Advertisement
E-Paper

দেবলোক ডেভালায়

নীলগিরি পাহাড়ের কোলে চা ও কফি বাগান। অদূরে মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান। সবুজে সবুজ জায়গার অলঙ্কার, মানুষের সদা হাস্যময় ব্যবহার। নিসর্গ শোভায় যেন স্বর্গের কাছাকাছি। বেড়িয়ে এসে লিখলেন সুরবেক বিশ্বাস নীলগিরি পাহাড়ের কোলে চা ও কফি বাগান। অদূরে মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান। সবুজে সবুজ জায়গার অলঙ্কার, মানুষের সদা হাস্যময় ব্যবহার। নিসর্গ শোভায় যেন স্বর্গের কাছাকাছি। বেড়িয়ে এসে লিখলেন সুরবেক বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০১ জুলাই ২০১৭ ০০:০০

এর পর গাড়ি আর যাবে না। আমাদের আস্তানার দোরগোড়ায় পৌঁছতে বাকি অল্প পথটুকু হেঁটে যেতে হবে। কিন্তু চা বাগানের মধ্যে একটা ছোট ঢালু রাস্তা বেয়ে ওঠা আছে। ২৫ ডিসেম্বর সন্ধে সাতটা মানে তো এক রকম রাত। আলো প্রায় নেই বলে পরিষ্কার তেমন কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। ঠিকঠাক যাতে পৌঁছতে পারি, সেই জন্য তিন-চার জন টর্চ হাতে চলে এলেন। আবহটা যেন নিশুতি রাতের কোনও নিঝুমপুর স্টেশন। স্ত্রী-পুত্র, বন্ধু এবং তাঁর স্ত্রী-কন্যা স্বগতোক্তির ঢঙে বললেন, ‘এ আমরা কোথায় এলাম এতটা পথ উজিয়ে?’ তবে মিনিট তিনেকও কাটতে পারল না। বারান্দায় পৌঁছতেই ঝপাৎ করে সবার চোখের সামনে খুলে গেল এক স্বপ্নজগৎ।

সিলভার ওক, রোজ অ্যাপেল, জাকারান্ডা, জামুলের মতো গাছ স্বাগত জানাল ঝিরঝিরে বাতাস বইয়ে। উপরে তাকাতেই বোঝা গেল, হাত বাড়ালেই ধরা যাবে এখানকার আকাশকে। এত তারার উজ্জ্বল ঝিকিমিকি! নীলগিরি পাহাড়ের কোলে থাকা এই জায়গার পুব দিকে মুদুমালাই জাতীয় উদ্যান। আকাশ এখানে দূষণের কলঙ্কমুক্ত। যে আকাশ জানিয়ে দেয় স্বর্গের ঠিকানা। ডেভালা।

কোয়েম্বত্তূর থেকে আমরা রওনা দিয়েছিলাম রীতিমত গড়িমসি করে, সকাল সাড়ে ১০টারও পরে। আমাদের গাড়িচালক শিবা, কোয়েম্বত্তূরে হোটেলের ফ্রন্ট ডেস্কের এগজিকিউটিভ... এ রকম অনেকেই দেখলাম, ডেভালা চেনেন না। নামই শোনেননি। তাঁদের পরিচিতির সীমা গুডালুর, যা ডেভালার ১৬ কিলোমিটার আগে একটি গমগমে টাউন।

অথচ তামিলনাড়ুর নীলগিরি জেলার এই ছোট গঞ্জ ডেভালাকে বলা হয় দক্ষিণের চেরাপুঞ্জি। এত বেশি বৃষ্টি হয় ডেভালায়। আসলে তামিলনাড়ুর বড় শহর কোয়েম্বত্তূর থেকে উটি হয়ে নীলগিরি জেলার প্রায় শেষ সীমায় থাকা ডেভালার দূরত্ব ১৫০ কিলোমিটার। সেখানে কর্নাটকের মহীশূর থেকে ডেভালা ১২০ ও কেরলের কোঝিকোড় থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে। কোয়েম্বত্তূরের কাছে ডেভালা তাই একটু দূরের।

ডেভালা না চিনলেও গুডালুর শুনে মোটামুটি একট আন্দাজ করে কোয়েম্বত্তূরের হোটেল-ম্যানেজার বলেছিলেন, ‘আপনাদের পৌঁছতে কিন্তু অনেকটা সময় লাগবে। সন্ধে গড়িয়ে যাবে।’ বাস্তবে হলও তাই। কেয়েম্বত্তূর থেকে রওনা হওয়ার ঘণ্টা আড়াই পর চায়ের জন্য বিখ্যাত কুন্নুরে পৌঁছে একটি রেস্তরাঁয় দুপুরের খাওয়া, চিনা-উত্তর ভারতীয়-পঞ্জাবি সব রকম মিশিয়ে। শরীরে জ্বালানি ভরে ফের যাত্রা শুরু, এ বার অবিরত। বেরোতে অনেকটা দেরি হয়েছে বলে বহুশ্রুত উটি-তে না ঢুকে, তার পাশ কাটিয়ে ৭৫ কিলোমিটার টানা চলে পৌঁছনো গেল ডেভালায়।

পরদিন ঝকঝকে সকালে বোঝা গেল, ডেভালা আসলে কী! ‘ডেভা’ মানে দেবতা। ‘লা’-এর অর্থ উৎসর্গীকৃত। অর্থাৎ তামিল শব্দ ডেভালার বাংলা তর্জমা করলে দাঁড়ায়, ঈশ্বরের জন্য উৎসর্গীকৃত। সত্যিই তাই। পর্যটকদের হইচই আর বাজারঘাট করার জায়গা নয় ডেভালা। বসে, হেঁটে, বেড়িয়ে, গাড়িতে চড়ে প্রকৃতির রূপ-রং-রস তারিয়ে তারিয়ে পরতে পরতে উপভোগের জায়গা। কংক্রিটের জঙ্গলে সর্বক্ষণ থাকা মানুষদের মনে হতে পারে, এ নিশ্চয়ই বাস্তবের কোনও জায়গা নয়। চার দিক সবুজে সবুজ। গোটা দশেক চা বাগান, খান তিনেক কফি খেত, গাছ, পাহাড় আর জঙ্গল। এতটুকু দূষণ নেই, মলিনতা নেই। শেষ ডিসেম্বরের শীত অবশ্যই আছে, তবে তা আরামদায়ক, উপভোগ্য। ঠান্ডার কামড় নেই। প্রকৃতি যেন নিজের সব ভালটুকু উজাড় করে দিয়েছে এখানে।

ইউরোপ ঘুরে আসা এক বয়োজ্যেষ্ঠর মুখে শুনেছিলাম, লিসবন ও বার্সেলোনার মতো ঝকঝকে আকাশ নাকি দুর্লভ। নিজে দেখিনি। বলতে পারব না। তবে আকাশের রং কতটা রাজকীয় ভাবে আকর্ষক হতে পারে, সেটা দেখলাম ডেভালায়। মনে হচ্ছিল, এই আকাশে কোনও দিন মেঘ ঢোকারই সাহস পাবে না।

অথচ প্রকৃতির এই বরদান পেয়েছেন বলে ডেভালার মানুষ পর্যটকদের সম্পর্কে উদাসীন নন, অহঙ্কারী তো আদৌ নন। সবার মুখে যেন হাসি লেগেই আছে, অন্যের সাহায্যে লাগতে পারলে নিজেরাই যেন বর্তে যান। ১৮৬০-৭০-এ ইংরেজরা ডেভালায় এসেছিল স্বর্ণ খননের উদ্দেশ্যে। তবে তাদের সেই প্রকল্প সফল হয়নি। গঞ্জটার ইতিউতি এখন ছড়িয়ে কফি খাওয়ার ছোট ছোট বহু দোকান। কোনও বহুজাতিক চেন নয়, পুরোপুরি স্থানীয়। কিন্তু ঝকঝকে তকতকে। প্রতিটিতে শৌচাগার। এবং পরিচ্ছন্ন। পশ্চিমবঙ্গবাসীর কাছে অকল্পনীয়। চোস্ত ইংরেজিতে আপনার সঙ্গে কথা বলবেন দোকানের কর্মী অল্পবয়সি যুবকেরা। মেজাজ খোলতাই করা কফি মিলবে কাচের গ্লাসে। আর রকমারি স্বাদ-গন্ধের কুকিজ। স্রেফ দেবভোগ্য! তবে এ সব অভিজ্ঞতা তৃতীয় দিন বিকেলে।

তিন রাত-চার দিন সফরের দ্বিতীয় দিন দুপুরে গিয়েছিলাম ৩০ কিলোমিটার দূরে মুদুমালাই জাতীয় উদ্যানে। জঙ্গলের ভিতরে ঢুকতে আলাদা খরচে জিপ সাফারির বন্দোবস্ত অবশ্যই আছে। তবে সোজা মহীশূর গিয়েছে যে পিচ রাস্তা, সেটা ধরে ১০-১২ কিলোমিটার যেতে যেতে আমাদের গাড়িতে বসেই রাস্তার দু’পাশে দর্শন মিলল দাঁতাল হাতি, বাইসন, হরিণ, ময়ূর ও হনুমানের। প্রয়োজনই হল না বাড়তি সাফারির। চালসা থেকে লাটাগুড়ি, চালসা থেকে নাগরাকাটা কিংবা মূর্তি থেকে খুনিয়া মোড় এবং চিলাপাতা-জলদাপাড়া-বক্সা চিরে যাওয়া কোনও পথেই আমরা এই অভিজ্ঞতা ভাবতে পারব না। ডেভালার অর্পাথিব সুখ এই কষ্টটাই যা দিল।

পু‌নশ্চ: দক্ষিণ ভারতীয় খানায় বাঙালির বড় ভয়। ডেভালা কিন্তু সুস্বাদু চিকেন বিরিয়ানি, মাটন কষা, মাছ ভাজা থেকেও বঞ্চিত করেনি। তবে পুদিনা পাতা বাটা, কারি পাতা-সর্ষে ফোড়ন আর টক যে আমরা সব কিছুতে পছন্দ করি না, শুধু এটুকু রাঁধুনিকে জানিয়ে রাখলে আর সমস্যা নেই।

কীভাবে যাবেন ও কখন যাবেন

বছরের যে কোনও সময়ে, এমনকী ঘনঘোর বর্ষাতেও।

কী ভাবে যাবেন

ভোরের বিমানে কলকাতা থেকে বেঙ্গালুরু পৌঁছে সেখান থেকে যাওয়াই ভাল। কোয়েম্বত্তূর হয়ে গেলে যাওয়া ও ফেরার সময়ে একটা করে রাত ওখানে থাকতে হবে।

কোথায় থাকবেন

মূলত চারটি থাকার জায়গা। বিলাসবহুল রিসর্ট, মাঝারি মানের রিসর্ট, ইকো রিসর্ট ও চা বাগানের বাংলো।

Travel and Tourism Nilgiri mountains Hills নীলগিরি পাহাড়
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy