Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
নান্দীকার নাট্যমেলা

নাটকীয় অভিঘাতে মজিয়ে রাখে দর্শকদের

নান্দীকার নাট্য মেলায় এবার ওড়িশার অবদান ততটা জোরালো ছিল না, যেমন দেখা যেত অন্যান্য বছরের চেতনার প্রযোজনায়। শতাব্দী কলাকার-এর বাবাজি (রচনা: জগমোহন লালা, পরি: ধীরা মল্লিক) এক নিরলস নির্ভীক সন্তের কাহিনি, যিনি গ্রামে গ্রামে বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অসৎ মানুষকে সৎ করার চেষ্টা করেন।

ছিল বিদেশি নাটকের দেশি প্রযোজনাও

ছিল বিদেশি নাটকের দেশি প্রযোজনাও

শেষ আপডেট: ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ ০০:০০
Share: Save:

নান্দীকার নাট্য মেলায় এবার ওড়িশার অবদান ততটা জোরালো ছিল না, যেমন দেখা যেত অন্যান্য বছরের চেতনার প্রযোজনায়। শতাব্দী কলাকার-এর বাবাজি (রচনা: জগমোহন লালা, পরি: ধীরা মল্লিক) এক নিরলস নির্ভীক সন্তের কাহিনি, যিনি গ্রামে গ্রামে বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে অসৎ মানুষকে সৎ করার চেষ্টা করেন। অপমান ও অবহেলা বা ভণ্ডামির প্রতিপত্তি তাঁর উদ্দেশ্য সিদ্ধির পথ জুড়ে থাকে। কিন্তু সন্ত বাবাজি সব বাধা অতিক্রম করেন, শত্রু হার মানে। এই অনায়াস সিদ্ধিলাভের রূপকথায় কোনও নাটকীয় ঘাত-প্রতিঘাত বা দ্বন্দ্ব নেই। কেবল মঞ্চপ্রয়োগের কুশলতা ও অভিনয়ের গুণে নাটক দাঁড়িয়ে যায়।

মেলার অন্যতম আকর্ষণ ছিল দিল্লির হিন্দি নাটক। তার মধ্যে এনএসডি রেপার্টরির ‘লাগি লগন’ (মূল নাটক: বার্নাড শ-এর পিগম্যালিওন, অনু: রূপান্তর ও পরি: বামন কেন্দ্রে) ছিল নাচেগানে, অভিনয়ে চৌকস। নতুন প্রযোজনা ‘মাই ফেয়ার লেডি’র মতো কতকটা বিনোদিনী মিউজিক্যাল হলেও এই প্রযোজনা মিলনান্ত রোম্যান্স নয়। বরং ফুলওয়ালিকে রাণি বানালেও তার প্রেমাষ্পদ শিক্ষকের কাছে সে ফুলওয়ালিই থাকে। প্রযোজনার করুণ পরিণতিতে ছিল মাত্রাতিরিক্ত ভাবাবেগ। ফুলওয়ালির ভূমিকায় অভিব্যক্তির নানা মাত্রা আর সুক্ষতায় ঋদ্ধ অভিনয় এই প্রযোজনার প্রধানতম সম্পদ। দ্বিতীয় প্রযোজনা আধা চাঁদ-এর (নাটক ও পরি: তত্রিপুরারি শর্মা) অভিনবত্ব সব বিষয়ে। আধুনিক তরুণ-তরুণীদের কাছে কল সেন্টারের চাকরি যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো। কল সেন্টার যেখানে আছে মোটা মাইনে, গ্ল্যামার, যুবা-যুবতীর নিঃসঙ্কোচ মেলামেশা আর ব্যবসার লক্ষ্যমাত্রা পূরণের প্রবল চাপ। নিজেদের নাম পরিচিতি ও স্বাভাবিক সত্তা হারিয়ে ফেলে তারা। এমন পরিবেশে চাকরি করে দরিদ্র পরিবারের এক তরুণ, বিদেশে যাবার স্বপ্ন দেখে। বিদেশের কর্তৃপক্ষ দেউলে হয়ে যাওয়ায় স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায়। তত দিনে তার বাবা কঠোর পরিশ্রম করে স্বচ্ছল হয়ে ওঠে। চটকদার স্বপ্নকল্প বাস্তবতার পাশে সংগ্রামী বাস্তবের নাটকীয় দ্বন্দ্বকে দৃশ্যময় করেছে। কল সেন্টারের এই যান্ত্রিক নিঃষ্পেষণ আরও প্রকট হয় তরুণ-তরণীদের ট্যাপ সঙ্গীতের তালে উদ্দাম নাচের দৃশ্যগুলিতে। অগোছালো স্ক্রিপ্ট আর আকস্মিক স্বপ্নভঙ্গ আধুনিক প্রজন্মের জীবনছন্দের সঙ্গে সহজেই মিলেছে।

নান্দীকার নাট্যমেলায় এসেছিল বিদেশি নাটকের দেশি প্রযোজনা। দিল্লির ফ্লাইং ফেদার আর্টস অ্যাসোসিয়েশন এনেছিল হিন্দিতে ‘লুক ব্যাক ইন অ্যাংগার’ (রচনা: জন অসবোর্ন, হিন্দি: ভুপেন পান্ড্য/টিকম যোশী, পরি: সৌতিক চক্রবর্তী)। পঞ্চাশের দশকের শ্রেণিসচেতন বৃটিশ সমাজের কাহিনি। শ্রমিক শ্রেণির শিক্ষিত দরিদ্র যুবার স্ত্রী উচ্চবিত্ত শ্রেণীর মেয়ে। স্ত্রীর উদ্দেশে স্বামী নিরন্তর উগরে দেয় তার শ্রেণিবিদ্বেষী ক্ষোভ। স্ত্রীর বান্ধবী আসে দু-এক দিনের জন্যে থাকতে। বদরাগী স্বামীর হাতে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীর হেনস্তা দেখে তাকে বাপের বাড়ি পাঠিয়ে দেয়, নিজে থেকে যায় নায়কের সঙ্গে দেহ-সম্পর্কে লিপ্ত হয়ে। স্ত্রী ফিরে আসে প্রসূত শিশুর মৃত্যুর পর। বান্ধবী বিদায় নেয়, স্বামী-স্ত্রীর পুনর্মিলন হয়। ত্রিভুজ প্রেমের এই ক্লিশে গল্প— যা হিন্দি প্রযোজনায় অটুট। মূল নাটকের শক্তি রাগী নায়কের দুর্বার অপ্রিয় সংলাপে, রূঢ় বাস্তবতার প্রখর ব্যঞ্জনায়, আগে ব্রিটিশ নাটকে যা ছিল না। স্মরণীয় নায়কের বন্ধুর ভূমিকায় অনুচ্চ অভিনয়।

নটধা-র বাংলা প্রযোজনা অথৈ (রচনা ও পরি: অর্ণ মুখোপাধ্যায়) শেক্সপিয়রের ‘ওথেলো’-র সার্থক সম্পূর্ণ দেশি রূপান্তর। যেমন তদানীন্তন কয়েকটি ‘শেক্সপিরীয়’ হিন্দি চলচ্চিত্র। মূলের কাব্য নেই কিন্তু দুরন্ত নাটকীয়তা আছে, আর আছে সাম্প্রতিক লোধা একজন দলিত যুবক। কিন্তু নাটকের মুখ্য ভূমিকায় ইয়াগোপ্রতিম খলনায়কের আত্মকথনে নাটকের শুরু ও শেষ। সমকালীন প্রজন্মের হালচাল নিয়ে রচিত নাটক ছিল ইউনিকর্ন অ্যাক্টর্স স্টুডিওর ‘মে বি দিস সামার’ (রচনা ও পরি: ত্রিপুরারি শর্মা)। প্রযোজনার বিষয় সহবাসে দুই যুবক-যুবতীর দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক। দুই নর-নারীর সহবাস এখনও সামাজিক স্বীকৃতি পায়নি। সাহসী যুবা এই সম্পর্কের পরিণতি নিয়ে চিন্তিত নয় কিন্তু প্রচলিত মূল্যবোধ ও সংস্কার এড়াতে পারেনা তার যুবতী সঙ্গিনী। লোকলজ্জা আর পারিবারিক আপত্তির আশঙ্কায় সে চায় সম্পর্ক সুনিশ্চিত করতে। মতানৈক্য চরমে উঠলে দুজনে আলাদা থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। নাটকে কাহিনি নেই, পরিণতিও নেই। সাফল্যের কৃতিত্ব দুই কুশীলবেরই, আর মঞ্চের প্রতীকী বিন্যাসের। সহবাসে থেকেও দুজনে দুই প্রান্ত-‘নিবাসী’।

নাট্যমেলায় বাংলা প্রযোজনাগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য কলকাতার রঙ্গালোকের ‘শেকল ছেঁড়া হাতের খোঁজে’ (মূল রচনা: সমরেশ বসু, নাটক: তীর্থঙ্কর চন্দ, পরি: শ্যামল চক্রবর্তী)। শ্রমিক আন্দোলনের শরিক এবং পরে সাংসদ—এমন এক সৎ আদর্শবাদী লোহা-কাটা শ্রমিকের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা ক্রমান্বয়ে আদর্শচ্যুত পার্টির করুণ পরিণতির কাহিনি। প্রথমে শুরু শ্রমিক আন্দোলনে, কিন্তু ক্রমশ নেতৃত্ব চলে গেল নিচুতলার শ্রমিকদের সঙ্গে সংযোগহীন শিক্ষিত মধ্যবিত্তের হাতে। পরে রাজনীতির প্রকোপে শ্রমিক নেতাকে বিক্ষুব্ধ ও প্রতিবাদী করে তোলে। কিন্তু পার্টিনেতারা তাকে বিতাড়িত করে।

মঞ্চে সবচেয়ে সফল মুখ শ্রমিক নেতার অসামান্য কুশলী অভিনয়। প্রযোজনার রাজনৈতিক নাটককে রাজনীতি-নিরপেক্ষ এক নাটকীয় অভিঘাতে আগাগোড়া দর্শককে মজিয়ে রাখতে পেরেছেন। এবং প্রযোজনার সাফল্যে পুরনো বিপ্লবী গানগুলির ভূমিকাও চমৎকার।

মনসিজ মজুমদার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sohini Sengupta
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE