Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

অফিসপাড়ায় মাঝরাত

ফুটপাথবাসী। যৌনকর্মী। পুলিশ। দারোয়ান। পথের কুকুর। ওরাই প্রহরান্তরের জিম্মাদার। ঘুরতে ঘুরতে বারবার ঠোক্কর খেলেন ঋজু বসুঘা-খাওয়া জন্তুর মতো ঠিকরে আসছে অদ্ভুত গোঙানিটা। সেই সুরের সম-ফাঁক ভরে উঠছে ছাপার অযোগ্য কিছু শব্দে। মাছ-ভাতের থালায় মুখ গুঁজরে টাক-মাথা প্রৌঢ়। তাঁর পিঠের কাছে মুখ বার করে পোকায় খাওয়া মিশি-দাঁতে অনাবিল হাসে ময়লা ফতুয়ার যুবক। ছেলেটাকে সরিয়ে দেন রাস্তার ধারের খোলা হোটেলের বুড়োটে কর্মচারী! সস্নেহে বলেন, “সর্ মানিক! পাগল কাঁহিকা। ফালতু খোঁচাস না বেচারিকে।”

ছবি: প্রদীপ আদক

ছবি: প্রদীপ আদক

শেষ আপডেট: ০৭ মার্চ ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

ঘা-খাওয়া জন্তুর মতো ঠিকরে আসছে অদ্ভুত গোঙানিটা। সেই সুরের সম-ফাঁক ভরে উঠছে ছাপার অযোগ্য কিছু শব্দে। মাছ-ভাতের থালায় মুখ গুঁজড়ে টাক-মাথা প্রৌঢ়। তাঁর পিঠের কাছে মুখ বার করে পোকায় খাওয়া মিশি-দাঁতে অনাবিল হাসে ময়লা ফতুয়ার যুবক।

ছেলেটাকে সরিয়ে দেন রাস্তার ধারের খোলা হোটেলের বুড়োটে কর্মচারী! সস্নেহে বলেন, “সর্ মানিক! পাগল কাঁহিকা। ফালতু খোঁচাস না বেচারিকে।”

বাবুঘাট বাসস্ট্যান্ডের শেষ গাড়ি বেরিয়ে গিয়েছে অনেক ক্ষণ। ভাতের হোটেলের ভুক্তাবশেষের টানে গুটিকয়েক ‘লেবার’! মাল লোডিং, প্যাসেঞ্জার পাকড়াওয়ের কাজ শেষে মিলেনিয়াম পার্কের দিকের কলে গা-হাত-পা ধুয়ে খেতে বসেছেন তাঁরা। ‘পাগল’ মানিক মিয়া অবশ্য রোজকার খদ্দের, ফোকটের। তাঁর হাতে একখান জলের বোতল ধরিয়ে পাশের ঝুপড়ির ঘরে পাঠিয়ে দেন হোটেলকর্মী রবীন জানা। তারপর প্রৌঢ়ের কান্না থামানোর চেষ্টা করেন।

তিনিই বললেন, “বেচারি ট্যাক্সিড্রাইভারের অনেক টাকা চোট হয়েছে। গড়িয়ার পার্টি অনেক ঘুরে-টুরে এ দিকে কোন্ মদের ঠেকে দাঁড়াতে বলে কখন হাওয়া হয়ে গিয়েছে।” জানা গেল, ভদ্রলোকের বড় ছেলের ক্যানসার, পায়খানার জায়গায় ব্যাগ আটকে রাখতে হয়। ওষুধের যা খরচ, মালিককে এই টাকা শোধ করে, ওঁর হাতে আজ কিছুই থাকবে না। নিজেকে আর ভাড়া না-দেওয়া ফুর্তিবাজ যাত্রীদের একযোগে খিস্তিবর্ষণ করে চলেন ট্যাক্সিচালক। হাহাকারের মতো শোনায়।

জনা কয় ভয়-পাওয়া চেহারা তখনও দুর্বোধ্য হিন্দিতে ‘মালদা’র বাসের খোঁজ করছে। কষ্টেসৃষ্টে বুঝতে পারি, অন্ধ্রের লেবার, টাওয়ারের কাজ করেন। কে একজন ওঁদের বোঝান, এখন কিছু করার নেই। হাইকোর্টের দিক হয়ে অফিস-পাড়ায় ঢোকার চেষ্টা করি।

সবাই ঘুমায়ে আছে সব দিকে

ট্রাম-বাস তো বটেই! এ শহরের ইট-বাড়ি, সাইনবোর্ড জানালা, কপাট, ছাদ সকলেই যে চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে জানতেন জীবনানন্দ দাশ।

টাউন হলের সামনে থেকে পরিবহণের অফিস— কুণ্ডলী পাকিয়ে, উপুড় বা কাত হয়ে, কনুইয়ে ভর দিয়ে হাতের ‘বালিশে’ মাথা রেখে ঘুমের বিচিত্র ‘সিন’ দেখতে দেখতে রাইটার্সের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি।

ঠিক ইলাহাবাদ ব্যাঙ্কটার পদতলে বহু দিনের চেনা জুতো পালিশওয়ালা ‘পরমোদ ভাই’-এর ঠেক। চৌকির উপরে মশারি খাটিয়ে পরিপাটি বিছানায় লম্বা, ফুটপাথের সাড়ে তিন হাত ভূমির মালিক। মশারির উপরে ত্রিপল। নববিবাহিত দম্পতিরও ‘প্রিভেসি’র অভাব হবে না। ঘুমোনোর এমন ব্যবস্থার মনে-মনে তারিফ করতেই হয়। বিকট কেশে জিপিও-র দিক থেকে ছুটে যায় কয়েকটা মোটরবাইক। প্রমোদ দাসের নিশ্ছিদ্র ঘুম এতটুকু টাল খায় না।

নেটপাড়ার সোশ্যাল মিডিয়া এখন মেতে আছে, দেশ-বিদেশের নানা ঝুটঝামেলা-আমোদে। উগ্র মৌলবাদের বিপদ থেকে বিশ্বকাপ ক্রিকেট...নানা চিন্তায় কারও চোখে ঘুম নেই। ডাকাডাকিতে ঘুম চটকে লাল চোখে তাকান প্রমোদ।

বচ্চনের কুলি বইটা তো দেখেছেন বাবু? ডায়ালগটা মনে আছে, আপনার!

অঙ্গুঠা ছাপ বুজুর্গ মুচি প্রমোদের কাছে প্রজ্ঞার নুড়ি-পাথর মেলে হাত পাতলেই। তাঁর ডালার পাশে ছবির কোলাজে শিবজী, শেরাওয়ালি দুর্গামা, সিরডির সাঁইবাবার সঙ্গেই থাকেন ‘আসলি ভগবান’, বাবাসাহেব অম্বেডকর। প্রমোদ যা বললেন, তার মর্মার্থ: দিনভর গায়েগতরে খাটুনির না কি এক ধরনের ‘নেশা’ থাকে। একবার চোখ লাগলেই শান্তি, ‘পুরা মস্তি’র ঘুম। কুলিতে বচ্চনই বলেছিলেন।

এ বার একটু কড়া চোখে তাকান প্রৌঢ় মুচি। একটা জুতোয় কম সে কম পঁচাসবার বুরুশ ঘষতে হয়, বাবু! কাল ভি সুবাহে উঠব। এখন আপনি আসুন। আর কথা বললে আমার মুখ দিয়ে রক্ত উঠবে।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ক্ষুধিত পাষাণ

রাতের রাইটার্স, রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা পূর্ব রেলের প্রাসাদ আরও ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ মনে হয় এই নির্জনতায়। পোদ্দার কোর্টের দিকে সরে এসে একবার সেই বাড়িটার খোঁজ করি।

মিশমিশে মখমলে মাখা গলিতে ঠাহর করা ভারী শক্ত। সন্ধে সাতটাতেও জঙ্গলের মতো থিকথিকে ভিড় থাকে এ দিকে। এখন ম্যাটাডরের জঙ্গল। ও-পাশে ঝুপড়ি। ডাঁই করা জঞ্জাল। আর পচা গন্ধ। এ-সব ঠেলেঠুলে লাল-ইটের খাঁজ-কাটা ম্যাট ফিনিশ, ধূলিধূসরিত বাড়িটার মুখোমুখি।

আদ্যিকালের দেওয়াল ফুঁড়ে জংলা গাছের উঁকিঝুঁকি দেখতে পাচ্ছি। তবু এখনও চোখ-ফেরানো যায় না স্থাপত্যে। সে-যুগের বিখ্যাত নানকিং রেস্তোরাঁ। শুনেছি, এর দোতলায় ঢাউস বেডরুমের মতো কেবিন থাকত। তাতে ঘাপটি মেরে উত্তম-সুপ্রিয়ার গোপন অভিসার। আউটডোর শ্যুটিং ছেড়ে পালিয়ে সকাল থেকে অপেক্ষা করতেন উত্তমকুমার। ‘কী অপূর্ব রুপোর কারুকাজ করা বাসনে খাবার সাজিয়ে দিত!’— কয়েক বছর আগে বলেওছিলেন সুপ্রিয়া। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় অবধি ব্যস্ত দুপুরে নানকিংয়ের জন্য সময় বের করতেন। আরও ক-ত গল্প!

না, এখানে এসে আর কবি জীবনানন্দের শ্রান্তিময় ‘হৃদয়ের গভীর শান্তি’তে স্থিত থাকা যায় না। বরং মনে হয় ‘প্রাসাদের প্রত্যেক প্রস্তরখণ্ড ক্ষুধার্ত, তৃষার্ত...’ এই বাড়ির প্রতিটা ইটেই মিশে দীর্ঘশ্বাস। হঠাৎ তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ এসে বেঁধে— রাত কিতনা হুয়া? অভি বিয়ার মিলতা কাঁহি? চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি, এইটুকুনি সাইকেলভ্যানে কম্বলমুড়ি ক্ষয়াটে প্রৌঢ়া উঠে বসেছেন। ক’বছর আগেও ক’টা প্লাস্টিকের চেয়ার পড়ে থাকত। হেঁসেল দীর্ঘদিন বন্ধ। তবু দু’পাত্তর খেয়ে তেষ্টা মেটাতে নানকিংয়ে আসতেন লরির ড্রাইভার-খালাসিরা।

সাইকেলভ্যানের শয্যায় বসে নাফিসা বললেন, “বার এখন বন্ধ। দেখছেন না স্কুল হয়েছে।” পানশালার সাইনবোর্ড পাল্টে গিয়েছে। ‘টং অন চার্চ’। সকালে কিছু বাচ্চাও না কি পড়তে আসে। কোলাপসিবল গেটের ও পারে প্রশান্ত বুদ্ধমূর্তি। বাইরে সাইকেলভ্যানে প্রৌঢ়া ও এক ঘুমন্ত যুবক।

নাফিসাই দেখালেন, মেরি পতি। আফসর। প্রথম স্বামী মারা গিয়েছেন। প্রথম পক্ষের দু’টি ছেলে, বড়-বড়! ভোর সাড়ে তিনটেয় উঠে নাফিসা জঞ্জাল কুড়োবেন। কর্পোরেশনের গাড়ি এসে পড়বে যে! আর ভ্যানে কয়লা ভরে বেরিয়ে পড়বেন আফসর। মালিকের ভ্যান। সেই ভ্যানই রাতে পাল্টে যায় বেডরুমে।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

বেখাপ্পা যুগে আবছায়া রাত, জাপ্টে ধরছে অদৃশ্য হাত

আকাশবাণী-র দিকে এক চক্কর মেরে এ বার কার্জন পার্ক। বাতাসে বসন্তের ছোঁয়া। রাস্তার ও-পাশ থেকে হঠাৎ হাততালির আওয়াজ! ‘দেশলাই আছে!’ মিহি স্বর। টি-শার্ট, পাজামাপরা একটি ছেলে ডাকছে। এগিয়ে গিয়ে নেতিবাচক মাথা নেড়ে তাকাতেই, নিচু গলায় বলে, “আমি হিজড়ে। দেখেননি আমায়?”

বন্ধু পুলিশ অফিসারের কাছে রাতের অফিস-পাড়ার ছবির যা ট্রেলর পেয়েছি, তাতে দিনের বেলায় ট্রাফিক সিগন্যালে ভিক্ষারত ‘বৃহন্নলা’দের এখন সম্পূর্ণ অন্য রূপ। কার্জন পার্কে মহিলা যৌনকর্মীদের বাজার অনেকটাই খেয়ে নিয়েছেন হিজড়েরা। মিহি স্বর বলে চলেছে, ‘‘ভারী কাজ তো করতে পারি না আমরা! তবে...’’— হঠাৎ গাড়ির শব্দ পেয়েই, ‘পুলিশ আমি যা-ই’, বলে চকিতে মনুমেন্টের মাঠের দিকটায় মিশে যায় রোগাটে অবয়ব।

কার্জন পার্কের দিকে ফিরে মার্কস-এঙ্গেলস, রানি রাসমণি, সুরেন বাঁড়ুজ্জেদের মূর্তি পেরিয়ে এ বার এগিয়ে চলা। বাসস্ট্যান্ডের দিকে মাঠের ধারে শান-বাঁধানো চিলতে জায়গায় টান-টান বিছানায় তিন জন। কম্বলে ঢাকা ঘুমন্ত তিন মধ্যবয়সিনী। চুলে পাক ধরেছে, মুখে মেকআপ! ‘কী হল গো?’ উল্টো দিক থেকে প্রশ্নটা ভেসে আসে!

পার্কের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়ে রংমাখা আর এক শীর্ণ প্রৌঢ়া। “বাজার ডাউন, ভাই! ঘুমিয়ে নিচ্ছে! সকালে বাস ধরবে। যদি ভোর রাতে ভাগ্য ফেরে।”

কারও বাড়ি ডায়মন্ডহারবার, কেউ থাকেন উলুবেড়িয়ায়। কারও বাড়িতে ‘পাগলি বোন’, কারও অসুস্থ মা। যেন সেই আর্ট ফিল্মসুলভ শোকগাথার চিত্রনাট্য! হঠাৎ মেজাজ চড়ে যায় মহিলার। ‘‘কে কার মা, বোন, কার স্বামী কোথায়? এ-সব খবরে দরকারটা কীসের!’’ অচেনা আগন্তুককে বেটাইমে ঠিকুজি-কুষ্ঠী শোনাতে বিরক্তি ধরল? নৈঃশব্দ্য খানখান করে খ্যানখেনে গলার স্বর সরে যায় রাজপথের দিকে। সওয়ারিবিহীন ট্যাক্সি থামিয়ে মহিলার কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়েছেন এক ক্লান্ত চালক।

কেন যে কুকুরগুলো খামোকা চেঁচায় রাতে

রাজ্যপাটহীন রাইটার্স বিল্ডিং রক্ষায় বেসরকারি ডগ-স্কোয়াডের কথা কে জানত! লায়ন্স রেঞ্জের বিখ্যাত ‘মালাই-টোস্ট’-এর বন্ধ ঝাঁপের সামনে দাঁড়াতেই তেনারা ছুটে আসেন রে-রে করে! স্টক এক্সচেঞ্জের দিকের গলিটায় সটকে পড়ব ভেবে দু’পা পিছোতেই টের পেলাম এ হল, যুদ্ধক্ষেত্র। আমার সামনে এ বাড়ির গিন্নি, পিসি, হাবুদা, রাঙা মেসোর সঙ্গে পাল্লা দিতে ও দিক থেকে ও-বাড়ির ন’পিসে, ছোট মামা, জ্যাঠাবাবুরা রে- রে করে তেড়ে আসছেন। আমি পড়েছি, ‘ক্রসফায়ার’-এর মধ্যে। তখনই এক কনস্টেবল-ভায়া দেবদূতের মতো অবতীর্ণ হলেন।

মহাকরণের তিন নম্বর গেটের কাছের পাহারাদার কমব্যাট ফোর্সের ইনসাসধারী যুবক সারমেয়কুলকে একটু বকে-ঝকে বিস্কুট ছুড়ে দেন। মৃদু হেসে বলেন, “রাতে ওরাই এ তল্লাটের মালিক বুঝলেন। চারধারেই ঘিরে রেখেছে। তবে আমি হেঁটে গেলে কিন্তু কিচ্ছু করে না!” চুঁচুড়াবাসী তরুণ সদ্যবিবাহিত। পর পর নাইটডিউটির অনিয়মে পেট ফেঁপে পেটানো চেহারাটা আলগা হয়ে যাচ্ছে বলে আফশোস করেন। ‘‘ছিঁচকে চোরের উৎপাতেই রাত জাগতে হয়”,— বলতে বলতে কিছু দূর এগিয়ে দেন হাঁটতে হাঁটতে...

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী

দু’দশক আগে রাত-বিরেতে খবরের কাগজের ‘স্টোনম্যান বিট’-এর কথা আগেই শুনেছি! অগ্রজ সাংবাদিকরা বলেছিলেন, স্টোনম্যানের খোঁজে কেয়ার অফ ফুটপাথদের গা ঘেঁষে ঘোরাঘুরি করে রাত দেখার অভিজ্ঞতা।

খুঁজতে থাকি, হাইকোর্ট, স্টিফেন হাউস, টেলিফোন ভবনের দিকটায় হিন্দুস্থানী কেয়ারটেকারদের জমায়েতে আছে না কি কোনও রাজ কপূর? যাকে ঘিরে জমে উঠবে দেহাতি সুরে রামাইয়া ভাস্তাভাইয়া-র কোনও আসর। জোব চার্নকের ঘুমোনোর ঠিকানা, সেন্ট জেম্স গির্জার কাছের ফুটপাথে জমে উঠেছে টুকটাক ক্যারম বা কয়েক হাত টুয়েন্টি নাইনের আসর। এটুকুই!

গঙ্গার জলের কলে দিনের ক্লেদ বড় আরামে ধুয়ে ফেলে রাতের হাইকোর্টপাড়া। তবে অলিখিত নিয়ম, আর্লি টু বেড, আর্লি টু রাইজ! রাত ১১টার মধ্যেই চানের ভিড়টা হাল্কা। উকিলদের চেম্বার-অফিসের চিলতে খাঁজে ঢুকে পড়েন হাইকোর্টের টাইপিস্ট, বার লাইব্রেরির পিওন, সিকিউরিটি গার্ডরা।

ফ্লোটেলের কাছে রাত একটায় দেখা রাজমোহন যাদবের সঙ্গে। পোলিও-আক্রান্ত যুবক গান গেয়ে বেড়ান, জাগরণ-সম্মেলনে! সরকারি-ক্যাম্পে পাওয়া ঠেলা গাড়ির হাতল ঘুরিয়ে গুটিগুটি ঘোরেন। খিদিরপুরে নাম-গান ছিল। হাত দিয়ে গাড়ি ঠেলে বিন্দাস বাড়ি ফিরছেন গাইতে গাইতে! মহম্মদ আজিজ-মার্কা গলা! নিজেরই লেখা গান, ইস মন্দির মে মা রহতি হ্যায়...! যাবেন বেলুড়ে, টুকটুক করে যেতে যেতে তিনটে বাজবে। শিল্পী হাসতে হাসতে বলেন, আমার কোনও তাড়া নেই!

পা থেকে মাথা অবধি টলমল করে

বড় জোর ট্যাক্সিড্রাইভারের সঙ্গে খুচরো ঝগড়া। বারোটার মধ্যেই সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ, ডেকার্স লেন, আর এন মুখার্জি রোড, লালবাজার-চত্বরের পানশালার ঝাঁপ বন্ধ। বারের গায়িকাদের ফেরার বাহন নির্দিষ্ট। কোনও সঙ্গীকে ‘তোমার তো খালি, আশাকে লতা আর লতাকে আশা বলা অভ্যেস’ বলতে বলতে সাড়ে বারোটায় মিলিয়ে যায় আদুরে নারীকণ্ঠ।

‘একদিন রাত্রে’র ছবি বিশ্বাসের মতো সরেস মাতালরা গেলেন কোথায়? ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান স্ট্রিটে দেখা হয় শম্ভু দাসের সঙ্গে। কোন্ বাবুর থেকে পনেরো-পনেরো তিরিশ টাকা হাসিল করে খাসির ছাঁট ও রুটি দু’প্লেট চেখেছেন কাগজকুড়ানি শম্ভু। এখন হাঁড়ির তলানি সাফ করছেন।

রাতে থাকেন টি-বোর্ডের কাছের ফুটপাথে। আরও অনেকের সঙ্গে। শোওয়ার জায়গা নিয়ে মারপিট-হাতাহাতিও আকছার ঘটে। ‘‘তবে আমি প’ড়ে থাকি, যেখানে খুশি, যখন মুড হয়! পুলিশ এসে লাথ মারে! মার শালা!’’ নিজের ‘সর্বস্ব’ প্লাস্টিকের ব্যাগটা জাপ্টে ধরে খেতে খেতে বলেন শম্ভু। সস্তার ঝাঁঝালো তরলে অসাড় জিভে ঝাল-মশলার মধুর আরাম নেন তারিয়ে-তারিয়ে। সশব্দে চিবিয়ে খান। নবারুণ ভট্টাচার্যের ফ্যাতাড়ুদের কথাটা হঠাৎ মনে পড়ে যায়। নির্জন রাজপথে অজান্তে তাকাই আশপাশের বহুতলের ছাদে।

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

রাতজাগা তারা

লালবাজারের ঠিক পিছনে ফুটপাথে বেগুনি ভাজেন গোলাপি পাত্র। দেশ মেদিনীপুর। তিন মেয়ের মেডিক্যালে জন্ম। দুই নাতিরও। পুরো দাম্পত্য, বুড়ি হওয়া— সবই এ ফুটপাথময়।

গোলাপির ছোট মেয়ে পুষ্পা। নাম জিজ্ঞেস করতে বলে, স্কুলের নাম হল কুসুম। কে ইউ এস ইউ এম। আশীর্বাদ বিদ্যালয়ের ক্লাস টেন। সিবিএসই-র ‘বোর্ড এগজাম’ চলছে।

এক থালায় একটু মুরগির ছাঁট আর ভাত খেয়ে কখন ঘুমিয়ে কাদা পুষ্পার দিদি-জামাইবাবু, তাঁদের দুই খুদে। রাত সাড়ে তিনটেয় শেষ পাক ঘুরতে এসে দেখি, পুষ্পা তখনও ল্যাম্পপোস্টের নীচে ইংরেজি বই হাতে। স্কুলে বাংলা নেই। হিন্দি-ইংলিশ! ইংলিশ পড়তেই বেস্ট লাগে! সকালে কাছেই ডাক্তারবাবুর চেম্বারে সাফাইয়ের কাজ করতে যায়। সব মিটিয়ে ফের পড়তে বসা। মেয়ের হাতে মোবাইল দেখে জানতে চাই, ফেসবুক করো না কি তুমি? ঝটপট জবাব, ফেসবুক অফ রেখেছি, হোয়াট্স অ্যাপেও নেই। আগে পঢ়ালিখা শিখে কুছ বন্না হ্যায়। কী হবে? লাজুক হাসি, আমি আরও শিখতে চাই। দিদির মতো থোড়ি স্কুল ছেড়ে দোব!

সুমনের পুরনো গান হঠাৎ মুখোমুখি তাকায়। শহরে জোনাকি জ্বলে না নয়তো, কুড়োতাম সে-আগুন নীল হয়তো...আগুনটুকুর আঁচ নিয়েই হেসে টাটা করি তাকে!

অন্ধকার, এখনও কাটেনি! তবে চারটে বাজল। সবে হাইকোর্টপাড়ার পুরুতঠাকুর মহাদেব মিশ্র বাবুঘাটের দিকে চলেছেন।

ছাতাওয়ালাগলিতে প্রাতরাশ-ঠেকের সরঞ্জাম সাজিয়ে সয়া সসের পাউচ ভরেন চিনা বৃদ্ধ। লরিবোঝাই টাটকা কাগজ হাজির ভাগাভাগির জন্য। উনুনে চায়ের কেটলি বসিয়ে দু’টো টিন ভর্তি করে গঙ্গার পানি নিয়ে এলেন বেন্টিঙ্ক স্ট্রিটের চা-ওলা রঞ্জিত। এ বার ফিরতে হবে। টের পাই ‘খ্যাঁচখ্যাঁচ ঘ্যাঁষঘ্যাঁষ রাত কাটে ওই রে...

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

patrika anandabazar riju basu
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE