Advertisement
১৭ মে ২০২৪
মনোরঞ্জন...

প্রথম বসন্ত

প্রথম প্রেমের সেই ভাললাগা আর মনখারাপের লাল-নীল রাংতাগুলো কি একই রকম আছে? লিখছেন শ্রীজাত“Love is a smoke and is made with the fume of sighs” রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর একেবারে গোড়ায় এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং শেক্সপিয়র। প্রেমকে ব্যাখ্যা করছেন দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তৈরি ধোঁয়া হিসেবে। শুধু প্রেম বললে ভুল হবে, প্রথম প্রেমকে। কারণ কে না জানে, রোমিও আর জুলিয়েটের মতো প্রথম প্রেমের নজির বিশ্বসাহিত্যে খুব কমই আছে। আর এও সকলেই জানে, শেক্সপিয়র খুব একটা ভুল বলেন না।

ফাইন্ডিং ফ্যানি

ফাইন্ডিং ফ্যানি

শেষ আপডেট: ০১ নভেম্বর ২০১৪ ০০:০০
Share: Save:

“Love is a smoke and is made with the fume of sighs”

রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’-এর একেবারে গোড়ায় এ কথা বলেছিলেন স্বয়ং শেক্সপিয়র।

প্রেমকে ব্যাখ্যা করছেন দীর্ঘশ্বাস দিয়ে তৈরি ধোঁয়া হিসেবে। শুধু প্রেম বললে ভুল হবে, প্রথম প্রেমকে। কারণ কে না জানে, রোমিও আর জুলিয়েটের মতো প্রথম প্রেমের নজির বিশ্বসাহিত্যে খুব কমই আছে। আর এও সকলেই জানে, শেক্সপিয়র খুব একটা ভুল বলেন না।

প্রথম প্রেম। শব্দবন্ধটা শুনলেই একটা চমৎকার ঘুমভাঙা সকাল, একটা পাটভাঙা জামার খসখসে মিঠে গন্ধ, একটা হাতে-লেখা চিঠির সারপ্রাইজ ভিজিট।

প্রথম প্রেম ভাবলেই একখানা অপার্থিব মুখ, যার দিকে তাকিয়ে থাকাই জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য, দুটো আশ্চর্য হাত, যার মুঠোর ভেতরে পৃথিবীর সেরা নিশ্চয়তা লুকনো, আর একটা অলীক কণ্ঠস্বর, কেবল যেটার জন্যই আমার নামটা রাখা হয়েছিল কখনও।

আমাদের প্রত্যেকের এমন মজে থাকার দিন এসেছে নিঃসন্দেহে। আজ যারা বড় হচ্ছে, কৈশোর পেরিয়ে যৌবন ছুঁইছুঁই করছে, তাদের জানলাতেও এখন সারা বছর সরস্বতী পুজোর মিহি রোদ্দুর।

তাদের উস্কোখুস্কো চুলে সারাদিন ধুলোর ছদ্মবেশে গোলাপি আবির। কারণ আর কিছুই নয়, তারা জীবনে প্রথমবার প্রেমে পড়েছে। এই প্রথম, পৃথিবীটাকে দিব্যি একটা গ্রহ বলে মনে হতে শুরু করেছে তাদের।

পরে, মানে, একটু কড়া রোদের রাস্তা পেরিয়ে আসতে আসতে আমাদের অনেকেরই মনে হয়েছে, প্রথম প্রেম নিয়ে এত উচ্ছ্বসিত থাকে কেন মানুষ? কেন অনেক সম্পর্কের আগুনে জল পড়লেও প্রথম প্রেমের আঁচটা সে জিইয়ে রাখে কোথাও?

উত্তরটাও হয়তো ওই শব্দবন্ধের মধ্যেই লুকিয়ে আছে। ‘প্রথম’। যা কিছু প্রথম, তাকেই আমরা সবচাইতে কাছের করে নিই। আর যদি সে চলেও যায়, তবে যাওয়ার সময় দিয়ে যায় অনেক কিছু। চলে যাওয়ার যন্ত্রণাটা কেটে গিয়েও যেগুলো হাতের মুঠোয় ঝিনুকের মতো পড়ে থাকে।

মনে পড়ে, আবারও, আশিতে পা-দেওয়া সেই তরুণের কথা, প্রথম প্রেম নিয়ে প্রশ্ন করলে যিনি জানলার বাইরে তাকিয়ে একটু মুচকি হেসে উত্তর দিতেন, “হুঁ হুঁ, সে ওই কবিতাই।”

হ্যাঁ, কবিতাই তো। সারা জীবন এই পরিমাণ গদ্য লিখেও নিজের কবিসত্তাকেই চালকের আসনে বসিয়ে রেখেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর প্রথম প্রেম তো কবিতাই হওয়ার কথা।

যেমন গিটার আজও কবীর সুমনের প্রেমের রাজধানী। সেটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু রক্তমাংসের প্রেম? সে বড় স্মৃতির উপশম, সে নেহাত মিঠে জখম।

আমরা কে না জানি মার্গারিটের কথা? আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক লেখক কর্মশালায় এক বছর থাকার সুবাদে সেই ফরাসি তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল দুর্দান্ত যুবক সুনীলের। সে-কথা সুনীলদাই পরে লিখেছেন বহু জায়গায়। পরস্পরকে ভালবেসে ফেলেছিলেন তাঁরা। কিন্তু একসঙ্গে থাকা হয়নি বাস্তবিক কারণে। থাকা হয়নি মানুষদুটোর। কিন্তু ভালবাসাটা ছিল।

স্বাতীদির মতো একজন মানুষকে পাশে পাওয়ার পর আক্ষেপগুলো উবে যায়। কিন্তু স্মৃতির একটা ছোট্ট ব্যালকনি তো থাকেই সবার ভেতর, একেকটা একলা বিকেলে যেখানে কফির কাপ হাতে সামান্য সময় দাঁড়ানো যায়। ওই ব্যালকনিটার ডাকনামই প্রথম প্রেম।

বারবার স্মৃতির কথা চলে আসছে, কারণ পৃথিবীর অধিকাংশ প্রথম প্রেমই শেষমেশ ভেঙে যায়। চূড়ান্ত কাছে আসার সুগন্ধ নিয়ে ছিটকে দূরে চলে যায় হঠাৎ।

সম্পর্ক তো একটা সেতু, তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে পরিণত মনের দরকার পড়ে। প্রথম প্রেমের সময় সেই পরিণতি হয়তো থাকে না, কিন্তু যে-উদ্যম, যে-তীব্রতা, যে-আগুন থাকে প্রথম প্রেমে, তা ওই কম বয়েসেই আসতে পারে হয়তো। ফুল তুলে আনা আর গাছে জল দেওয়ার মধ্যে যে তফাত, প্রথম প্রেম আর স্থায়ী সম্পর্কের মধ্যেও সেটাই পার্থক্য।

সেই সুনীলই যখন ‘প্রথম আলো’ লিখছেন, তখন তার পাতায় পাতায় উঠে আসছে কাদম্বরী দেবীর প্রতি রবিঠাকুরের অন্ধ মুগ্ধতা আর নির্ভরতার কথা।

বৌঠানের অকালপ্রয়াণের পর রবির হাজারো লেখায় তাঁর ছায়ার ফিরে ফিরে আসার কথা। তার পরেও রবীন্দ্রনাথ ভালবেসেছেন, আর সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অত গভীর ছায়া আর কোনও সম্পর্ক ফেলতে পেরেছে কি? সম্ভবত পারেনি। আর তার কারণও হয়তো এই যে সেই মানুষটিই রবির জীবনের প্রথম ছায়া, প্রথম আড়াল।

প্রেম নামের শব্দটাকে আমরা কখনও সখনও বড্ড একপেশে করে দেখি। তাকে একটু ছড়িয়ে বসতে দিলে সে কিন্তু আমাদের অনেক গল্প বলতে পারে।

প্রথম প্রেম নিয়ে লেখেননি এমন কবি মেলা ভার, প্রথম প্রেমের ছবি আঁকেননি এমন চিত্রকরও দুর্লভ। প্রথম প্রেমকে সকলেই প্রকাশ করতে চেয়েছেন কোনও না কোনও ভাবে।

আবার এ কথাও ঠিক, একটা সময় পেরিয়ে যাবার পর, সেই প্রথম প্রেমকেই আগলে, আড়াল করে, লুকিয়ে রাখতেও চেয়েছেন। ঠিক যেমন শঙ্খ ঘোষ লেখেন, “আমার অন্য একটি পাখি, কেবল আড়াল করে রাখি” ... প্রথম প্রেম আমাদের সেই অন্য একটি পাখিই যেন।

শিল্পীদের একটা সুবিধে আছে, তারা যেটুকু আড়াল করবার, সেটুকু লুকিয়ে রেখে বাকিটা প্রকাশ করে ফেলতে পারেন। এতে শ্যামও থাকল, কুলও গেল না। কিন্তু বাকিদের কষ্ট বোধহয় আরও বেশি।

খুব কাছের কোনও বন্ধুর কাঁধে এক সন্ধেবেলা মাথা রেখে কেঁদে ফেলা ছাড়া আর রাস্তা নেই কোনও। কারণ প্রথম প্রেমই তো সে, যার কাছে আমার সব কথা সব গোপনীয়তা এক লহমায় উজাড় করে দিয়েছি আমি। যার কাছে হেসে উঠতে দ্বিধা করিনি, কেঁদে ফেলতেও নয়। তাই প্রথম প্রেমের পোশাক ছেড়ে মানুষটি বেরিয়ে গেলেও, সেই পোশাকটা আমাদের গোপন দেরাজে থাকে।

আমরা মাঝেমধ্যে সেটা বার করে পরে দেখি, গন্ধ শুঁকি, আবার দেরাজে তুলে রেখে দিই। মানুষটি তখন আর জরুরি নয় তেমন, তার সঙ্গে পোহানো সম্পর্কের রোদ্দুরটুকুই আসল। তাই প্রথম প্রেম, সেই অর্থে দেখতে গেলে আমাদের প্রথম বন্ধুও বটে।

হ্যাঁ, ভেঙে যাওয়া প্রথম প্রেমের কথাই বলছি। ট্র্যাজিডি। মানুষ তো আজীবন ট্র্যাজিডিকেই সেলিব্রেট করেছে। কী শিল্পে, কী জীবনে। যা জীবনে সফল, স্মৃতিতে বা শিল্পে তার দাম মেলেনি। তাই ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ থেকে ‘কয়ামত সে কয়ামত তক’ আমরা মেতে থেকেছি বিচ্ছেদের আরাধনায়। পথ যেখানে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেখান থেকেই তো রাস্তা শুরু।

আজকের প্রথম প্রেম ঠিক কেমন? যুগের সঙ্গে কি অনুভূতি পাল্টায়?

না বোধহয়। তার প্রকাশ পাল্টাতে পারে। সুমনদা লিখেছিলেন, “প্রথম প্রেম ঘুচে যাওয়ার যন্ত্রণাকে নিয়ে, কান্না চেপে ঘুরেছিলাম তোমারই পথ দিয়ে”। একশোয় দেড়শো এই লাইনটা।

এমন সন্ধে আমরা কেইবা কাটায়নি? সেই মেয়েটির বা সেই ছেলেটির নাম এখন বলতে চাইব না কেউই, কিন্তু তার পর্দা টানা জানলার দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে সন্ধেবেলার কত পথ পেরিয়ে এসেছি আমরা। আজও কি তাই হয়?

টিভির বিজ্ঞাপন বলে, প্রেম ভেঙেছে তো কী হয়েছে, মুভ অন। সময়টাকে কব্জিতে বেঁধে রাখো। আর ‘চন্দ্রবিন্দু’ বলে, “যদি বলো আড়ি, তোমাকেও ছেড়ে যেতে পারি”।

হ্যা,ঁ বিষাদের উদ্যাপনের জায়গায় হয়তো বেপরোয়া হাইওয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু সেই সব প্রথমবারের মনে-হওয়াগুলো? সেই ভাললাগা আর মনখারাপের লাল-নীল রাংতাগুলো? সেই কেড়ে নেওয়া আর সঁপে দেওয়ার লুকোচুরি বিকেলগুলো? সেগুলো একই রকম আছে তো? আর ভেঙে যাওয়ার পর পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ, সেটা আজও শোনা যায় নিশ্চয়ই?

ব্যস, তা হলেই হল। বাকিটা তো মোড়ক। সময়ের সঙ্গে বদলাবেই। রবিঠাকুরের গল্প তো সবাই জানে। আমি একজনকে চিনতাম, রতনদা। আমাদের পাশের পাড়ায় থাকত, রোজ কাগজে বিজ্ঞাপন দেখে পোস্টাপিসে গিয়ে চাকরির দরখাস্ত ফেলে আসত ডাকবাক্সে। এই ছিল তার কাজ।

চল্লিশ পেরিয়ে যাওয়া রতনদার কোনও উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল না। বরং আকাঙ্ক্ষা ছিল এককালে, একজনের জন্য। সেটা পূর্ণ হয়নি বলেই রতনদা আর নিজেকে নিয়ে এগোয়নি কোনও দিকে।

না-পাওয়া মেয়েটির জন্য অপেক্ষা করেছে সারাজীবন, যে ভাবে ফ্যানির জন্য এই তো সেদিন অপেক্ষা করেছিলেন নাসির। রতনদা’র ক্ষেত্রে তফাত একটাই, সে জানত, মেয়েটি কোনও দিন ফিরবে না। কিন্তু জানা আর মানা, মানে মেনে নেওয়ার মধ্যে পৃথিবী আর চাঁদের দূরত্ব।

সেই নির্বিরোধী, প্রায় নিষ্প্রাণ রতনদা একবার খুব খেপে গেল। দাদা-বৌদির সংসারে থাকা রতনদার গলার অত জোর আওয়াজ কেউ কথনও শোনেনি।

খেপল কেন? না, তার বৌদি পুরনো আলমারি ঘেঁটে রতনদার একটা রং-উঠে-যাওয়া শার্ট বাসনওয়ালিকে দিয়ে দিয়েছে। আমরা তো অবাক।

আলাভোলা রতনদা একটা বাতিল শার্টের জন্য এরকম মরিয়া হয়ে উঠবে, এটা ভাবা যায় না।

পরে, অনেক পরে শম্ভুর চা-দোকানের সান্ধ্য আড্ডায় রতনদাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম কথাটা। কিছুক্ষণ ইতস্তত করে আমায় বলল, “তুই তো কবিতা-টবিতা লিখিস, তুই হয়তো বুঝবি। ওই শার্টের পকেটে ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের দুটো টিকিট ছিল। ওই একদিন আমরা ময়দানে গেসলাম তো, ফেরার পথে...। শার্টটা গেছে যাক, টিকিটদুটো...।”

আমি সেদিন সন্ধেবেলা একটা নিভে যাওয়া—প্রথম-প্রেমের ধোঁয়া দেখতে পেলাম। যেটা আপাতদৃষ্টিতে রতনদার আঙুলের ফাঁকে ধরা চায়ের গেলাস থেকে উঠছে ঠিকই, কিন্তু তৈরি হয়েছে বহু বছরের জমে থাকা দীর্ঘশ্বাস দিয়ে।

একজন মাঝবয়েসি ব্যর্থ মানুষের দীর্ঘশ্বাস, যার কাছে প্রথম প্রেমের গন্ধ মানে আবছা হয়ে আসা দুটো টিকিট, ট্রামের সেকেন্ড ক্লাসের।

আমাদের সবার বাতিল শার্টের পকেটে এই রকম কোনও না কোনও আবছা টিকিট সন্তর্পণে জমানো আছে। আমরা আদর করে তাদের ডাকনাম দিয়েছি, প্রথম প্রেম।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

love at first sight finding fanny
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE