—

‘আগামী দিবসে মৃত বাবু নন্দলাল সিংহ মহাশয়ের পুত্র শ্রীমান বাবু কালীপ্রসন্ন সিংহের শুভ বিবাহ মিষ্টভাষী সদ্বিদ্বান শ্রীযুত রায় লোকনাথ বসু বাহাদূরের কন্যার সহিত নির্ব্বাহ হইবেক।...’’

এর পর যা কিছু লেখা, তা চলতি বাংলায় বললে এই রকম শোনায়— ‘‘এই শুভ কাজের জন্য কয়েক দিন ধরে সিংহবাবুদের বাড়িতে খুব নাচ-গান-জলসা হচ্ছে।

গত বুধবার রাত্রে দেশীয় বাবুদের এবং বৃহস্পতিবার সাহেব-বিবিদের নিয়ে এলাহি মজলিশ বসেছে।

সেখানে আমোদ-আহ্লাদ হয়েছে খুব। নন্দলালবাবুর হিসাবরক্ষক শ্রী হরপ্রসাদ ঘোষ চমৎকার ভাবে সমস্ত কাজ সামলাচ্ছেন। ব্রাহ্মণদের নেমন্তন্ন-চিঠি পাঠানো হয়েছে। সামাজিক বিদায়ের জন্য ঘড়া, থালা, বস্ত্র, শাঁখ, রুপোর বাসনকোসন সব বার করা হয়েছে। নন্দলালবাবু এই সময়ে যদি জীবিত থাকতেন, তা’হলে অকাতরে অর্থ্যব্যয় করতেন। পরমেশ্বরের কাছে আমরা প্রার্থনা করি তিনি কালীপ্রসন্নবাবুকে দীর্ঘায়ু দান করুন ও পরম সুখে রক্ষা করুন।’’

কিন্তু পরম সুখ, দীর্ঘায়ু কপালে থাকলে তো!

বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যেই মারা গেলেন স্ত্রী।

দ্বিতীয় বার প্রিয়জনকে হারানোর আঘাত পেলেন কালীপ্রসন্ন।

প্রথম আঘাত পেয়েছিলেন বাবাকে হারিয়ে। তখন মাত্র ছয় বছর বয়স।

গীতিকার সুরকার কালীপ্রসন্ন

পয়ার মুখস্থ হলেই সন্দেশ

বাবা নন্দলাল চলে যান বিশাল রাজসম্পত্তি রেখে।

কে ভার নেবে তার?

আদালতের হুকুমে সেই দায়িত্ব নিলেন পারিবারিক বন্ধু হরচন্দ্র ঘোষ। নির্লোভ, সৎ।

বিষয়আশয় দেখাশোনার পাশাপাশি কালীকে নিজের ছেলের মতো মানুষ করতে থাকলেন তিনি।

ইস্কুলে ভর্তিও করা হল। কিন্তু যা দস্যি ছেলে!

একদিন ক্লাস চলছে। সবাই খুব মন দিয়ে স্যারের পড়ানো শুনছে। হঠাৎই একটি ছেলে ক্লাসরুমে তুমুল কান্নাকাটি শুরু করে দিল।

‘‘কী হয়েছে? কাঁদছ কেন?’’ জিজ্ঞাসা করলেন স্যার।

‘‘আমাকে কালীপ্রসন্ন মাথায় জোরে চাঁটি মেরেছে।’’ বলেই আবার কান্না।

‘‘সে কী! কালী, তুমি ওর মাথায় মেরেছ?’’

‘‘আজ্ঞে হ্যাঁ।’’

‘‘আমার কোনও দোষ নেই স্যার।’’

‘‘দোষ নেই মানে? ওকে মারলে কেন?’’

‘‘স্যার আমি জাতে সিংহ। থাবা দিয়ে শিকার ধরা আমার জাতীয় স্বভাব। ছাড়ি কী করে বলুন?’’ গম্ভীর গলায় উত্তর দিলেন কালীপ্রসন্ন।

এমন ছেলেকে ইস্কুলের নিয়মে বাঁধে কার সাধ্যি? বাঁধা গেলও না শেষ পর্যন্ত।

ষোলো বছর বয়েসেই ইস্কুল ছুট। তা বলে পড়াশোনা ছাড়লেন না।

বাড়িতে মাস্টারমশাই রেখে তাঁকে সংস্কৃত আর ইংরিজি শেখানো শুরু হল।

ছোটবেলা থেকেই স্মৃতিধর। প্রখর বুদ্ধি। একবার যা পড়েন বা শোনেন, আর ভোলেন না।

রাতে ঘুমোতে যাওয়ার আগে ঠাকুমার কাছে শুনতেন কবিকঙ্কণ, কৃত্তিবাস বা কাশীরামের পয়ার। শোনামাত্রই মুখস্ত।

বাড়িতে মায়ের কাছে সেই মুখস্ত বললেই পুরস্কার ছিল পয়ার পিছু একটি করে সন্দেশ।

সেই সন্দেশের লোভে বাংলা পয়ার শিখতে শিখতেই বাংলা ভাষার প্রতি এমন মায়া জন্মে গেল যে এক সময়ে ঠিক করলেন, এই ভাষাকে আরও আধুনিক আরও সমকালের করতে হবে।

আর তাতেই কোপে পড়লেন সাহিত্যসম্রাট স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের।

সে গল্পে আসছি একটু পরে।

টিকি কাটা জমিদার

বিদ্যা বুদ্ধি তো প্রবল ভাবে ছিলই। তার সঙ্গে ছিল যে কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করা।

কাগজে-কলমে নয়, একেবারে সরাসরি। আর সেই প্রতিবাদও হত তাঁর চরিত্রের মতোই জোরালো।

একবার বাড়িতে ব্রত পুজো। পুজো শেষে ব্রাহ্মণদের গরু দান করা হল। এক ব্রাহ্মণ তাঁর দানের গরু নিয়ে আর ঘরে ফিরলেন না, রাস্তাতেই এক কশাইকে বিক্রি করে দিলেন।

খবর কানে গেল কালীপ্রসন্নের। ব্রতর গরু কিনা কশাইকে বেচেছে...এত বড় ভণ্ড! রেগে আগুন কালীপ্রসন্ন।

ডাক পড়ল সেই পণ্ডিতের। সকলের সামনে ব্রাহ্মণের টিকি কেটে শাস্তি দিলেন তাঁকে।

শোনা যায়, এর পর থেকেই নাকি তিনি এমন কোনও ভণ্ড ব্রাহ্মণের খোঁজ পেলেই তাকে তর্কে আহবান করতেন। সংস্কৃতে কোনও কঠিন বিষয় নিয়ে তর্ক।

শর্ত, পন্ডিত তর্কে হারলে তাঁর টিকি কেটে নেওয়া হবে। জিতলে মোটা অঙ্কের পুরস্কার। কিন্তু কালীপ্রসন্নের সঙ্গে তর্কে জেতা প্রায় অসম্ভব! ওই অল্প বয়সেই যেমন পাণ্ডিত্য, তেমনই বাগ্মিতা।

বেশির ভাগ পণ্ডিতকেই তর্কে হারাতেন এবং তার পর টিকিটি কেটে নিতেন। না, বিনামূল্যে নয়, রীতিমতো ভাল দক্ষিণা দিয়ে। তার পর সেই টিকি কত দাম দিয়ে কার কাছ থেকে কবে কেনা হল ছোট চিরকূটে লিখে আলমারিতে সাজিয়ে রাখতেন।

সেই থেকে কালীপ্রসন্নের নামই হয়ে গেছিল ‘টিকি কাটা জমিদার’। এই ডাকে দূরদূরান্তের মানুষও তাঁকে একবারে চিনে ফেলতেন।

রুখে দাঁড়ালেন মাইকেলের জন্য

ছি ছি পড়ে গেল বাংলার সাহিত্য-পণ্ডিত মহলে। মাইকেল মধুসূদন নামের এক আধা বাঙালি আধা ফিরিঙ্গি বাংলা ভাষার সর্বনাশ করে ছাড়ছে!

নইলে অন্ত্যমিল ছাড়া আবার কাব্য হয়! অমিত্রাক্ষর ছন্দ আবার কোন দেশি?

তাবড় পণ্ডিতরা একজোট হয়ে মধুদূদনকে আক্রমণ, পত্র-পত্রিকায় মাইকেলের বাপান্ত।

মাইকেল মধুসূদন

মাইকেল তখন সবে বিলেত থেকে ভাঙা মন নিয়ে ফিরেছেন। বাংলা কবিতাকে নতুন জন্ম দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তার মধ্যেই এ সব।

রামগতি ন্যায়রত্নের মতো পণ্ডিতও ‘সাহিত্য বিষয়ক প্রস্তাব’-এ মাইকেলকে একহাত নিলেন। কবির মন আবার ভাঙে আর কী!

সেই সময় পাশে এসে দাঁড়ালেন কালীপ্রসন্ন। ভূয়সী প্রশংসায় ভরিয়ে দিলেন। সর্বত্র বলতে লাগলেন, ভবিষ্যতের বাংলা কবিতা এই ছন্দেই লেখা হবে।

শুধু তাই নয়, প্রকাশ্য সভা করে সেই প্রথম কোনও বাঙালি কবিকে ঘটা করে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থাও করে ফেললেন।

মেঘনাদ বধের রচয়িতাকে ওই সভায় ‘মহাকবি’ আখ্যা দিলেন কালীপ্রসন্ন। ‘মেঘনাদ বধ কাব্য’র সমালোচনায় তাঁর ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’য় লিখলেন, ‘‘বাঙ্গালা সাহিত্যে এইপ্রকার কাব্য উদিত হইবে বোধ হয় স্বয়ং সরস্বতীও জানিতেন না। হায়! এখনও অনেকে মাইকেল মধুসূদন দত্ত মহাশয়কে চিনিতে পারেন নাই।’’

এমন দিলখোলা প্রশংসার প্রতিক্রিয়াও হল প্রবল। একটি প্রবন্ধে কালীপ্রসন্ন মাইকেলকে ভার্জিন মিলটনের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন বলে ওই সময়ের ‘ইন্ডিয়ান রিফর্মার’ কাগজে কালীপ্রসন্নকে যাচ্ছেতাই ভাষায় আক্রমণ করা হল।

সে লেখার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, কিছু পেটোয়া চামচে মিস্টার দত্তকে ভার্জিন, মিল্টনের সঙ্গে তুলনা করেছেন। এই অশিক্ষিত অপদার্থরা গ্রিক, লাতিন কিংবা ইংরেজি ভাষার কোনও সাহিত্যই না পড়ে নিজেদের বাংলা সাহিত্যের হনু ভাবতে শুরু করেছেন।

কালীপ্রসন্নও ছেড়ে কথা বলার লোক ন’ন। হিন্দু প্যাট্রিয়টে তিনি লিখলেন, ‘‘মাইকেল মধুসূদনের পক্ষ নিয়ে ঢাল তলোয়ার হাতে লড়াই করা আমাদের কাজ নয়। তবু বলতে বাধ্য হচ্ছি, যাঁরা লিখেছেন গ্রীক, লাতিন ইত্যাদি ভাষার সাহিত্য না পড়েই মাইকেলের কবিতার প্রশংসা করা হচ্ছে, হয় তাঁরা নিজেরাই সেইসব পড়েননি কিংবা ছোটবেলায় মায়ের কোলে বসে আমাদের দেশের অসামান্য সাহিত্যগুলি শোনেননি অথবা শুনলেও ভুলে গেছেন। তা না হলে বুঝতে পারতেন মাইকেল মধুসূদন দত্তর কাব্যপ্রতিভা কতখানি খাঁটি এবং দেশজ।’

চটলেন বঙ্কিমচন্দ্রও

প্রচণ্ড রেগে গেলেন বঙ্কিমচন্দ্র।

যে কালীপ্রসন্নর তিনি গুণমুগ্ধ, তারই কিনা এমন কীর্তি! ছি ছি! বঙ্কিমের লক্ষ্য, ‘হুতোম প্যাঁচার নকশা’।

বঙ্গদর্শন পত্রিকায় নকশার বিরুদ্ধে তিনি লিখলেন, ‘‘লিখনের উদ্দেশ্য শিক্ষাদান, চিত্তসঞ্চালন। এই মহৎ উদ্দেশ্য হুতোমি ভাষায় কখনো সিদ্ধ হইতে পারে না। হুতোমি ভাষা দরিদ্র; ইহার তত শব্দধন নাই; ইহার তেমন বাঁধন নাই, হুতোমি ভাষা নিস্তেজ, হুতোমি ভাষা অসুন্দর এবং যেখানে অশ্লীল নয়, সেখানে পবিত্রতা শূন্য। হুতোমি ভাষায় কখনো গ্রন্থ প্রণীত হওয়া উচিত নহে।’’

বঙ্কিমচন্দ্রের এমন আক্রমণের বিরুদ্ধে হুতোম কোনও পাল্টা আক্রমণ করেছিলেন কি না জানা যায় না। তবে বঙ্কিম নিজে বোধ হয় পরে সেই ক্রোধ মনে পুষে রাখনি।

নয়তো কালীপ্রসন্ন যখন মারা যান, অমন লিখতে যাবেন কেন!

‘কৃষ্ণচরিত’ বইয়ের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিম লিখেছিলেন, ‘‘সর্ব্বাপেক্ষা আমার ঋণ মৃত মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহের নিকট গুরুতর। যেখানে মহাভারত হইতে উদ্ধৃত করিবার প্রয়োজন হইয়াছে, আমি তাঁহার অনুবাদ উদ্ধৃত করিয়াছি।’

হুতোমের লেখায় ঢিঢি

সাহিত্যে চলিত ভাষার যে চল প্রথম শুরু করেছিলেন টেকচাঁদ ঠাকুর তাঁর ‘আলালের ঘরের দুলাল’ বইতে, সেই আলালী ভাষাকেই আরও কথ্য আরও সমকালীন করে তুললেন কালীপ্রসন্ন।

আসলে হুতোম বুঝেছিলেন, সমাজে যা অনাচার, বিকৃতি, ভূতের নাচন চলছে তার ওপর আঘাত হানতে হলে সংস্কৃত ঘেঁষা বাংলা নয়, প্রয়োজন কথ্য ভাষা।

তাই তিনটে ভাষার পণ্ডিত হুতোম ওই বাংলাকেই বাছলেন। ফলও ফলল হাতেনাতে।

প্রথম খণ্ড প্রকাশ হওয়া মাত্রই শহরের সব ফুলবাবুরা রে রে করে উঠলেন। হবে নাই বা কেন? কাউকে যে ছেড়ে কথা বলেননি তিনি। নিজেকেও না।

বাবুদের নাম বদলে দিলেও তারা যে কারা, এক লাইন পড়লেই সকলের কাছে পরিষ্কার। সুতরাং লেগে গেল ধুন্ধুমার কাণ্ড।

নকশার প্রথম ভূমিকায় হুতোম লিখলেন ‘‘সত্য বটে অনেকে নকশাখানিতে আপনারে আপনি দেখতে পেলেও পেতে পারেন, কিন্তু বাস্তবিক সেটি যে তিনি নন তা বলাই বাহুল্য, তবে কেবল এইমাত্র বলতে পারি যে আমি কারেও লক্ষ্য করি নাই অথচ সকলেরেই লক্ষ্য করিচি। এমনকী স্বয়ংও নকশার মধ্যে থাকিতে ভুলি নাই।’’

আর দ্বিতীয় ভূমিকায় একেবারে বুক ফুলিয়ে লিখেই ফেললেন, ‘‘তবে বলতে পারেন ক্যানই বা কলকেতার কতিপয় বাবু হুতোমের লক্ষ্যান্তবর্ত্তী হলেন, কি দোষে বাগাম্বর বাবুরে প্যালানাথকে পদ্মলোচনকে মজলিসে আনা হলো, ক্যানই বা ছুঁচো শীল, প্যাঁচা মল্লিকের নাম কল্লে, কোন দোষে অঞ্জনারঞ্জন বাহদুর ও বর্ধমানের হুজুর আলী আর পাঁচটা রাজা রাজড়া থাকতে আসোরে এলেন?’’

নকশা প্রকাশ করে কলকাতার বাবুদের হাঁড়ি একেবারে মাঠের মাঝখানে ভেঙে দিলেন হুতোম। সটান ভীমরুলের চাকে ঢিল। আর যায় কোথায়!

অনেক বাবু একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন হুতোমের ওপর। ‘আপনার মুখ আপুনি দেখ’ নামের বই লিখে হুতোমকে পাল্টা একহাত নিলেন ভোলানাথ মুখোপাধ্যায়।

টেকচাঁদ ঠাকুরের ছেলে চুনীলাল মিত্রও অনেকদিন ধরে ক্ষেপে ছিলেন কালীপ্রসন্নর ওপর। এইবার সুযোগ পেয়ে তিনিও লিখলেন ‘কলিকাতার নুকোচুরি’। সেখানে সরাসরি হামলা চালালেন কালীপ্রসন্নর ওপর।

বললেন, ‘‘হুতোম নিজে বজ্জাত হয়ে অন্যের খুঁত ধরছেন। হুতোম জীবনে যা করেছেন সবই খারাপ কাজ। ভালর মধ্যে শুধু ওই মহাভারত।’’

তবে মহাভারত অনুবাদ নিয়েও কি কম গঞ্জনা শুনতে হয়েছে তাঁকে! তাই নিয়ে আরেকটা মহাভারত লেখা হয়ে যায়।

আসছি সেই গল্পে।

প্রথম নাটক লেখা কৈশোরে

জীবনে প্রথম নাটক লিখলেন তখন বয়স মাত্র চোদ্দো। নাটকের নাম ‘বাবু’। বুঝতে পেরেছিলেন বাংলায় নাট্যমঞ্চ দরকার। তাই ষোলো বছর বয়সে নিজের বাড়িতেই তৈরি করলেন বিদ্যোৎসাহিনী থিয়েটার।

সেখানে রামনারায়ণ তর্করত্নের অনুবাদ করা ‘বেণীসংহার’ নাটক মঞ্চস্থ হল। নিজে অভিনয় করলেন। বিপুল প্রশংসা। কিন্তু কালীপ্রসন্ন বুঝলেন এই নাটকেও অনেক গলদ আছে।

আবার কলম ধরলেন। কালীদাসের ‘বিক্রমোর্ব্বোশী’ নাটক অনুবাদ করলেন। তখন বয়স মাত্র সতেরো। সে নাটকও মঞ্চস্থ হল। রাজা পুরূরবার চরিত্রে অভিনয় করলেন। শুধু কালীপ্রসন্নের অভিনয় দেখার জন্যই কলকাতার সব সাহেব, বাবুদের এত ভিড় হল যে দাঁড়ানোর জায়গাটুকু না পেয়ে অনেকেই মন খারাপ করে ফিরে গেলেন।

আর নাটক এমন সাফল্য পেল হল যে অনেকেই বিশ্বাস করল না এটি কোনও নাবালকের লেখা।

এমনকী ইংলিশম্যান পত্রিকা মন্তব্য করে বসল, বিক্রমোর্ব্বোশীয় আসলে পণ্ডিত দীননাথ শর্মার অনুবাদ। কালীপ্রসন্ন নিজের নামে চালাচ্ছেন।

এর পর ‘সাবিত্রী সত্যবান’, ‘মালতীলতা’ পরপর দুটি নাটক লিখলেন, কিন্তু দুর্ভাগ্য, সেই সব লেখা শুধু যত্নের অভাবে কিছুই রইল না।

সিধে করে ছাড়লেন দুর্মুখ ইংরেজকে

বন্ধুরা যখন ইংরেজি শিখে কোট প্যান্ট টাই পরে ঘুরছেন কালীপ্রসন্ন সেই বন্ধুদের থেকে অনেক বেশি ইংরেজিতে শিক্ষিত হয়েও বিদ্যাসাগরের মতো ধুতি, আলোয়ান পায়ে চটি।

একেবারে কট্টর জাতীয়তাবাদী।

স্বভাবে ভাল সাহেবদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মেশেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের অন্যায়কে ছেড়ে কথা বলেন না। ‘নীলদর্পণ’ কাণ্ডেই তার প্রমাণ মিলল।

সেও এক মস্ত কাহিনি।

দীনবন্ধু মিত্রর ‘নীলদর্পণ’ প্রথম সংস্করণ শেষ। দ্বিতীয় সংস্করণ আর ছাপা হবে কি না তাই নিয়ে সংশয়। ছাপানোর টাকা নেই।

খবর পেয়ে এগিয়ে এলেন কালীপ্রসন্ন। নিজের খরচে দ্বিতীয় সংস্করণ ছাপিয়ে বিলি করা শুরু করলেন।

শুধু তাই নয় ‘নীলদর্পণ’ ইংরেজিতে অনুবাদ করার জন্য যখন অভিযুক্ত হলেন লং সাহেব, সেখানেও এগিয়ে গেলেন কালীপ্রসন্ন।

চুড়ান্ত শুনানির দিন আদালতে গেলেন। পকেটে ভর্তি টাকা। আদালত রায় দিল, জরিমানা দিতে হবে রেভারেন্ড লংকে।

সঙ্গে সঙ্গে অর্থ দিয়ে লং সাহেবকে জামিনে মুক্ত করলেন কালীপ্রসন্ন। এমনকী ওই সময় স্বয়ং নাট্যকার দীনবন্ধুও গ্রেফতার হতে পারেন এমনও একটা খবর রটেছিল। তাই শুনে দীনবন্ধুকে আশ্বস্ত করে তিনি বলেছিলেন, ‘‘নিশ্চিন্ত থাকুন। অর্থের দ্বারা যদি আপনাকে বাঁচানো সম্ভব হয়, তা হলে আমি আমার সর্বস্ব দিয়েও চেষ্টা করব।’’

এখানেই শেষ নয়।

‘নীলদর্পণ’ মামলার বিচারক ওয়েলস সাহেবকেও উপযুক্ত শিক্ষা দিয়েছিলেন তিনি।

এই ওয়েলস বিচার চলাকালীন কথায় কথায় বিচারকের আসন থেকেই বলে উঠতেন, ‘‘বাঙালিরা সবাই মিথ্যাবাদী।’’

ওয়েলসের এমন কথায় প্রচণ্ড রেগে গিয়েছিলেন কালীপ্রসন্ন। শুধু অপেক্ষায় ছিলেন মামলার কবে নিষ্পত্তি হয়।

মামলা শেষ হওয়ার পরে পরেই সাহেবের হাতে বাঙালির অপমানের বদলা নিতে ঝাঁপিয়ে পড়লেন সকলকে একজোট করে।

১৮৬১ সালের ২৬ অগস্ট। কালীপসন্ন তখন সবে একুশ। রাজা স্যার রাধাকান্তদেববাবুর বাড়িতে এক বিশাল সভা ডাকলেন। ইংরেজের বিরুদ্ধে সভা বলে অনেক বাবুই সেই সভায় আসতে সাহস পেলেন না, কিন্তু জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো।

বিশিষ্টদের মধ্যে ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর, নবাব আসগর আলি খান, রাজা স্যার রাধাকান্ত দেব, রাজা প্রতাপচন্দ্র সিংহ-র মতো আরও অনেকে।

আর জীবনে সেই প্রথম কোনও রাজনৈতিক সভায় ভাষণ দিলেন কালীপ্রসন্ন। তাঁর কথায় মোহিত হয়ে গেলেন সকলে। ওয়েলসের বিরুদ্ধে ১০ লক্ষ মানুষের স্বাক্ষর নেওয়া প্রতিবাদপত্র পাঠানো হল সেক্রেটারি অফ স্টেট স্যার চার্লস উডের কাছে।

উড বাঙালি জাতির প্রতি ওয়েলসের এমন অপমানের যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চিঠির উত্তরে লিখলেন। যার কিছু অংশ বাংলা তর্জমা করলে এমন দাঁড়ায়—

‘‘যাঁরা আইনের উচ্চপদে রয়েছেন তাঁদের সব সময়ই অনেক বেশি অনুভূতিশীল এবং নিজের পদ ও দায়িত্বের প্রতি সচেতন হওয়া উচিত। পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যেই কিছু অপরাধী থাকে, তাই বলে পুরো জাতটাই অপরাধী হয়ে যায় না। এই ভাবনা সেই জাতির পক্ষে অবমাননাকর।’’

জয় হল কালীপ্রসন্নর। জবাব গেল বাঙালি-অপমানের। আর এর পরে সেই ওয়েলস এমন ভাল মানুষ হয়ে গেলেন যে তাঁর সুনামও ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

মেয়াদ শেষে যখন তিনি নিজের দেশে ফিরে যাচ্ছেন, তখন একেবারে তিনি অন্য মানুষ। তাঁর বিদায়কালে তাঁকে যে সম্মাননা জানানো হল, সেই চিঠিতে সই করতে দ্বিধা করেননি কালীপ্রসন্ন।

টাকা দেবেন কালীপ্রসন্ন

দাতাকর্ণ নামে লোকে চিনত তাঁকে। সমাজের কল্যাণে যেখানে যত অর্থ প্রয়োজন হয়েছে অকাতরে দান করেছেন কালীপ্রসন্ন। এর জন্য অবশ্য কম কথা শুনতে হয়নি।

কেউ বলেছেন পয়সা ছড়িয়ে নাম কিনতে চাইছেন, কেউ বলেছেন রাজবংশের বখাটে ছোকরা। কান দেননি সে সব কথায়।

বিদ্যাসাগর মশাইকে মানতেন নিজের গুরু হিসেবে। তাই যখনই গুরুদেবের প্রয়োজন হয়েছে তখনই ছুটে গিয়েছেন তিনি।

অনেক চেষ্টায় বিধবা বিবাহ আইন চালু করলেন বিদ্যাসাগর। কিন্তু বিধবা বিয়ে করার লোক কই?

কালীপ্রসন্ন ঘোষণা করলেন, যে ব্যক্তি বিধবা বিবাহ করবেন তাঁকে তিনি এক হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন।

কলকাতায় পানীয় জলের অভাব, নিজের টাকায় প্রথম কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় পরিশুদ্ধ জলের কল বসালেন।

হিন্দু প্যাট্রিয়ট কাগজের সম্পাদক মারা যাওয়ার পর টাকার অভাবে কাগজ উঠে যাওয়ার জোগাড়, এগিয়ে এলেন কালীপ্রসন্ন। কিনে নিলেন কাগজ।

আবার বেঁচে উঠল হিন্দু প্যাট্রিয়ট। শিল্প-সংস্কৃতি-সমাজের কল্যাণে যখনই অর্থের প্রয়োজন হয়েছে অকাতরে দান করেছেন তিনি।

একবার উত্তর পশ্চিমাঞ্চলে দুর্ভিক্ষ। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর সভা ডাকলেন। উপস্থিত সকলকে বললেন, যাঁর যেটুকু সাধ্য দান করতে। যে যেমন সাহায্য করলেন।

সে দিন প্রস্তুত হয়ে সভায় যাননি কালীপ্রসন্ন, কিন্তু তাই বলে কিছু না দিয়ে ফিরবেন?

গায়ে জড়ানো ছিল বহুমূল্য আলোয়ান। সেটিকেই খুলে দেবেন্দ্রনাথের হাতে ধরিয়ে দিলেন তিনি। অথচ এই নির্দ্বিধায় দানই যে একদিন কর্ণের মতো তাঁরও অকাল মৃত্যু ডেকে আনবে কে জানত!

বিনামূল্যে মহাভারত

ঠিক করলেন সংস্কৃত মহাভারতকে বাংলায় অনুবাদ করতে হবে। বয়স তখন মাত্র আঠেরো।

কিছু অংশ অনুবাদ করার পর বুঝতে পারলেন এই বিশাল কাজ তাঁর একার পক্ষে শেষ করা অসম্ভব। অতঃকিম?

গেলেন পণ্ডিত হরচন্দ্র ঘোষের কাছে পরামর্শ নিতে। হরচন্দ্র বললেন, ‘‘এত বড় কাজ কারও একার পক্ষে করা সম্ভব নয়। তুমি কয়েক জন সংস্কৃত পণ্ডিতের সাহায্য নাও।’’

এবার তা’হলে কার কাছে যাওয়া যায়। রওনা দিলেন গুরুদেব ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কাছে। সটান বললেন, ‘‘আমার পক্ষে আর অনুবাদ সম্ভব হচ্ছে না, আপনি দায়িত্ব নিন।’’

বিদ্যাসাগর বললেন, ‘‘আমার সময় কই? প্রচুর কাজ মাথার ওপর।’’

‘‘তা হলে কি বন্ধ হয়ে যাবে আমার এই চেষ্টা?’’

‘‘এত ভাল চেষ্টা কখনওই বন্ধ হতে পারে না। আমি ব্যবস্থা করছি।’’

সাত জন পণ্ডিতকে কালীপ্রসন্নের সঙ্গে দিলেন বিদ্যাসাগর। তার পর কালীপ্রসন্নের তত্ত্বাবধানে তাঁর বাড়িতেই শুরু হল অনুবাদের কাজ।

প্রতিবারের মতো এ বারেও শুরু হল নিন্দুকদের বিদ্রুপ। কালীপ্রসন্ন টাকা দিয়ে পণ্ডিত কিনে মহাভারত অনুবাদ করিয়ে নিজেকে অমর করার ধান্দায় নেমেছেন।

উত্তরে তিনি শুধু লিখলেন, ‘‘আমি যে দুঃসাধ্য ও চিরজীবনসেব্য কঠিন ব্রতে কৃত সঙ্কল্প হইয়াছি, তাহা যে নির্বিঘ্নে শেষ করিতে পারিব, আমার এ প্রকার ভরসা নাই। মহাভারত অনুবাদ করিয়া যে লোকের নিকট যশস্বী হইব, এমত প্রত্যাশা করিয়াও এ বিষয়ে হস্তার্পণ করি নাই। যদি জগদীশ্বর প্রসাদে পৃথিবী মধ্যে কুত্রাপি বাঙ্গালা ভাষা প্রচলিত থাকে, আর কোন কালে এই অনুবাদিত পুস্তক কোন ব্যক্তির হস্তে পতিত হওয়ায় সে ইহার মর্ম্মানুধাবন করত হিন্দুকুলের কীর্তিস্তম্ভস্বরূপ ভারতের মহিমা অবগত হইতে সক্ষম হয়, তাহা হইলেই আমার সমস্ত পরিশ্রম সফল হইবে।’

টানা আট বছর ধরে উদয়-অস্ত পরিশ্রমের পর ১৮৬৬ সালে শেষ হল অনুবাদের কাজ। বইও তৈরি। এবার পাঠকদের কাছে পৌঁছানো বাকি। কত দাম ঠিক করা হল প্রতি খণ্ডের?

না, মহাভারত বিক্রি করে ব্যবসা করার জন্য তো কালীপ্রসন্ন এই কাজ করেননি। তা হলে?

বইয়ের এক আশ্চর্য বিজ্ঞাপন প্রকাশের ইতিহাস পাওয়া যায় তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায়।

কী লেখা সেই বিজ্ঞাপনে?

লেখা ছিল—

‘‘শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন সিংহ মহোদয় কর্ত্তৃক গদ্যে অনুবাদিত বাঙ্গালা মহাভারত

মহাভারতের আদীপর্ব্ব তত্ত্ববোধিনী সভার যন্ত্রে মুদ্রিত হইতেছে। অতি ত্বরায় মুদ্রিত হইয়া সাধারনে বিনামূল্যে বিতরিত হইবে। পুস্তক প্রস্তুত হইলেই পত্রলেখক মহাশয়েরদিগের নিকট প্রেরিত হইবে।

ভিন্ন প্রদেশীয় মহাত্মারা পুস্তক প্রেরণ জন্য ডাক স্ট্যাম্প প্রেরণ করিবেন না।

কারণ, প্রতিজ্ঞানুসারে ভিন্ন প্রদেশে পুস্তক প্রেরণের মাসুল গ্রহণ করা যাইবে না। প্রত্যেক জেলায় পুস্তক বন্টন জন্য এক এক জন এজেন্ট নিযুক্ত করা যাইবে, তাহা হইলে সর্ব্বপ্রদেশীয় মহাত্মারা বিনাব্যয়ে আনুপূর্ব্বিক সমুদায় খণ্ড সংগ্রহকরণে সক্ষম হইবেন।

—শ্রীরাধানাথ বিদ্যারত্ন, বিদ্যোৎসাহিনী সভার সম্পাদক’’

ঋণ, ওয়ারেন্ট, চিরবিদায়

সেই সময়ে পুরো আড়াই লক্ষ টাকা খরচ হয়েছিল সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এই মহাভারত বিতরণে।

উদ্দেশ্য একটাই, দেশের সাধারণ মানুষ ভারতের এই মহান মহাকাব্যকে জানুক, নিজের দেশের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির সঙ্গে পরিচিত হোক।

আর এই কাজ করতে গিয়েই একেবারে পথে বসে গেলেন তিনি।

ঋণের দায়ে জর্জরিত। সাহায্যের জন্য কেউ নেই পাশে। যে আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবকে বিশ্বাস করে তাঁদের এক সময়ে নানাভাবে সাহায্য করেছিলেন, তাঁরাও সরে পড়লেন। তাঁর ওড়িশার জমিদারি, কলকাতার বেঙ্গল ক্লাব, আরও যা যা সম্পত্তি, সব একে একে বিক্রি হয়ে গেল।

১৮৬৬ সালে তাঁর নামে মোট ২০টি মামলা রুজু হল। আর আদালতে উপস্থিত না থাকার জন্য সব ক’টাতেই একতরফা ডিক্রি হয়ে গেল।

একের পর এক সম্পত্তি আটক আর বিক্রি করে পাওনাদারদের দেনা মেটাতে থাকলেন হাইকোর্টের শেরিফ। তাতেও কুলোল না, সম্পত্তির ওপর রিসিভার বসল। পুরোপুরি বিপর্যস্ত জোড়াসাঁকোর রাজা! পাওনাদারদের দাবিতে শেষ পর্যন্ত ওয়ারেন্ট জারি হয়ে গেলে কালীপ্রসন্নের নামে।

যে কালীপ্রসন্ন একদিন রেভারেন্ড জেমস লংকে জরিমানা দিয়ে হাজতবাস থেকে বাঁচিয়েছিলেন, তাঁকেই শেষ পর্যন্ত ওয়ারেন্ট এড়াতে লুকিয়ে একা থাকতে হল বরানগরের গঙ্গার ধারের বাগান বড়িতে। ওই বাড়িতেই দীর্ঘ আট বছর ধরে কাজ হয়েছিল মহাভারত অনুবাদের। বড় সাধ করে বাড়ির নাম রেখেছিলেন সারস্বতাশ্রম। তবু শেষরক্ষা হল না। শেষ পর্যন্ত আদালতে আসতেই হল তাঁকে। দাঁড়াতে হল আসামির কাঠগড়ায়। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ। বিচারপতি নেহাত দয়া করে তাঁকে কারাগারে না পাঠিয়ে মুক্তি দিলেন।

এই দয়াই যেন সহ্য হল না চিরকাল সিংহের মতো কেশর ফুলিয়ে মাথা উঁচু করে বাঁচা কালীপ্রসন্ন সিংহের। জীবনে প্রথম সে দিন মাথা হেঁট করে বেরিয়ে এসেছিলেন আদালত কক্ষ থেকে।

এর পর কে-ই বা খোঁজ নিয়েছে ভেতরে ভেতরে ক্ষয়ে শেষ যাচ্ছেন তিনি!

ঠিক চার মাস কাটল এ ভাবেই।

১৮৭০ সাল। ২৪ জুলাই। বেলা ৩টে।

গঙ্গার ধারের বাসভবনে নিঃস্ব একাকী কালীপ্রসন্ন যখন পৃথিবীতে তাঁর জীবনের শেষ নিঃশ্বাসটি নিচ্ছেন, তখন তাঁর বয়স সবে তিরিশ ছুঁয়েছে!

ঋণ: মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ (মন্মথনাথ ঘোষ), কালীপ্রসন্ন সিংহ অনূদিত মহাভারত, সটীক হুতোম প্যাঁচার নকশা

ভুল সংশোধন: ৬ অগস্ট ২০১৬ ‘পত্রিকা’য় ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু’ শিরোনামে প্রকাশিত নিবন্ধে ‘‘যে আত্মবিসর্জন করতে পারে, আত্মার উপর শ্রেষ্ঠ অধিকার শুধু তারই জন্মাতে পারে।’’ বাক্যটি ভুলবশত উদ্ধৃতি চিহ্নের ভিতর ছাপা হয়েছে। সহায়ক বইয়ের তালিকাও ভুলক্রমে বাদ পড়েছে। সেটি এ রকম— ‘জীবনস্মৃতি’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; ‘চিঠিপত্র’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড); ‘ছিন্নপত্রাবলী’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর; Letters to a Friend, Ed. C.F. Andrews; ‘কবিমানসী’ (প্রথম খণ্ড), জগদীশ ভট্টাচার্য; ‘রবীন্দ্রনাথ ও রবীন্দ্রনাথ’, পূর্ণানন্দ চট্টোপাধ্যায়; ‘একত্রে রবীন্দ্রনাথ’ (প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড); ‘রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টিতে মৃত্যু’, ধীরেন্দ্র দেবনাথ; ‘গল্পের নাম রবীন্দ্রনাথ’, নীলাঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়; ‘রবিঠাকুরের ডাক্তারি’, ডা. শ্যামল চক্রবর্তী; ‘জীবনদেবতা: রবীন্দ্র-রচনা সংকলন’, রজতকান্ত রায় সম্পাদিত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE