Advertisement
০৩ মে ২০২৪
নাটক সমালোচনা ২...

আক্কেল গুড়ুম

পূর্ব পশ্চিম-এর নতুন নাটক। একেবারে উল্টো হাওয়ার পন্থী। মহলা দেখে লিখছেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়সাম্বার দেশ থেকে ফুটবলের লাইভ কভারেজ যখন রাত জাগতে বাধ্য করছে, তখনই খবর, এ শহরে মঞ্চে আসছে কার্নিভালের আমেজ! ১৯৬৯-এ যে কাহিনি নিয়ে পর্দায় এসেছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান-ওয়াল্টার ম্যাথাউজ, ২০০৫-এ যাকে ঘিরে তৈরি সলমন-সুস্মিতা-ক্যাটরিনার ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিঁউ কিয়া’, এ বার বাংলা তাকে দেখবে মঞ্চে (বাংলা নাটক বলিউডের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে নামছে সম্ভবত এই প্রথম)!

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

ছবি: সুব্রত কুমার মণ্ডল

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

সাম্বার দেশ থেকে ফুটবলের লাইভ কভারেজ যখন রাত জাগতে বাধ্য করছে, তখনই খবর, এ শহরে মঞ্চে আসছে কার্নিভালের আমেজ!

১৯৬৯-এ যে কাহিনি নিয়ে পর্দায় এসেছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান-ওয়াল্টার ম্যাথাউজ, ২০০৫-এ যাকে ঘিরে তৈরি সলমন-সুস্মিতা-ক্যাটরিনার ‘ম্যায়নে প্যায়ার কিঁউ কিয়া’, এ বার বাংলা তাকে দেখবে মঞ্চে (বাংলা নাটক বলিউডের সঙ্গে ছায়াযুদ্ধে নামছে সম্ভবত এই প্রথম)!

মূল কাহিনিটি একটি ফরাসি নাটকের। তাকে অবলম্বন করে আমেরিকার সাহিত্যিক আবে বারোজ লেখেন ব্রডওয়ে থিয়েটার প্লে ‘ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার’। তার ছায়াতেই তৈরি উজ্জ্বল চট্টোপাধ্যায়ের ‘আক্কেল গুড়ুম’। যে নাটক নিয়েই ‘পূর্ব পশ্চিম’ নাট্যদল আনতে চলেছে তাদের নতুন প্রযোজনা।

রবীন্দ্রনাথ-মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়-গিরীশ কারনাডের নাটক করা দলটি এ বার আর সিরিয়াস ধারাপাতে নেই। বদলে সোজা ঢুকে পড়েছে কমেডিতে। কাহিনির মারপ্যাঁচ? নেই। বেশি মাথা ঘামাঘামি? নেই। রাজনীতি, পোস্ট মডার্নিস্ট তক্কাতক্কি, স্যুরিয়েলিজমের কচকচি? নেই-ই।

তা হলে রইলটা কী? তরতরে, ফুরফুরে, সোজাসাপটা একটা গল্প। বলতে গেলে এ থিয়েটারের নায়কের চরিত্রে ওই গল্পটাই। তাকেই আস্তিনে বাগিয়ে এগোচ্ছেন পরিচালক সৌমিত্র মিত্র। নিজের দলের নাটক ‘চতুরঙ্গ’, ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’-এর পর এটা তাঁর তিন নম্বর পরিচালনা।

নাটক পছন্দে ঝুঁকিপ্রিয় এই পরিচালক এ বারে কিন্তু বহু পোড়-খাওয়া দলের চেয়ে একটু বেশিই সাহসী। চারপাশে যখন শেক্সপিয়র, জীবনীভিত্তিক বা ঐতিহাসিক থিয়েটার নয়তো ক্লাসিক্সের বাজার, নিদেন মৌলিক নাটক হলেও সময়কে ছুঁয়ে থাকা গল্পের বুনোট, সেখানে পুরো উল্টো পথের সওয়ার তিনি। সবাই যখন পুবে, উনি গেলেন পশ্চিম!

যুক্তিটা অবশ্য পাক্কা। ‘পথের পাঁচালী’র দর্শক কি ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’য় বুঁদ হন না? নাকি, মাল্টিপ্লেক্সে স্বচ্ছন্দ বাবুটি মানিকতলা বা গড়িয়াহাটের বাজারে ঢোকেন না?

‘জয় মা কালী বোর্ডিং’, ‘শ্রীমতী ভয়ংকরী’, ‘অঘটন’-এর কথা মনে পড়ে? ৭০-৮০ দশকে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, রবি ঘোষ, অনুপকুমার কি বাসবী নন্দীদের থিয়েটার। অনেকটা সেই ঘরানায় নাম লেখালো ‘পূর্ব পশ্চিম’। সংলাপের ট্যুইস্ট, পরের পর অ্যাবসার্ডিটি, মুহুর্মুহু সরলতা (যাকে বোকামি বলে ভুল করে শহুরে মন) এ ঘরানায় এ সবই জায়েন্ট কিলার।

এক সুদর্শন দাঁতের ডাক্তার। পুরো লেডি কিলার। কিন্তু এ বার নিজেই হাবুডুবু এক হবু ‘সানিয়া মির্জা’য়। তবে আদপে অবিবাহিত সেই ডাক্তার দু’বছর প্রেম করার পর কী এক খেয়ালে প্রেমিকাকে বলে বসেন, তিনি বিবাহিত। দুই সন্তানের জনক। তাতে আত্মহত্যা করতে যান প্রেমিকা। পুরো ব্যাপারটি ম্যানেজ দিতে ডাক্তার তখন বিকট ফন্দি আঁটেন। ন্যাশনাল চ্যাম্পিয়ন সেই টেনিস প্লেয়ার ইন্দুমতী। তাঁকে বিয়ে করার আগে ডিভোর্স দেবেন ‘স্ত্রী’কে।

সোজা হিসেব। কিন্তু বেঁকে বসলেন ইন্দু। তিনি যাচাই করতে চান, ডাক্তারের ডিভোর্সের কারণ কতটা সাচ্চা। তাঁর ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ কতটা সুরক্ষিত।

এমনকী যখন শোনেন, ডিভোর্সের পর ডাক্তারের স্ত্রী বিয়ে করবেন তাঁর বহুকালের বন্ধুকে, পরখ করতে চান তাঁকেও। একটুও এ দিক ও দিক বুঝলে, বুঝিয়ে দিয়েছেন শাদি, অওর তুমসে? কভি নেহি। মহা গেরো। বিয়ের শর্ত মানতে ডাক্তারের নকল বৌ চাই। চাই নকল ছেলেমেয়ে। এমনকী বৌয়ের নকল হবু বরও। ডাক্তার পুরো গাড্ডায়।

গল্পের বুননে নিপাট হাসির মেজাজ। কিন্তু তা আশি ভাগ। বাকি কুড়িতে কিন্তু হাস্যরঙ্গের মোড়কেই ব্যঙ্গরস। যাতে ধরা আছে মানুষে-মানুষে সম্পর্কের ভাঙাগড়ায় যত রং আর যত বেরং, তার কখনও ঠোকাঠুকি, কখনও’বা লুকোচুরি।

তুখড় অভিনয়, সংলাপে নিখুঁত টাইমিং। কমেডি থিয়েটারে এ গুলোই এক ও দুই নম্বর শর্ত। তার কথা মাথায় রেখে এ নাটকের চারটি প্রধান চরিত্রে পরিচালক কেমন লাইনআপ ভাবলেন, দেখে নেওয়া যাক।

বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী। ছোট পর্দায় অতি চেনা মুখ। সদ্য বাংলা সিরিয়াল ‘মা’-এ ছিলেন ঝিলিকের বাবা। তার আগে বড় পর্দায় ‘পরাণ যায় জ্বলিয়া রে’ বা ‘লে ছক্কা’-য় দেবের বাবা। কিন্তু তার পরও বিশ্বজিতের থিয়েটার-কানেকশন নিয়ে কোনও প্রশ্ন নেই। এক কালে উৎপল দত্তর পিএলটি-তে ‘কল্লোল’ নাটকে হতেন শার্দুল সিং কিংবা ‘বণিকের মানদণ্ড’র হেস্টিংস। গত কয়েক বছরেও বেশ কয়েক বার মঞ্চে এসেছেন ‘কিং লিয়ার’ থেকে ‘অশালীন’-এর মতো জনপ্রিয় নাটকে। এ থিয়েটারে তিনি ডাক্তারের বন্ধু। আর ‘প্রেম শুধু এক মোমবাতি’ সিরিয়ালের অভিনেতা।

দেবদূত ঘোষ। সিরিয়ালে তো বটেই, তার আগে থেকেই থিয়েটারে তিনি অতিচেনা। বিভাস চক্রবর্তী-দেবেশ চট্টোপাধ্যায় থেকে ব্রাত্য বসু-কৌশিক সেন। দেবদূত মঞ্চে আসছেন পঁচিশ বছর ধরে। ‘আক্কেল গুড়ুম’-এ তিনি ডাক্তার।

কাঞ্চনা মৈত্র। ‘বাই বাই ব্যাংকক’-এর নন্দিতা বাগচী। তুলনায় থিয়েটারে কম এলেও দর্শক তাঁকে মঞ্চে দেখেছেন ‘হেমলাট’ আর ‘চিলে কোঠার সেপাই’-এ। এ নাটকে তিনি নার্স। এঁদের সঙ্গে আছেন এই মুহূর্তে বাংলা নাটকে ভাল রকম ফোকাসে আসা অভীপ্সা কাজী। নাটক ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’, ‘ভালমানুষ’, ‘অ্যান্টনি কবিয়াল’, ‘আরব্যরজনী’র অভীপ্সাই এখানে ইন্দু।

নিঃসন্দেহে চোখে পড়ার মতো লাইনআপ। যার রসায়ন জমলে নাটক উতরে যাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা।

পুরনো গ্রুপ থিয়েটারি ঘরানা থেকে হয়তো’বা একটু বেরিয়ে দুটো কোরিওগ্রাফের কাজ করছেন সুকল্যাণ ভট্টাচার্য। গিরীশ কারনাড থেকে চন্দন সেন। থিয়েটারের দর্শক সুকল্যাণকে দেখছেন বহু দিনই। বাংলা ছবিতেও তাই। তরুণ মজুমদার হয়ে রাইমা সেন-মিঠুন চক্রবর্তী। সদ্য ‘দ্য হাম্বল অফারিং’ নামে রবীন্দ্রনাথের ছবি নিয়ে নৃত্যনাট্য করছেন আমেরিকায়। যার ভয়েস ওভারে আছেন শর্মিলা ঠাকুর।

‘পূর্ব পশ্চিম’-এর ঠিক আগের নাটক ‘আন্টনি কবিয়াল’-এ মার্শাল আর্ট দিয়ে নৌকার কোরিওগ্রাফ করে চমকে দিয়েছিলেন সুকল্যাণ। এ বার ব্যালে আর ফ্রি ফ্লোয়িং মুভমেন্ট দিয়ে মঞ্চে ‘কার্নিভাল’-এর মেজাজ জুড়তে চান তিনি। অন্তত দু’বার। মহলায় গিয়ে দেখা গেল বাদল দাসের ‘লেজার আলো’র কাটাকুটি খেলার নীচে একটি বার-সিকোয়েন্সে তারই কোরিওগ্রাফ। তার সঙ্গে একটি স্বপ্নদৃশ্যে মঞ্চ জুড়ে প্রায় ভাসমান এক পরি। পোশাক করছেন মালবিকা মিত্র। সেট ইন্দ্রনীল ঘোষ।

ষাটের শেষে বার্গম্যানরা বাজার কাঁপিয়েছিলেন। বছর নয় আগে সলমনরাও তাই। ২০১৪-য় আবার সেই ‘ক্যাকটাস ফ্লাওয়ার’। মধূসুদন মঞ্চ। ২৯ জুন। ‘আক্কেল’-এর ফার্স্ট রাউন্ডে অ্যাসিড-টেস্ট হয়ে যাবে সেদিনই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

debshankar mukhopadhyay akkel gurum play
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE