Advertisement
E-Paper

খানে বিপন্ন অস্তিত্ব

গভীর ট্র্যাজিক অভিঘাত পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের ‘অয়দিপউস’ নাটকে। লিখছেন বিপ্লবকুমার ঘোষমানুষ কি তার নিয়তির গোলাম? নাকি একটা গোটা জীবন ধরে সে নিজেই নির্মাণ করে তার নিয়তি? সত্যি কি মানুষ এভাবেই তার সমস্ত পাপের দায়ভার পূর্বজদের ঘাড়ে, ইতিহাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে? অমীমাংসিত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দৃশ্যপটের ‘অয়দিপউস’। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে চর্চিত জনপ্রিয় গ্রীক পুরাকথা। শুধু কালভেদে বদলেছে তাকে দেখবার চোখ। নিয়তির নিষ্ঠুরতায় অজান্তেই হত্যা করে ফেলে তার জন্মদাতা পিতাকে, গর্ভধারিণী জননী হয়ে ওঠে শয্যাসঙ্গিনী।

শেষ আপডেট: ১৯ জুলাই ২০১৪ ০০:৩৩

মানুষ কি তার নিয়তির গোলাম? নাকি একটা গোটা জীবন ধরে সে নিজেই নির্মাণ করে তার নিয়তি? সত্যি কি মানুষ এভাবেই তার সমস্ত পাপের দায়ভার পূর্বজদের ঘাড়ে, ইতিহাসের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারে? অমীমাংসিত প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয় দৃশ্যপটের ‘অয়দিপউস’। প্রায় দু’হাজার বছর ধরে চর্চিত জনপ্রিয় গ্রীক পুরাকথা। শুধু কালভেদে বদলেছে তাকে দেখবার চোখ। নিয়তির নিষ্ঠুরতায় অজান্তেই হত্যা করে ফেলে তার জন্মদাতা পিতাকে, গর্ভধারিণী জননী হয়ে ওঠে শয্যাসঙ্গিনী। আর সেই অনাকাঙ্ক্ষিত সত্য প্রকাশেই এক গভীর ট্র্যাজিক অভিঘাত ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয় অস্তিত্বের মূল। সেই অয়দিপউস, হর ভট্টাচার্যের কলমে হয়ে উঠেছে গোটা যুগের ট্র্যাজেডির ধারক। উন্মত্ত যান্ত্রিকতা আক্রান্ত যে যুগ তার সভ্যতাভিমানের গর্ভে পুঁতে রেখেছে তার নিজেরই ধ্বংসের বীজ। তার মেধা-বুদ্ধি-যুক্তি যে আসলে কাজে লাগিয়েছে তার ধারক তার মা। প্রকৃতির বিরুদ্ধে তাকে জয় করার নামে প্রতি মুহূর্তে ধর্ষণ করে চলেছে যে গ্রীন হাউস সভ্যতা, তাদেরই ট্র্যাজেডি যেন রূপ পেয়েছে এক পৌরাণিক গ্রীক নায়কের জীবন ভাষ্যে। অনির্বাণ ভট্টাচার্যের নির্দেশনায় গোটা মঞ্চ জুড়ে একদল মানুষ কি পরম মমতায় নির্মাণ করেছে, স্পর্শ করেছে সেই ট্র্যাজিক সিম্ফনির প্রত্যেকটি নিখুঁত পর্দা।

উন্মত্ত ঝড়ের মাঝে সন্ত্রস্ত কাকেদের কর্কশ চিৎকার, প্রেক্ষাগৃহে সবাই তখন আশঙ্কার গর্ভাশয়ে। পর্দা সরে যায় আর্তনাদে। ঘোলাটে আধো-আলো মঞ্চ। তারা কি মানুষ? নাকি খণ্ডিত হাত-পা-মুখ-যৌনাঙ্গের মাংসল পিণ্ড। মঞ্চের অনেকটা উপরে, ভেসে ওঠে এক ছায়ামূর্তি, পিঠ তার আর্তনাদের দিকে এই কি রাজা? তখনও চোখ জুড়ে তার ভোগযোনীর তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

নাটক শুরু হয় অয়দিপউস ও তার প্রেয়সী রানি ইয়োকাস্তার সংলাপে। অন্ধকার আশঙ্কায় আক্রান্ত, দৈববাণী তাড়িত রাজা অয়দিপউস সান্ত্বনার নীড় খুঁজে পায় প্রেয়সী ইয়োকাস্তার গভীর সান্নিধ্যে। কিন্তু সে সান্ত্বনা ক্ষণিকের। যন্ত্রণায় দগ্ধ, পীড়িত, মৃতপ্রায় নগরবাসীর করুণ আর্তনাদ আছড়ে পড়ে মহান রাজার শঙ্কিত হৃদয়ে। জিউস-এর পুরোহিতের মুখে যে সর্বনাশের আখ্যান শোনেন রাজা তা কি শুধু থিবস্ নগরীর। বোধহয় না, এ সমস্যা আজকের। সমগ্র মানবতার হয়ে এই ধ্বংস থেকে পরিত্রাণের আর্জি যেন নিঃসৃত হয় জিউস-এর মহান পুরোহিতের কণ্ঠস্বরে। রাজা অয়দিপউস তখন শুধু থিবস্-এর রাজা থাকেন না আর, সমগ্র আধুনিক সভ্যতার প্রতিরূপে পরিণত হন ‘ব্যক্তি অয়দিপউস’।

অয়দিপউস-এর বহুচর্চিত ট্র্যাজেডির এই নবীনতম ব্যাখ্যা আরও স্পষ্ট হয় অন্ধ দৈবজ্ঞ তাইরেসিয়াস-এর সংলাপে। ধ্বংসের প্রলয়রূপে দিশেহারা রাজা সত্য অনুসন্ধানে দ্বারস্থ হন গুরু তাইরেসিয়াস-এর। উদ্ঘাটিত হয় সত্য। কিন্তু তার তীব্রতা সহ্য করতে পারে না রাজা। অন্ধ অহংকারে মূঢ় রাজা অগ্রাহ্য করতে চায় নিজের নিয়তিকে। নিজের অর্জিত ক্ষমতা ও সহজাত বুদ্ধির আস্ফালনে ভন্ডামির দায়ে দুষ্ট করে গুরু তাইরেসিয়াসকে। তার তখনই প্রকৃত জ্ঞানীর কণ্ঠে শোনা যায় এই ধ্বংসের গভীরতম কারণ। শুধু রাজা অয়দিপউস নয়, এই নির্ভীক উচ্চারণ যেন ধ্বংসোন্মুখ অথচ দাম্ভিক এই মানব সভ্যতার প্রতিও। ‘ওই ক্ষমতাই তোমার পতনের কারণ, তোমার সহজাত বুদ্ধি তোমার পতনের কারণ...’।

হায় রে মানুষ! সত্যিই তো সে বোঝেনি যে সহজাত বুদ্ধি, বিজ্ঞান, কারিগরি দক্ষতা দেবতার আশীর্বাদের মতো বর্ষিত হয়েছিল তার উপর, ক্ষমতার জান্তব লালসায় তাকেই সে একদিন পরিণত করে ফেলবে চরম অভিশাপে। কিন্তু যে অভিশাপ নেমে আসছে আজকের মানুষের উপর তার সব দায় কি তার একারই? নাকি পূর্বজদের পাপ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে ছড়িয়ে দেয় তার দায়ভার। ঠিক যেভাবে রাজা লাইউস-এর পাপের বিষ-রক্ত অয়দিপউস-এর জীবনে এনেছে সর্বনাশ, যে সর্বনাশ আবার ধাবিত হয়েছে অয়দিপউস-ইয়োকাস্তার সন্তানদের শিরায় ধমনিতে। এ পাপচক্র থেকে মুক্তি কোথায়? মুক্তি পায়নি রাজা অয়দিপউস। মুক্তি পায় না মানব সভ্যতা। নাটকের শেষ পর্বে ইয়োকাস্তাই যেন হয়ে ওঠে সেই জননী প্রকৃতি। কিন্তু না, সে চোখ নেই সন্তানের। নির্মম ,সত্যের আঘাতে নিজের প্রতি অন্ধ আক্রোশে রাজা শিকড় সুদ্ধ উপড়ে ফেলেছে সেই দুটি চোখ। আশাহত মা দায়ী করে নিজেকেই। যে পিচ্ছিল পাপ-যোনী দিয়ে স্বামী ও সন্তান একসঙ্গে নেমে এসেছিল, সেখানেই আমূল বসিয়ে দেয় নিজেরই চুলের কাঁটা। প্রসাধন হয়ে ওঠে অস্ত্র। হত্যার উপকরণ! এখানেই এই নাটকের চরমতম ট্র্যাজেডি।

রাজা অয়দিপউস-এর ভূমিকায় দেবশঙ্কর হালদার অনন্য, অসাধারণ। তার সঙ্গে যোগ্য সঙ্গত দিয়েছেন রানি ইয়োকাস্তা সেঁজুতি মুখোপাধ্যায়। গুরু তাইরেসিসা-এর ভূমিকায় জয়ন্ত বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিনয়ও মনে রাখার মতো। জয়িতা গোস্বামী, পার্থপ্রতিম নাথ, সন্দীপ সাহা, তারাশঙ্কর ভট্টাচার্য ও গৌতম পাল চুটিয়ে অভিনয় করেছেন। পরিচালক অনির্বাণ ভট্টাচার্যের পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দিয়েছেন ঝুমা বসাক। মাতৃযোনী এই নাটকের ট্র্যাজেডির ধারক। সেই মতো সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ নির্মাণ। জয় সেনের আলো নাটকের অন্তর্নিহিত রূপটিকেই আরও গভীর ভাবে চিনতে শেখায়।

ayedipaush anirban bhattacharya play biplab kumar ghosh
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy