Advertisement
০২ মে ২০২৪
নাটক সমালোচনা ১...

তর্জনী গভীর অসুখের দিকে

মজিয়ে দেওয়া নয়, প্রতি মুহূর্তে জাগিয়ে রাখে ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’। লিখছেন আশিস পাঠক‘আমার যা-কিছু আছে, নাও। আমার সন্তানকে শুধু সন্তানের সুখ পেতে দাও।’ শাহজাহানের এই প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় স্বপ্নসন্ধানীর নাটক ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’। পঙ্ক্তি ক’টি অবধারিত ভাবে মনে করিয়ে দেয় শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’-র দু’টি লাইন, ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’ নাটকের উন্মোচনেই এ ভাবে, স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিছক শাহজাদা দারাশুকোর জীবনের গল্পই বলবে না এ নাটক, বরং এই সময়ের প্রেক্ষিতে সেই জীবনকে নতুন ভাবে দেখার একটা চেষ্টা থাকবে এখানে।

শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

‘আমার যা-কিছু আছে, নাও। আমার সন্তানকে শুধু সন্তানের সুখ পেতে দাও।’

শাহজাহানের এই প্রার্থনা দিয়ে শুরু হয় স্বপ্নসন্ধানীর নাটক ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’।

পঙ্ক্তি ক’টি অবধারিত ভাবে মনে করিয়ে দেয় শঙ্খ ঘোষের ‘বাবরের প্রার্থনা’-র দু’টি লাইন, ‘ধ্বংস করে দাও আমাকে যদি চাও। আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক।’

নাটকের উন্মোচনেই এ ভাবে, স্পষ্ট হয়ে ওঠে, নিছক শাহজাদা দারাশুকোর জীবনের গল্পই বলবে না এ নাটক, বরং এই সময়ের প্রেক্ষিতে সেই জীবনকে নতুন ভাবে দেখার একটা চেষ্টা থাকবে এখানে।

একুশটি দৃশ্যের এই মঞ্চায়নে একটি ঐতিহাসিক কাহিনির মধ্যে দর্শককে পুরো ডুবে যেতে কখনও দেন না নির্দেশক কৌশিক সেন। শাহজাহান, আওরঙ্গজেব, জাহানারা, দারা, নাদিরা, রওশনআরা, মুঘল সাম্রাজ্য, তার ক্ষমতা আর যৌনতা---সবে মিলে যে আবহ তৈরি হয় তা দর্শককে মজিয়ে রাখার পক্ষে যথেষ্ট। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে কৌশিক এ নাটকে বুঝিয়েছেন মজিয়ে দেওয়া নয়, জাগিয়ে রাখাটাই তাঁর উদ্দেশ্য।

নাটকে বার বার সেই জাগিয়ে রাখার কাজটা করে সঙের দল। ইতালীয় সাহেব মানুচ্চি আর কয়েক জন মহিলা নিয়ে এই দল বার বার ফিরে আসে অনেকটা সূত্রধরের মতো। আবার আর এক অর্থে এই সঙের দলই এ নাট্যের ভাষ্যকারও।

নাটককার এবং নাট্যকারের বক্তব্য সুনিপুণ শব্দে ব্যঙ্গের মোড়কে বলে দেয় সঙের দলের ওই সাহেবই। যেমন, বিরতির আশপাশে সঙের দলের এক মহিলা বলে, “এই কারণেই সব গপ্পে হাফটাইমই ভাল।” সাহেব তখন বলে, “কিন্তু জানো, হাফটাইমেই স্ট্র্যাটেজি পাল্টায়। সেকেন্ড হাফে সক্কলে ম্যাচ ছিনিয়ে নিতে চায়। ওই যে বললে রোলের কথা, রোলই তো আসল। কে কীরকম প্লে করছে, কে টানছে ঝোল তার উপরেই ডিপেন্ড করছে, কে জেতে, কে হারে।”

বোঝাই যায়, হিন্দুস্থানের বাদশা হওয়ার যে মুঘল যুদ্ধ আর অন্তর্ঘাত তাকে ভারতীয় ভোটের রাজনীতির সঙ্গে কোথাও মেলাতে চাইছেন নাট্যকার শ্রীজাত ও নির্দেশক কৌশিক সেন। বস্তুত, নাটকের স্মারক ফোল্ডারে সে কথা স্পষ্টই ঘোষিত।

নাটকের একেবারে শেষে সেই অভিপ্রায় আরও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়। সঙের দলের মহিলার প্রশ্নের উত্তরে সাহেব বলে ওঠে, “আঃ বলছি না পেটের জ্বালায় সং সেজেছি, সত্যি কি আর সাহেব? প্রশ্ন করে লাভ কী আমায়? উত্তর তো গায়েব। তার চেয়ে বরং সবাই মিলে ভোট জমিয়ে দে। কিন্তু তোদের পায়ে পড়ি, প্রশ্ন করিস নে।” এ কথা বলার পরেই মাইকে নির্বাচনের প্রচার চলে, সঙের দলের ম্যানেজার প্রবেশ করেন মঞ্চে।

প্রশ্নহীন আনুগত্যের নিরন্তর ঘুমের মধ্যে প্রশ্ন করা, জেগে থাকাটাই যে শিল্পীর ধর্ম, সে কথা কৌশিক তাঁর কোনও নাটকেই ভোলেন না। কিন্তু এ প্রশ্নও এখানে উঠতে পারে যে মঞ্চনাট্যও তো একটা ওপেন টেক্স্ট, তার ভাষ্য এবং ব্যাখ্যা যদি নাট্যেই অন্তর্গত হয়ে যায় তবে দর্শকের ভাবনার জন্য আর কী থাকে?

নির্বাচনী রাজনীতির প্রক্রিয়া এবং তার সমসাময়িক পচনের সঙ্গে মুঘল সাম্রাজ্যের ভিতরের গল্প মেলে নিশ্চয়ই, কিন্তু তার চেয়েও তো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়ল এ নাটক, লোকসভা নির্বাচনের সাম্প্রতিক ফলাফলের পরে।

এ নাটকের এক দৃশ্যে দারাশুকো বলে, “একটা মাত্র তখত, তাকে ঘিরে কোটি প্রাণহানি। এর মধ্যে কেমন করে খুঁজে পাবে আল্লার নিশানি? আমি তো বুঝি না ধর্ম, কাকে বলে সচ্চা মুসলমান... কেন উপনিষদের পাশাপাশি থাকবে না কুরান?” তাই কোথাও একটা ভয় হয়, নাটকে নাট্যকারের অতি প্রকট ব্যাখ্যা কোথাও দমবন্ধ করে দেবে না তো নাট্যপাঠের খোলামুখ বয়ানেরই?

শুরু থেকে শেষ এ নাটকের সংলাপে অন্ত্যমিলের একটা ধারা বজায় রেখেছেন নাটককার শ্রীজাত, অনেকটা সত্যজিৎ রায়ের ‘হীরক রাজার দেশ’-এর চিত্রনাট্যের মতো। শ্রীজাতর আশ্চর্য গভীর অথচ সহজ ভাষায় তার ফলে স্মরণীয় পঙ্ক্তিমালা তৈরি হয়েছে বেশ কিছু। যেমন, “নিজের ভিতরে ঢোকো আরও খুঁড়ে নামতে নামতে দেখবে জল আছে। যদি ভিজতে পারো জেনো সে নূরের বৃষ্টি, জেনো সে সৃষ্টির আদি জল...তোমার মতোই দেখতে তোমার ঈশ্বর অবিকল।”

কিন্তু এই কবিতার ধরনের জন্য বিপদও ঘটেছে একটা। বেশ কিছু গভীর দৃশ্যকে কেবল ওই অন্ত্যমিল লঘু করে দিয়েছে। হীরক রাজার দেশে-তে বিপদটা ঘটেনি, কারণ আদ্যন্ত হাসির একটা আবহ ছিল সে ছবির। কিন্তু মুঘল বাদশাহি মেজাজে ওই অন্ত্যমিলের খেলা অকারণ হাসির উদ্রেক করেছে কখনও কখনও।

অভিনয়ের ক্ষেত্রেও, বিশেষ করে শাজাহান এবং মিয়াঁ মীরে সিদ্ধার্থ বন্দ্যোপাধ্যায় এবং অশোক ঘোষের অভিনয় এতটাই লঘু, যে তা ফোটাতে পারেনি ওই দুই চরিত্রের গভীরতাকে। দারার ভূমিকায় কৌশিক চরিত্রটির বেদনা ও বিস্তার, ঐতিহ্য ও আধুনিকতা যথাযথ ফুটিয়ে তুলেছেন।

শ্রীকান্ত আচার্যের সঙ্গীত আবেগায়িত হওয়ার প্রলোভনকে জয় করেছে, এ ধরনের ঘটনাবহুল নাট্যে যে প্রলোভন জয় করা অনেক সময়ই সহজ হয় না। এ নাটকের সংযত এবং সংহত সঙ্গীতায়োজন মনে রাখার মতো। জয় সেনের আলো এবং সঞ্চয়ন ঘোষের মঞ্চ যথাযথ।

দুর্বলতাগুলি দিনে দিনে কেটে যাবে, পরবর্তী অভিনয় নিশ্চয় আরও পরিণত হবে। আপাতত ইতিহাসকে এই সময়ের প্রশ্নচিহ্নের মুখে দাঁড় করাতে পেরেছে ‘কর্কটক্রান্তির দেশ’, এটাই সাফল্য। এই পৃথিবীর গভীর, গভীরতর অসুখটার দিকেই তর্জনীনির্দেশ করেছেন কৌশিক। ২১ নম্বর দৃশ্যে জাহানারা সেটাই বলে, ‘এই তো তোমার প্রিয় মাটি গর্বে আর হতাশায় বুঁদ। আমরা ঠিক মাঝখানে হাঁটি ক্রান্তি শেষ হয়ে গেছে কর্কটের মেলেনি ওষুধ।’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

ashish pathak play natok
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE