Advertisement
০৭ মে ২০২৪
শনিবারের নিবন্ধ ২

ভোটরঙ্গ ২০১৪

প্রচারে কী না হয়! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।ভোট প্রচার মানেই, তু তু ম্যায় ম্যায়। কিন্তু ভারতের মতো এমন বিশাল বৈচিত্রের দেশে ভোটরঙ্গের সত্যিই শেষ নেই। প্রচারে কী না হয়! লিখছেন জয়ন্ত ঘোষাল।

অলংকরণ: সুমন চৌধুরী।

অলংকরণ: সুমন চৌধুরী।

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৪ ০০:০১
Share: Save:

বিশ্বনাথ প্রতাপ সিংহ তখন প্রধানমন্ত্রী। তখনকার উপপ্রধানমন্ত্রী দেবীলালের ছেলে ওমপ্রকাশ চৌটালা হরিয়ানার মুখ্যমন্ত্রী।

সেই চৌটালার বিধানসভা নির্বাচন কেন্দ্র মাহেমে সে বার ব্যাপক সন্ত্রাস এবং রিগিং।

রোহতক জেলার ওই গ্রামীণ এলাকাটিতে গণতন্ত্রের করুণ পরিস্থিতি দেখে হাতে গোনা কয়েকজন সাংবাদিক হাজির দেবীলালের দরবারে। “আপনার ছেলে রিগিং করেছেন। নিউজপেপারের সমস্ত লোক দেখেছে। আমরা সে সব কথা কাগজে লিখব।”

খাটিয়ায় শুয়েছিলেন দেবীলাল। দূরে দেখা যাচ্ছে তার অত্যাধুনিক শীতাতপনিয়ন্ত্রিত গোশালা। মাঝে মাঝে ও দিক থেকে হাম্বা ডাক ভেসে আসছে। পাশে রাখা সেই সময়কার আধুনিক দূরভাষ যন্ত্রটি হাতে নিয়ে ছেলের ভোটের খবর নিচ্ছেন দেবীলাল।

সাংবাদিকদের প্রশ্নে প্রবীণ মানুষটি অবিচলিত ভঙ্গিতে বললেন, “ইয়ে নিউজপেপার কেয়া হোতা হ্যায়?” শুনে সবাই একটু হতভম্ব।

পরক্ষণেই দ্বিতীয়বার প্রবীণের গলা শোনা গেল, “ম্যায় চৌধুরী দেবীলাল, সুবহা উঠকে হরিয়ানা মে যো বাতাতা হুঁ, ওঁহি ইঁহাকা নিউজপেপার হ্যায়। যো মর্জি লিখিয়ে। মেরা বেটা জিতেগা।” সকালে উঠে উনি হরিয়ানায় যা বলেন, সেটাই নিউজপেপার, এ বার যা ইচ্ছে লিখুক কাগজওয়ালা। জিতবে চৌটালাই।

অনেকগুলি বছর কেটে গিয়েছে। এর মধ্যে ভারতীয় নির্বাচনী গণতন্ত্র অনেক পরিবর্তনের সাক্ষী। কিন্তু ভোটরঙ্গ আজও বৃহত্তম গণতন্ত্রে ভরপুর রাজ করছে।

এ বার নির্বাচনী প্রচার কিছু দিন গড়াতেই গলা ভেঙে গিয়েছিল নরেন্দ্র মোদীর। প্রতিদিন চার্র্টার্ড বিমানে চেপে কলকাতা থেকে কোয়েম্বাত্তর, অমৃতসর থেকে আন্দামানকোথায় না যাননি তিনি! কিন্তু যেখানেই যান, চেষ্টা থাকত রাতের মধ্যেই গাঁধীনগরে ফিরে আসার।

নিজের ঘরে বিছানায় যাওয়ার আগে নিয়ম করে গার্গল করেন আয়ুর্বেদিক ওষুধ দিয়ে। গলা নিয়ে বিব্রত নরেন্দ্র প্রায়ই বলছিলেন, “এবারের ভোটে আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ শেষ দিন পর্যন্ত গলাটাকে ঠিক রাখা।”

এ দিকে মোদীর প্রতিদ্বন্দ্বী কেজরিওয়াল প্রচারে গিয়ে কিন্তু নরেন্দ্রর ভাঙা গলা নিয়েও ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি। বারাণসীতে ‘আপ’-এর স্লোগানই ছিল ‘সামাল নেহি পা রাহে হ্যায় খাসি কো, ক্যায়সে জিতেঙ্গে কাশীকো!’ কাশিকেই সামলাতে পারছে না, তো কাশী জিতবে কী করে!

ভোট প্রচার মানেই, তু তু ম্যায় ম্যায়। সেখানে এ বার ব্যক্তিগত আক্রমণে যাঁরা তিতিবিরক্ত হয়ে পড়েছেন তাঁদের একজন অবশ্যই প্রিয়ঙ্কা গাঁধী। দাদার জন্য যখনই তিনি সক্রিয় হতে চেয়েছেন তখনই বিজেপি আক্রমণ শানিয়েছে তাঁর স্বামী রবার্ট বডেঢ়ার দিকে। অভিযোগ জমি কেলেঙ্কারির।

মাঝখানে একটা সময় তো দিল্লির মসনদে গুজবের ঠেলায় কান পাতা দায় ছিল। হঠাত্‌ শোনা গেল, প্রিয়ঙ্কা-রবার্টের বিবাহ-বিচ্ছেদ হতে চলেছে। ভোটের ফল বেরোনোর আগেই রবার্টকে পাঠিয়ে দেওয়া হবে দুবাই।

লাগাতার এই রটনায় নাকি ধৈর্যর সীমা ছাড়ায় প্রিয়ঙ্কার। একদিন রবার্টকে নিয়ে সোজা হাজির হয়ে যান খান মার্কেটে মধ্যাহ্নভোজনে। মামাগোটো নামের সেই রেস্তোরাঁয় টেবিল বুক করা ছিল রবার্টেরই নামে।

রবার্ট যদিও দিল্লির বিভিন্ন পাঁচ তারা হোটেলে অনেক সময়ই বিকেলের দিকে কফি খেতে যান, কিন্তু এ সব ক্ষেত্রে প্রিয়ঙ্কার সঙ্গে কখনও তাঁকে দেখা যেত না। কিন্তু খান মার্কেটে মধ্যাহ্নভোজন শুধু নয়, ওবেরয় হোটেলের ইতালিয়ান রেস্তোরাঁয় এক সন্ধ্যায় রবার্ট এসে, ১৬ জনের জন্য টেবিল সাজানোর তদারকিও করলেন। কী ধরনের ওয়াইন খাওয়া হবে, বেছে দিলেন। কিছু পরে প্রিয়ঙ্কাও তাঁর কিছু বন্ধুকে নিয়ে সামিল হলেন। ১৬ জন মিলে নৈশভোজের পার্টি।

ভোটের সময়, পাবলিক প্লেসে কেন এই ধরনের নৈশভোজ? সবাই বলছে, ক্ষুব্ধ প্রিয়ঙ্কা গোটা দুনিয়ার কাছে দেখাতে চাইছিলেন, রবার্টের সঙ্গে তাঁর সম্পর্কে কোনও অধঃপতন হয়নি।

ভোটরঙ্গের আরও দু’টি বড় খবর দাম্পত্য নিয়ে। ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন আলো ফেলল দুই হেভিওয়েট পুরুষের ব্যক্তিজীবনেও।

প্রথম জন, নরেন্দ্র মোদী। তাঁর ছিল বাল্যবিবাহ। কিন্তু দিগ্বিজয় সিংহ আর কংগ্রেস নেতারা তাঁর বিরুদ্ধে এমন প্রচার চালালেন যে মোদীর স্ত্রী যশোদাবেনকে সাক্ষাত্‌কার দিয়ে জানাতে হয়েছে যে তিনি আজও পতিব্রতা।

শুধু তাই নয়, পতির কল্যাণ কামনা করে চারধাম দর্শনে গিয়েছিলেন তিনি। নির্বাচনের মাঝপথেই মোদীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে শোনা যাচ্ছিল যে, প্রধানমন্ত্রী হলে তিনি স্ত্রীকে ৭ নম্বর রেসকোর্স রোডে নিয়ে আসবেন। সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি ভবনের দরবার হলে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানেও তাঁকে দেখা যাবে কিনা তা নিয়ে চলছে জোর আলোচনা।

অন্য জন দিগ্বিজয় সিংহ। এখানে মহিলা চরিত্র সাংবাদিক অমৃতা রাই। দিগ্বিজয়ের স্ত্রী মারা গিয়েছেন বছর খানেক আগে। অমৃতার অধ্যাপক স্বামীর সঙ্গে বিবাহবিচ্ছেদের মামলা চলছে। এরই মাঝে দিগ্বিজয় এবং অমৃতার ঘনিষ্ঠ রঙিন ছবি সোশ্যাল মিডিয়ায় চলে এল। এর পর দিগ্বিজয়কে এই সম্পর্ক স্বীকার করতেই হয়েছে। তিনি বিয়ে করার আশ্বাস দিয়েছেন অমৃতাকে।

এ দিকে দিগ্বিরাজার ছেলেমেয়েরা বেঁকে বসেছেন। তাঁরা অত সহজে ঘটনাটিকে মিলনান্তক অ্যাখ্যানে পরিণত করতে রাজি নন।

প্রশ্ন করলে দিগ্বিজয় অবশ্য বললেন, “আমরা যতই পাবলিক ফিগার হই না কেন, ব্যক্তিগত জীবন তো থাকতেই পারে।”

এ বারের ভোট প্রচারে উপেক্ষিত নায়ক লালকৃষ্ণ আডবাণী। মোদীর দাপটে এবার তাঁর ‘পপুলার ডিমান্ড’ ছিল না। তবু গাঁধীনগরে আডবাণীর জন্য প্রচার করতে নেমেছিলেন তাঁর ছেলে জয়ন্ত আর মেয়ে প্রতিভা।

গত বারের নির্বাচনী প্রচারে আডবাণী ছিলেন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী। বিহারে এক প্রত্যন্ত গ্রামে আডবাণী মেয়েকে প্রচারে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেই প্রচার-সফরে সাংবাদিক হিসেবে সঙ্গী ছিল এই প্রতিবেদকও। ভোটরঙ্গ এ বার সেই সফর ঘিরেই।

হেলিপ্যাডে তো নামা হল। শুরুতেই তাড়াহুড়ো করে নামতে গেলেন আডবাণী-কন্যা প্রতিভা। গ্রামের হেলিপ্যাড। গোবর দিয়ে লেপে তৈরি। কিন্তু তখনও তার প্রলেপ বেশ কাঁচা। হাই হিল জুতো পরে প্রতিভা পিছলে পড়ে গেলেন সেই নরম আস্তরণে!

আডবাণীর আগমন-বার্তা শুনে স্থানীয় নেতারা হেঁটে হেঁটে আসছিলেন হেলিপ্যাডের দিকে, দূর থেকে তাঁরা সেই পতন দেখে গতি বাড়ালেন। ততক্ষণে অবশ্য প্রতিভা উঠে পড়েছেন। কিন্তু জামায় যে গোবর লেগে!

ফেরার সময় হেলিকপ্টার যখন উড়ান দিল, তখন এত প্রবল গোবরের গন্ধ যে গোলাপের রুম ফ্রেশনার বারবার নিজের জামাতে স্প্রে করতে লাগলেন অসহায় প্রতিভা। সেই গন্ধমাদনে সঙ্গী অন্যদের অবস্থা তখন স্বভাবতই কহতব্য নয়।

ভারতের মতো এমন বিশাল বৈচিত্রের দেশে ভোটরঙ্গের সত্যিই শেষ নেই। অমৃতসরে যেমন ওয়াশিং মেশিনে লস্যি বানানোর দৃশ্য দেখে তাজ্জব অরুণ জেটলি। শহুরে অভিজাত দুঁদে আইনজীবী জীবনে পঞ্জাবি লস্যি অনেক খেয়েছেন। স্টিলের গ্লাসে। তা বলে ওয়াশিং মেশিনে তৈরি লস্যি! কস্মিনকালেও এমনটা দেখা তো দূরঅস্ত, শোনেনওনি তিনি। অমৃতসরেই প্রথম বার জেটলি দর্শন পেলেন এক অবাক পৃথিবীর। এও তো ভোটের দান।

বিস্ময়ের এখানেই শেষ নয়। লস্যির পর মোষ।

পঞ্জাবের গ্রাম। সেখানে হৃষ্টপুষ্ট মোষগুলো এত চকচকে কুচকুচে কালো, দেখলেই তাজ্জব লাগে।

উপস্থিত বহিরাগতদের প্রশ্নের মুখে পড়ে মোষ-রহস্য ফাঁস করলেন রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ক্যাপ্টেন অমরিন্দর সিংহ। তাঁর মুখে শোনা গেল, এই মোষগুলির যাঁরা মালিক, তাঁরা নিয়মিত ‘হেয়ার ডাই’ দিয়ে মোষের গায়ের রঙ অমন কালো রাখে। কেননা এই মোষগুলিকে যে প্রদর্শনীতে পাঠানো হয়!

অমৃতসরের র‌্যাডিসন হোটেলে লবিতে হঠাত্‌ দেখা ক্রিকেটার বিষেন বেদীর সঙ্গে। তিনি এসেছেন ক্যাপ্টেনের হয়ে প্রচার করতে। এও তো ভোটরঙ্গেরই অঙ্গ! বিসিসিআই-এর রাজনীতি লোকসভার গোলকে। অরুণ জেটলির উপর ক্ষুব্ধ বেদির ধনুর্ভঙ্গ পণ, হারাতেই হবে বিজেপি-র এই হেভিওয়েট প্রার্থীকে।

এই বিবিধ ভোটরঙ্গে সব সংঘাতের পরেও সৌজন্যের রাজনীতিও কিন্তু বেঁচে রয়েছে। যেমনটা দেখা গেল অটলবিহারী বাজপেয়ির সঙ্গিনী শ্রীমতী কাউলের মৃত্যুর পর। সনিয়া গাঁধী একান্তে অসুস্থ বাজপেয়ীজিকে দেখে এলেন। ভোটের প্রচার ছেড়ে শ্মশানে হাজির হলেন আডবাণী, রাজনাথ, অরুণ জেটলি, সুষমা স্বরাজ থেকে কংগ্রেসেরও প্রায় সব নেতা।

যদিও সেরিব্রাল স্ট্রোকে আক্রান্ত বাজপেয়ী এখনও জানেন না যে কাউল মৃত!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

jayanta ghosal vote 2014
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE