বছর সাতেক আগের কথা। তখন দুবাইয়ের এক ধনী ক্রিকেট-উৎসাহীর জন্য একটা কফি-টেবল বই নিয়ে কাজ করছি। বিষয় আধুনিক ক্রিকেটের সর্বসেরাদের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই তালিকার উপরের দিকে স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডসের নাম। তিন দশক ধরে ওকে খুব ভাল করে চিনি।
অ্যান্টিগার টেলিফোন নম্বরে ওকে ফোন করায় ওর স্ত্রী বলল, ভিভ ব্রুনেইয়ে।
“ব্রুনেই?” জিজ্ঞেস করলাম। কিন্তু ওখানে তো কেউ ক্রিকেট খেলে না!
জানা গেল ব্রুনেইয়ের সুলতান (ওয়ারেন বাফে আর বিল গেটসের সঙ্গে তখন তিনি বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তিত্ব) জানতে চেয়েছিলেন, বিশ্বের সেরা ক্রিকেটার কে? এবং উনি নিজের ছেলের জন্য এমন এক জন কোচ খুঁজছিলেন, খেলাটার প্রতি যার আবেগ আছে।
বন্দর সেরি বাগাওয়ানের বিলাসবহুল বাড়িতে ভিভকে ফোনে ধরলাম। তেল-সমৃদ্ধ দেশের বিলাসবহুল রাজধানী। বিশ্বের প্রত্যন্ত কোণে ওকে ধরতে পেরেছি দেখে ভিভ তাজ্জব। বললাম, “একটা কফি-টেবল বইয়ের জন্য বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের সাক্ষাৎকার নিচ্ছি।”
শুনে ছদ্ম বিনয়ে ভিভের উত্তর, “তো এর মধ্যে আমি আসছি কোথা থেকে?”
বিখ্যাত এক বাংলা কাগজে কাজ করা আমার এক ক্রিকেট-লিখিয়ে বন্ধুর সঙ্গে কয়েক দিন আগে প্রায় এই বিষয় নিয়েই ওর কিছু কথা হয়েছিল। সেই মুহূর্তে মনে করিয়ে দিলাম সেটাই।
সাংবাদিক ভিভকে জিজ্ঞেস করেন, “আপনার দেখা সর্বশ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান কে?” রিচার্ডস জবাব দেয়, “আমি তো সেটা বলতে পারব না। আপনিই আমাকে বলুন।” বিনয়ী বটে!
ভিভের ঔদার্য কিংবদন্তি-সম। ও আমাকে ফোন রাখতে বলে বলল, সুলতানের টাকায় ও-ই ফোন করবে আমায়। তার পর? পনেরো মিনিটের আড্ডা আর দারুণ একটা সাক্ষাৎকার।
১৯৮৯-এর ক্যারিবিয়ানের গ্রীষ্ম। আমি অ্যান্টিগায় ভিভের অতিথি। দ্বীপটার জনসংখ্যা তখন লাখেরও কম। ছড়ানোছেটানো কিছু আখের খেত আর প্রসেসিং কারখানা। দ্বীপের জীবন তখন গয়ংগচ্ছ। ধীর লয়ের।
রাজধানী সেন্ট জন্সে ছিল বিলাসবহুল কিছু ক্যাসিনো আর নাইটক্লাব। ওখানকার জুয়ার টেবল বা বারে যা সম্ভাষণ পেতাম, সত্যি বলছি, পরে কোথাওই অতটা পাইনি। মনে আছে কোনও কিছুর জন্যই আমাকে টাকাপয়সা দিতে হত না। তার একটাই কারণ, গ্রেট ম্যানের সঙ্গে ছিলাম যে!
যে সময়টার কথা বলছি, তখন ই-মেল বা ফ্যাক্সই আসেনি। গ্রানাডা হয়ে বার্বেডোজ যাওয়ার ফ্লাইটে ভিভের কাছে ওর ঠিকানা চাইলাম। খুব সিরিয়াস মুখ করে উত্তর দিল, “শুধু বোলো ভিভিয়ান রিচার্ডস, অ্যান্টিগা। ভিভিয়ান রিচার্ডস, ওয়েস্ট ইন্ডিজ বললেও হবে!”
১৯৭৬-এ ওয়েস্ট ইন্ডিজে ভারতের ঘটনাবহুল সফর। বার্বেডোজে প্রথম টেস্ট ম্যাচে ভারতীয় বোলিং এফোঁড়-ওফোঁড় করে ছেড়েছে ভিভ।
ক্লাইভ লয়েড আর রিচার্ডস মিলে তিন দিনে ম্যাচ শেষ করে দিয়েছিল। একটুআধটু সাহায্য ছিল অ্যান্ডি রবার্টস আর মাইকেল হোল্ডিংয়ের। ভিভের কাছে তেতো মুখ করে অভিযোগ করলাম, দিলে তো দু-দুটো দিনের কমেন্ট্রি-ফি হাতছাড়া করে!
ভিভ কী ব্যাখ্যা দিয়েছিল জানেন? ও বলেছিল ওকে নাকি ম্যাচটা তাড়াতাড়ি শেষ করতেই হত, যাতে বার্বেডোজ বন্দরে নোঙর ফেলা কুইন এলিজাবেথ-২ জাহাজে ওরা পার্টি করতে পারে। তারপর আধা সিরিয়াস গলায় বলেছিল, “আসলে টেস্ট ম্যাচের মধ্যে বেশি রাত করে ফেরাটা ম্যানেজার জো সলোমন আবার পছন্দ করবেন না।”
স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডসের জন্য ১৯৭৬ খুব স্মরণীয় একটা বছর। ওই মরসুমে ৯০-এর গড় নিয়ে অবিশ্বাস্য ভাবে ও ১৭১০ রান করেছিল। মনে রাখবেন, ওই মরসুমের মধ্যেই কিন্তু ছিল অস্ট্রেলিয়ার সেই বিধ্বস্ত সফরটা। তার পর ভারতের ক্যারিবিয়ান সফর, আর সব শেষে ইংরেজ গ্রীষ্মের সিরিজ। যা নিয়ে টনি গ্রেগের সেই বিখ্যাত উক্তি ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান সফরকারীদের ঘাড় নুইয়ে ছাড়ব!
বলা হয় অ্যান্টিগা দ্বীপে নাকি ৩৬৫টা বিচ আছে। আমি নিজে অবশ্য কোনও দিনই সবগুলো গুনে উঠতে পারিনি। ওখানে খুব খাড়া একটা পাহাড়ও আছে, যেখান থেকে নীলচে সবুজ ক্যারিবিয়ান সমুদ্র দেখা যায়।
স্থানীয়রা বলে, পাহাড়ের উচ্চতা নাকি এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের চেয়েও বেশি। অদ্ভুত এই জায়গাটার নাম শার্লি হাইট্স।
পাহাড়ের খাড়া দিকটা বেয়ে ওঠার সময় দেখতে পাবেন চার দিকে রাস্টাফেরিয়ানরা বসে। এরা হল আধা-ধার্মিক একটা সম্প্রদায়ের সদস্য। ওরা নাকি নিরামিষাশী। ওদের ধমর্র্ই নাকি ওদের গাঁজাসেবনের উপদেশ দেয়। নিরামিষ খাওয়ার ব্যাপারটা জানি না, তবে সারা দিন দিব্যি মারিজুয়ানা খেয়ে বেড়াত ওরা। ওদের আটকানোর সাহস বা ক্ষমতা কোনও পুলিশের ছিল না।
অন্তরঙ্গ বন্ধু বোথামের সঙ্গে
১৯৮৯-এ নীনা গুপ্ত-র সঙ্গে রোমান্স আর ওদের মেয়ে মাসাবার ব্যাপারটা ভিভ কী ভাবে দেখে, এ নিয়ে ভারতীয়দের কম কৌতূহল নেই। মাসাবা তো এখন আবার নামী ফ্যাশন ডিজাইনারও। সত্যি বলতে কী, অ্যান্টিগা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজেরও মানুষজন ব্যাপারটাকে খুব সহজ ভাবে নেয়। ওদের সুন্দর দ্বীপে মিস গুপ্ত আর মাসাবা অতিথি হিসেবে সব সময় স্বাগত।
আশির দশকের প্রথম থেকে মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত ইংরেজ কাউন্টিতে সমারসেটে খেলত রিচার্ডস। সেখানে ওর অন্তরঙ্গ বন্ধুদের মধ্যে ছিল স্যর ইয়ান বোথাম আর জোয়েল গার্নার।
রিচার্ডসের ব্যাপারে ওর বন্ধুরা কতটা অনুগত ছিল শুনবেন? ’৮৫ আর ’৮৬ দু’বছর লিগে সমারসেট বেশ নীচে নেমে যাওয়ায় ’৮৭-তে অধিনায়ক পিটার রোবাক, ভিভ আর গার্নারকে বাদ দিয়ে দিয়েছিলেন। যার প্রতিবাদে বোথামও পদত্যাগ করে ফেলে। এত কিছুর ফল? তিন বছর বাদে সমারসেটের কাউন্টি মাঠ টনটনের গেট-এর নামকরণ হয়ে যায় ‘স্যর ভিভিয়ান রিচার্ডস’।
১৯৮৩, আর তার পর ১৯৮৪। পর পর দু’বছর রিচার্ডসকে দক্ষিণ আফ্রিকায় বিদ্রোহী সফরে খেলার জন্য ডাকেন জো পামেন্সকি আর ডক্টর আলি বাখার। অফারটা ছিল ‘পুরো ব্ল্যাঙ্ক চেক’।
দক্ষিণ আফ্রিকা তখনও বর্ণবিদ্বেষীদের আওতায়। আর সে জন্য নৈতিক কারণেই ভিভ অফার ফিরিয়ে দেয়। দু’বারই বলে, ও কৃষ্ণাঙ্গ ভাইদের পাশে থাকতে চায়। মনে রাখবেন, আশির দশকের মাঝামাঝি কিন্তু ক্রিকেটে বিশাল টাকা ঢোকেনি। তার ভিতরেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটারদের মধ্যে সম্ভবত সবচেয়ে কম টাকা পেত ওয়েস্ট ইন্ডিয়ানরা। তা সত্ত্বেও ভিভ মোটা অঙ্কের অফার কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছিল।
১৯৮৪ থেকে ১৯৯১ ওয়েস্ট ইন্ডিজ অধিনায়ক ছিল রিচার্ডস। নানা কারণে কাজটা কিন্তু খুব সহজ ছিল না। মাঝে মাঝেই টাকা নিয়ে ঝুটঝামেলা লেগেই থাকত। জামাইকা, বার্বেডোজ আর ত্রিনিদাদের মতো বড় দ্বীপগুলো সত্যি সত্যিই খেলাটাকে নিয়ন্ত্রণ করত।
এত বেশি সার্বভৌম দ্বীপ ব্যাপারটার সঙ্গে জড়িয়ে থাকায় টিমের মধ্যে সব সময়ই একটা অসন্তোষ ধিকধিক করে জ্বলত। রিচার্ডস যে ছোট্ট অ্যান্টিগার বাসিন্দা, টিমে সেখানকার প্রায় কেউই ছিল না। তার উপর ভারতীয় আর আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্লেয়ারদের মধ্যে আলাদা একটা টেনশনের চোরাস্রোত ছিল। এত কিছুর পরেও অধিনায়ক হিসেবে একটাও টেস্ট সিরিজ না হারার ঈর্ষণীয় রেকর্ড আছে ভিভের।
মাসাবার পাশে
ক্রিকেট নিয়ে যে কোনও রকমের আড্ডা দারুণ জমিয়ে দিতে পারত ভিভ। নিচু গলায়, কাটা-কাটা উচ্চারণে ক্রিকেট নিয়ে সারা রাত কথা বলে যেত। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, ভিভ কমেন্টেটর হতে পারল না। হয়তো লাইভ ম্যাচ নিয়ে কমেন্ট্রি করাটা ওর স্বভাবে ছিল না।
ক্লাইভ লয়েড যেমন কয়েক দিন কমেন্ট্রি করেও পরে সেটা ছেড়ে দেন, রিচার্ডসও তেমন পাব বা ফায়ারপ্লেস-এর পাশে বসে ক্রিকেট-আড্ডাটা বেশি উপভোগ করত।
ভিভের অন্যান্য প্রাপ্তি বলতে ১৯৭৭-এ উইজডেন বর্ষসেরা ক্রিকেটার হওয়া। ১৯৭৪ বিশ্বকাপের যোগ্যতা অর্জন পর্বে অ্যান্টিগার হয়ে ফুটবল খেলা। আর ওর সবচেয়ে খারাপ স্মৃতি বলতে ’৭৫-’৭৬-এর অস্ট্রেলিয়া সফর। যেখানে লিলি আর টমসনের বিধ্বংসী বোলিং-এর সামনে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ১-৫-এ হেরে গিয়েছিল। অবশ্য ভিভের কেরিয়ারের পরের পনেরোটা বছরে এ রকম ঘটনা আর কখনও হয়নি।
একটা ‘পুনশ্চ’ দিয়ে এ বারের লেখাটা শেষ করি।
কলকাতা। আশির দশকের শেষ দিক। ঠিকঠাক পোশাক পরেনি বলে ভিভকে একটা ক্লাবে ঢুকতে দেওয়া হয়নি। অনেক বছর বাদে ঘটনাটা নিয়ে ওর প্রতিক্রিয়া জানতে কথাটা তুলেছিলাম। তাতে ভিভ কী করল শুনবেন? শুধু মুচকি একটু হাসল।
সত্যি, মনে রাগ পুষে রাখার মতো মানুষই নয় ভিভ।
অনুবাদ: প্রিয়দর্শিনী রক্ষিত
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy