Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মা বোনেরা ভাল আছেন তো সব...

বেতার তরঙ্গে ঈষৎ ভারী নারীকণ্ঠে ঘোষণা। তার পরই শুরু হত মহিলামহল।... অন্দরের গল্প বললেন জগন্নাথ বসু। শুনলেন দেবশঙ্কর মুখোপাধ্যায়মুজতবা আলীর কথাটা প্রায় বোমার মতো আছড়ে পড়েছিল সে দিন—‘‘আচ্ছা, এই যে মহিলা মহল-এ এত খাবারদাবারের কথা বলা হয়, আমি একজনকে রান্না করে দেখতে বললাম। তাতে যা দাঁড়াল, মনে হল, এগুলো সত্যিই খাবার যোগ্য তো? মনে তো হয় না।’’ ঘটনাটা সাহিত্যিক কবিতা সিংহের কাছে শোনা। কবিতাদি তখন রেডিয়ো-য়। মুজতবা আলী স্টেশন ডিরেক্টর। বেলা দে তত দিনে মহিলা মহল-এর সর্বেসর্বা। অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে।

শেষ আপডেট: ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১৫ ০০:০৪
Share: Save:

মুজতবা আলীর কথাটা প্রায় বোমার মতো আছড়ে পড়েছিল সে দিন—

‘‘আচ্ছা, এই যে মহিলা মহল-এ এত খাবারদাবারের কথা বলা হয়, আমি একজনকে রান্না করে দেখতে বললাম। তাতে যা দাঁড়াল, মনে হল, এগুলো সত্যিই খাবার যোগ্য তো? মনে তো হয় না।’’

ঘটনাটা সাহিত্যিক কবিতা সিংহের কাছে শোনা। কবিতাদি তখন রেডিয়ো-য়। মুজতবা আলী স্টেশন ডিরেক্টর। বেলা দে তত দিনে মহিলা মহল-এর সর্বেসর্বা। অনুষ্ঠানের জনপ্রিয়তা ক্রমেই বাড়ছে। বিশেষ করে বেলা দে-র দেওয়া রান্নাবান্নার প্রণালী, আজকের ভাষায় ‘হটকেক’।— ‘‘ডুমো ডুমো করে আলুটা কাটুন। তারপর জিরি জিরি করে লঙ্কা ছড়িয়ে দিন....।’’

রান্নার রেসিপি নিয়ে আজকে যা হইচই, তার এক আনাও তখন ছিল না, তার ওপর অত ঘরোয়া ভাষা। আমি বহু বাড়ির মা-ঠাকুমাদের দেখতাম, উল-কাঁটা, সেলাইবোনা, হাতের কাজ ফেলে ঝড়ের গতিতে শুধু বেলাদির বলে যাওয়া রান্নাটা ডায়েরিতে টুকে রাখছেন।

তো, সে দিন সভা চলছিল। সিরিয়াস মিটিং। উপস্থিত অনেকের মধ্যে বেলাদিও আছেন। তার মধ্যেই মুজতবা আলী তাঁর স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ছদ্ম গাম্ভীর্য-মাখা গলায় ‘বোমা’টা ফাটালেন।

প্রথমে কারও বোধগম্য হয়নি, এত জনপ্রিয় অনুষ্ঠান নিয়ে কী বলছেন আলী সাহেব? তারপর যখন আবিষ্কৃত হল, এ নিছকই ঠাট্টা, তুমুল হাসিতে ফেটে পড়েছিল সভাঘর। তাতে যোগ দিয়েছিলেন বেলাদিও।

মহিলা মহল-এর কথা বলতে বসে এই যে মুখরাতেই বেলাদি-র প্রসঙ্গ চলে এল, এটা কিন্তু একরকম অনিবার্য।

বেলা দে, নীলিমা সান্যাল ও ইন্দিরা দেবী। বেতারের তিন মহিলার ছবি: পরিমল গোস্বামী

’৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে ‘মহিলামহল’ সম্প্রচার শুরু হওয়ার বেশ ক’বছর বাদে ওঁর দায়িত্বে আসা। তারপর নাগাড়ে টানা তিরিশ বছর মনপ্রাণ দিয়ে কাজটা করে গিয়েছেন। যার ফলে একটা সময়ের পরে বেলাদি আর ‘মহিলামহল’ দুটো নাম একেবারে সমার্থক হয়ে দাঁড়ায়।

দুপুর মানেই ‘মহিলামহল’ আর বেলা দে। সে শিরশিরে শীত, গনগনে গ্রীষ্ম, ঝমঝমে বর্ষা... যাই-ই হোক না কেন।

ষাট, সত্তর, আশির দশক-এর ঘরণিরা আজও মনে রেখেছেন সেই সব দিনগুলি—

‘‘আকাশবাণী কলকাতা। এখন আরম্ভ হচ্ছে মহিলামহল। আসর পরিচালনা করছেন বেলা দে।’’

তারপর মিউজিক...‘‘সঙ্কোচের বিহ্বলতা নিজেরে অপমান/সংকটের কল্পনাতে হোয়ো না ম্রিয়মাণ...’’

মিউজিক শেষ হলেই ভেসে আসত ঈষৎ ভারী নারীকণ্ঠ—

‘‘মা-বোনেরা ভালো আছেন তো সব? আমাদের আজকের অনুষ্ঠানে প্রথমে আছে সতীকথা, তারপর গান, তারপর নতুন মায়েদের প্রতি কয়েকটি উপদেশ। তাছাড়া সেলাই, রান্নাবান্না তো আছেই...।

সতীকথা-য় থাকত ধর্মীয় গল্প। কোনও সময়ে এ ভাবেই অনুষ্ঠানে জুড়ে যেত স্বাস্থ্য, আইন, ঘরসাজানো কী সাম্প্রতিক কোনও বিষয় নিয়ে নানা রকম কথাবার্তা, গুণী মানুষের সঙ্গে আলাপ।

যদ্দুর জানি, শুরু থেকেই কাঠামোটা ছিল প্রায় একই রকম। কে যে তৈরি করেছিলেন, বলাটা খুব শক্ত। আসলে স্বাধীনতা পরবর্তী যুগে আকাশবাণীর ভূমিকা অনেকটাই ছিল সমাজসংস্কারকের। তাকে মাথায় রেখে যাঁরা অনুষ্ঠান নির্ধারণ করতেন, তাঁরা এক একজন অসম্ভব প্রতিভাধর মানুষ।

যাঁদের কয়েক জনের নাম তো সবাই জানেন... বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, বাণীকুমার, পঙ্কজ কুমার মল্লিক। কিন্তু এঁরা ছাড়াও রেডিয়োয় ছিলেন যাঁরা, তাঁরা হলেন সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, লীলা মজুমদার, বেতার-অনুষ্ঠানের নামজাদা কর্তা নৃপেন মজুমদার, চিত্র পরিচালক প্রভাত মুখোপাধ্যায়, অভিনেতা বিকাশ রায়...।

এই মাপেরই সব মানুষের ভাবনার ফসল ওই ‘মহিলামহল’। ফরম্যাটটাও নির্ঘাত ওদেরই। কিন্তু বেলাদির জমানার মতো অনুষ্টানটি নিয়ে আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা আর কে দিতে পেরেছেন, সত্যিই আমার অন্তত জানা নেই।

গোড়ার দিকে একে একে দায়িত্বে এসেছেন মল্লিকা ঘোষ, নূরজাহান বেগ, মাধুরী বসু, রেখাদেবী...। রেখাদেবী দিল্লি চলে যাওয়ার পর দায়িত্বে আসেন বেলাদি।

বেলাদির সমসাময়িক মহিলামহল-এর আরও তিন জনের কথা বলতে পারি। পূর্ণিমা মুখোপাধ্যায়, নীলিমা সান্যাল আর ইন্দিরাদেবী। যদিও এঁদের কেউই বেলাদির মতো প্রযোজকের ভূমিকায় ছিলেন না, কিন্তু মহিলামহল-এ এঁদের প্রায়ই পাওয়া যেত।

পূর্ণিমাদি যদিও’বা কিছু দিন মহিলামহল পরিচালনা করেছেন, অন্যরা তা’ও না।

ইন্দিরাদি আকা‌শবাণী-র প্রথম বাঙালি ঘোষিকা। অসম্ভব পরিশ্রম করে গড়ে তুলেছিলেন ‘শিশুমহল’ অনুষ্ঠানটি। ছিলেন ভাল লেখিকা। কিছু না হলেও অন্তত শ’খানেক বই লিখেছেন। শুধু লেখার জন্যই অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। বেলাদি সুযোগ পেলেই ওঁকে মহিলামহল-এ ডাকতেন।

নীলিমাদি খবর পড়তেন, তার সঙ্গে যেহেতু ভাল গান জানতেন আর দুর্দান্ত কথা বলতেন, নানা ধরনের অনুষ্ঠানে তাঁর ডাক পড়ত, অনেকটা ভরাট শিল্পীর ভূমিকায়। তার সঙ্গে রেডিয়োয় নাটকও করতেন নীলিমাদি। জয়ন্ত চৌধুরীর সঙ্গে জুটি বেঁধে ওঁর বহু নাটক আজও ভোলার নয়।

বেলাদির ডাকে প্রায়ই মহিলামহল-এ এসে বসতেন নীলিমাদি। এমন হয়েছে, বেলাদি-নীলিমাদি মহিলামহল করছেন। লাইভ। অনুষ্ঠান শেষ হতে হাতে হয়তো মিনিট চারেক পড়ে। এ দিকে সে দিনের যাবতীয় যা করার সব শেষ। বেলাদির অনুরোধে ওই বাকি সময়টুকু গান গেয়ে ভরিয়ে দিয়েছেন নীলিমাদি। তা’ও আবার খালি গলায়। শ্রোতারা ধন্য ধন্য করেছেন। এতটাই বিচিত্র গুণের অধিকারী ছিলেন উনি।

আসল ঘটনা তা নয়, আমার অদ্ভুত লাগার জায়গাটা সম্পূর্ণ অন্য। এই চারজন, যাঁরা কিনা পরিবার গড়ে তোলা, তাকে আরও সুন্দর করে বাড়িয়ে তোলার উপায় কী ইত্যাদি নিয়ে একটি অনুষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের পারিবারিক জীবন ছিল নিতান্তই করুণ।

বেলাদি সম্ভবত বিদেশে গিয়ে আবিষ্কার করেন বহু কাল দেশে না-ফেরা তাঁর স্বামী অন্য এক সম্পর্কে মেতে আছেন।

ইন্দিরাদি। স্বামী মারা গেলেন অল্পবয়েসে। দুই ছেলে। দু’জনেই অসম্ভব বিদ্বান। তাঁদেরও অকাল মৃত্যু।

পূর্ণিমাদি। বিয়ে করেন রেডিয়োরই প্রোগ্রাম এক্সিকিউটিভ অতুলকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়কে। সুদর্শন। প্রচণ্ড ক্রিয়েটিভ। একই সঙ্গে খুব দামাল। নর্থ-ইস্টে বদলি হয়ে গেলেন। গাড়ি চালাতে চালাতে খাদে পড়ে গিয়ে তাঁর মৃত্যু হল।

নীলিমাদির জীবনটাও কেমন যেন বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছিল। ছিলেন অসম্ভব সুন্দরী। প্রচণ্ড শৌখিন। কোনও শাড়ি নাকি তাঁকে এক বছরে কেউ দ্বিতীয়বার পরতে দেখেনি। বহু দিন দিল্লিতেও রেডিয়োর সংবাদ পাঠিকা হিসেবে কাজ করেছেন। শুনেছি ওঁর ওখানকার বাড়িতে অতিথি-অভ্যাগতদের আসা-যাওয়া লেগেই থাকত। কলকাতা থেকে কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, সুচিত্রা মিত্র বা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়রা পর্যন্ত দিল্লি গেলে ওঁর বাড়িতে উঠতেন।

নীলিমাদির সঙ্গে আমার আলাপ হয় দিল্লির রেডিয়ো-র অফিসে গিয়ে। তখন উনি রীতিমতো নামকরা সংবাদ-পাঠিকা। এর আগে কলকাতায় কাজ করতে করতেই নীলিমাদি বিবিসি চলে যান।

কলকাতায় থাকাকালীনই তাঁর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা হয় এল কে মালহোত্র নামের এক রেডিয়ো-কর্মীর সঙ্গে। বিয়েও হয়। বিদেশ থেকে নীলিমাদি ফেরার আগে তাঁর স্বামীর পদোন্নতি হল। মালহোত্র হয়ে গেলেন দিল্লির তথ্য ও বেতার মন্ত্রকের এক উচ্চপদস্থ কর্তা। নীলিমাদি বিলেত থেকে ফেরার পরই মালহোত্র পরিবারে শুরু হয় প্রচণ্ড অশান্তি। এর পর বিচ্ছেদ।

শুনেছি, একা হয়ে যাবার পর নিঃসঙ্গতা কাটাতে নীলিমাদি জড়িয়ে পড়েন ক্লাব, পার্টি, বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে আড্ডায়। তাঁর একাকী এই জীবনটায় কত জন যে তাঁকে ঠকিয়েছেন, ইয়ত্তা নেই।

’৮৫ সালে উনি যখন চিরকালের জন্য চলে গেলেন, গুটিকয় কর্মী ছাড়া তাঁর খোঁজ নেওয়ার মতো প্রায় কেউই ছিল না। তার আগে? অসুস্থতা থেকে গৃহহীনতা, কী না ছিল জীবনে!

কী বিচিত্র সমাপতন এই চার নারীর জীবনে!

তবে কী, বেলাদির ওই দুর্বিষহ জীবনটাই ওঁকে রেডিয়োতে এনে ফেলেছিল। ওঁর আকাশবাণী-তে আসার ইচ্ছেটা একেবারে শিশুকালের। তখন বাধা পেয়েছিলেন। অথচ পাকেচক্রে যখন এলেন, তখন বাড়ির আর অমত করার উপায় ছিল না।

বীরেনদার (ভদ্র) বেলাদিদের বাড়িতে যাতায়াত বহু দিনের। বীরেনদার রামধন মিত্র লেনের বাড়ি থেকে বেলাদিদের মোহনলাল স্ট্রিটের বাড়ি হাঁটাপথ। বীরেনদার বাবা কালীকৃষ্ণদেব আর বেলাদির বাবা ধীরেশচন্দ্র ঘোষ ছিলেন ছেলেবেলার বন্ধু।

ধীরেশচন্দ্রের কাচের ব্যবসা, কিন্তু সাহিত্যে ছিল বিরাট ঝোঁক। বাড়িতে তিনি ‘রবীন্দ্রসাহিত্য সম্মিলনী’ নামে একটি সংস্থা তৈরি করেন। যার দায়িত্বে ছিলেন বেলাদির মামা স্বনামধন্য ড. কালিদাস নাগ, রবীন্দ্র-ঘনিষ্ঠ অমল হোম আর বীরেনদা।

সেই সময়কার বহু নামজাদা সাহিত্যিক, সঙ্গীতশিল্পী আসতেন ওঁদের বাড়ি। এই পরিবেশে বড় হওয়া বেলাদিরও সাধ হয়েছিল রেডিয়োতে যোগ দেওয়ার। বীরেনদাকে বলেও ছিলেন সে-কথা। বাড়ির আপত্তি তো ছিলই, বীরেনদাও শুনে এক কথায় ‘না’ করে দেন। আসলে তখনকার দিনে সম্ভ্রান্ত ঘর থেকে মেয়েদের রেডিয়োতে যাওয়া মোটেই ভাল চোখে দেখা হত না।

তারপর তো বেলাদির জীবনে ঘোর দুর্বিপাক। বিদেশে গিয়ে স্বামীকে অমন অবস্থায় দেখলেন। দেশে ফিরলেন বিপর্যস্ত হয়ে। উদভ্রান্ত জীবনকে শান্ত করতে বাবার সঙ্গে দেশ ঘুরতে বেরোলেন। ফিরে বেথুন কলেজে ভর্তি হয়ে পড়াশোনার চেষ্টা চালালেন। কিন্তু কিছুতেই যেন আর জীবনের ছন্দ ফিরছিল না। তখন কালিদাসবাবুই তাঁর বাবাকে বলেন ওঁকে রেডিয়োতে ঢুকিয়ে দিতে। ’৪৫ সালে ওঁর ক্যাজুয়াল হিসেবে রেডিয়োয় আসা। তখন অনেক ধরনের কাজ করতেন। একটা সময়ের পরে পুরোপুরি মহিলামহল।

আমার সঙ্গে বেলাদির আলাপ রেডিয়োতে আমার জয়েন করার প্রথম দিনেই। ঢুকেই দোতলার বড় ঘরটাতে গেলাম। ঘরের এক জায়গায় ঘোরানো চেয়ারে বসে বীরেনদা। উল্টো দিকে একটু বাঁ দিক ঘেঁষে বেলাদি। প্রণাম করলাম। বললেন, ‘‘তুমি প্রেমাংশুর ভাইপো?’’ আমার কাকা প্রেমাংশু বসু তখন রেডিয়োওতে বেশ জনপ্রিয় নাম।

প্রথম দিন থেকেই বেলাদিকে দেখতাম নিজের কাজের প্রতি অসম্ভব একনিষ্ঠ। আকাশবাণী-অন্তপ্রাণ। অথচ একেবারে নেপথ্যচারিণী বলতে যা বোঝায়, তাই। বীরেনদা কাজ করলে বোঝা যেত, কিছু একটা হচ্ছে। হইচই। বকাঝকা। বেলাদি কিন্তু একেবারে নিশ্চুপ। বড় জোর বিরক্ত হলে গজগজ করে হেঁটে চলে যেতে দেখেছি, তার বাইরে কিছু নয়।

বেলাদিকে প্রশংসা করে পিঠে হাত রেখে ইন্দিরা গাঁধী একবার বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো সমাজসেবিকা।’’

বেলাদিকে নিয়ে কয়েকটি ঘটনা সত্যি ভোলার নয়।

১৯৬৪ সাল। ২৭ মে। অফিসের কাজকর্ম সেরে বাড়ি ফিরে শুনলেন জওহরলাল নেহরু মারা গিয়েছেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই আকাশবাণী থেকে তলব, ‘‘এখনই চলে এসো।’’ নির্ধারিত সব অনুষ্ঠান বাতিল। নতুন করে সব কিছু করতে হবে। নাকে মুখে কিছু গুঁজে বেরিয়ে পড়লেন। দেখলেন, বাস-ট্রাম-ট্যাক্সি সব বন্ধ। কোনও ক্রমে একটা রিকশা জোগাড় হল। সেটা নিয়েই শ্যামবাজার থেকে পৌঁছে গেলেন আকাশবাণী।

আরেক দিন যেমন। মুষলধারে বৃষ্টি। মহিলামহল-এ সে দিন সাহিত্যসভা। তাতে আছেন আশাপূর্ণাদেবী, রাধারাণীদেবীদের মতো লেখিকা। সে বারও রাস্তা জলে টইটম্বুর। তার মধ্যেই একটা ট্যাক্সি নিয়ে ছুটলেন। আর এমনই দুর্ভাগ্য, অফিসের প্রায় কাছাকাছি এসে তা’ও গেল বিগড়ে। এ দিকে প্রবল বৃষ্টি। শেষমেশ বাকি রাস্তা পায়ে হেঁটে সপসপে হয়ে যখন আকাশবাণীতে ঢুকলেন, দেখলেন অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে। ওই অবস্থাতেই ঢুকে পড়লেন স্টুডিয়োয়।

কনকনে এয়ারকন্ডিশন্ড ঘর। তার মধ্যে ওই ভিজে জামাকাপড়। তাতেও অনুষ্ঠান শেষ করলেন নির্বিঘ্নেই। আশাপূর্ণাদেবী নাকি জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘‘বেলা, সত্যিই তুমি রেডিয়োকে ভালবাসো, আশীর্বাদ করি আরও বড় হও।’’

বেলাদির সব থেকে বড় গুণ ছিল উনি জানতেন, কাকে দিয়ে কোন কাজটা হবে। কী করে কাজ গুছিয়ে নিতে হয়। কার কাছে কোন সাহায্যটা নিতে হয়।

লীলা মজুমদারের কাছে যেমন উনি দিনের পর দিন পড়ে থেকেছেন। কী ভাবে ভাল স্ক্রিপ্ট লিখতে হয় শিখবেন বলে। আর বীরেনদাকে তো ‘গুরু’ মানতেন অন্য বহু মানুষের মতোই।

বীরেনদার পরামর্শে বেলাদি মহিলামহল-এ রান্না-সেলাই-ঘরকন্নার বাইরেও অন্য বহু বিষয় এনেছিলেন।

শুধু ঘর নয়, ঘরের বাইরেও যে মেয়েদের একটা জগৎ আছে, তাকে বেলাদি মহিলামহল-এ ঢুকিয়েছিলেন।

একটা সিরিয়াল করতেন। নাম দিয়েছিলেন ‘কবির মানসী প্রিয়া’। তাতে একবার ডেকেছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের স্ত্রী আশা গঙ্গোপাধ্যায়কে। ‘ঘরে বাইরে’ করতেন। যেখানে দেশবিদেশের মেয়েদের কথা বলা হত। গীতি আলেখ্য করতেন। তাতে অংশ নিতেন অনুপম ঘটক, অনিল আচার্য, নির্মল ভট্টাচার্যর মতো গুণী শিল্পীরা। বেলাদির ডাকে কানন দেবী পর্যন্ত অনুষ্ঠান করে গিয়েছেন মহিলামহল-এ।

আর একটা ব্যাপার বেলাদি জানতেন, বিপদের সময় কী করে উতরে যেতে হয়।

বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র

হেমন্ত মুখোপাধ্যায়

সৈয়দ মুজতবা আলী

একবারের কথা বলি। সে দিন বৃষ্টিতে এমন অবস্থা, নির্ধারিত শিল্পী আসেননি। মহা বিপদ। এমন সময় হঠাৎই বেলাদি দেখেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ঢুকছেন আকাশবাণী-তে। তখনই ওঁর কাছে গিয়ে বললেন, ‘‘বড় বিপদে পড়ে গেছি। একটু বর্ষার গান গেয়ে দেবে?’’

ওঁর এক কথায় রাজি হয়ে গেলেন অমন মাপের একজন শিল্পী। এর অন্যতম কারণ, মিষ্টভাষী বেলাদির অনুরোধ চট করে কেউই ফেরাতে পারতেন না।

হেমন্তবাবুর ক্ষেত্রেই দেখুন। উনি প্রায়ই আসতেন আকাশবাণী-তে। আড্ডা দিতে। একদিন বেলাদিকে বলেছিলেন, ‘‘তুমি তো মহিলামহল-এর আসরে রান্নাবান্নার কথা খুব বলো। আমার মা খুব ভাল রাঁধেন। ওঁকে একবার সুযোগ দিয়ো না!’’

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেলাদি ছুটে গিয়েছিলেন হেমন্তবাবুর বেণীনন্দন স্ট্রিটের বাড়ি। ওঁর মা কিরণবালাদেবীর সঙ্গে কথা বলতে। তার পর একদিন ওঁকে সসম্মানে অনুষ্ঠানে ডাকেন। এই হলেন বেলাদি।

এ শুধু হেমন্তবাবুর মতো মানুষ বলে নয়, আমাকেও কত বার উনি কত রকম অনুষ্ঠানের সুযোগ করে দিয়েছেন। রেডিয়োর প্রথম জীবনে আমাকে তেমন কেউই কাজ দিতেন না। বয়স অল্প। সকলে ভাবতেন, ‘‘এ কী পারবে?’’

বেলাদি কিন্তু ভরসা রেখে ডাকতেন আমায়। হয়তো ওঁরও দরকার ছিল। কিন্তু সে-দরকার তো অন্য ভাবে মিটিয়ে নিতে পারতেন। আমার মতো একজন ‘ছেলেমানুষ’-কে নিয়ে ঝুঁকি নেওয়া কেন!

শান্ত চেহারার আড়ালে বেলাদির মধ্যে কি একজন বেপরোয়া মানুষও লুকিয়েছিল? ওঁর আরও একটা ঘটনা শুনলে অনেকটা তেমন মনে হয় বইকী!

আকাশবাণী ভবনের পুরনো বাড়ি ১ নম্বর গারস্টিন প্লেসে ভূতের গল্প বহুশ্রুত। যার ভয়ে সন্ধেবেলা সে-বাড়ির ছাদ কেউ মাড়াতেন না। ও বাড়িতে নাকি সাহেব-ভূত আছে। ভূতে পিয়ানো বাজায়। পাশে একটা কবরখানা ছিল, ফলে ভূতের গল্পটা আড়েবহরে আরওই বেড়ে উঠেছিল।

আমি জানি, প্রখ্যাত শিল্পী হারাধন বন্দ্যোপাধ্যায়ের আকাশবাণী-র চাকরি ছেড়ে দেওয়ার একমাত্র কারণ ছিল এই সাহেব-ভূত!

বেলাদি কিন্তু দিব্যি ছাদে বসে অনেক সময় লেখালেখির কাজকর্মও সারতেন। ফাঁকা শান্ত জায়গা। বিশেষ কেউ যায় না। তাই বোধ হয় ভালই বাসতেন ছাদটা।

এমনই এক দিনে পিয়ানোর টুংটাং আওয়াজ শুনতে শুনতে উনি লিখছেন। নীচ থেকে নীলিমাদির তারস্বরে চিৎকার, ‘‘বেলা নেমে এসো। শুনছ না, ভূতে পিয়ানো বাজাচ্ছে!’’

বেলাদি লেখা ছেড়ে হেলতে দুলতে উঠে দেখেন একটা কুকুর পিয়ানোর ওপর হেঁটেচলে বেড়াচ্ছে, তাতেই টুংটাং শব্দ। বেলাদিকে দেখে সে মাটিতে লাফিয়ে পড়ে কবরখানার দিকে পালিয়ে গেল।... এর পরও বেলাদির ছাদ-প্রীতি ছিল কি না, বলতে পারব না। কিন্তু ওটুকু ঘটনাও বা কম কী সে!

বেলাদির রান্না নিয়ে লেখাটা শুরু করেছিলাম। শেষও করব তাই দিয়ে। ‘রাঁধুনি’ বেলাদির পরিচয় কিন্তু আমিও কোনও দিন পাইনি।

অত বিস্তৃত করে যিনি রান্নার রেসিপি বলতেন তিনি কি সত্যিই রান্না জানতেন, এ কিন্তু আমার কাছেও এক রহস্য!

বেলাদি রান্নাবান্না করে খাবারদাবার নিয়ে আকাশবাণী-তে এসেছেন, এমন ঘটনা কিন্তু আমিও জানি না। এ বরং ইন্দিরাদির ক্ষেত্রে হয়েছে। প্রচণ্ড বৃষ্টি। বাইরে খেতে যাবার উপায় নেই। আকাশবাণী থেকে সহকর্মীদের আবদারে ইন্দিরাদি খিচুড়ি আর ভাজাভুজি নিয়ে হাজির হয়েছিলেন।

বেলাদিকে নিয়ে এমন কোনও ঘটনাই কিন্তু শুনিনি। এ প্রসঙ্গে প্রেমেন্দ্র মিত্রর গল্পটা বেশ মনে রাখার মতো।

প্রেমেন্দ্র মিত্র বেলাদিকে খুব স্নেহ করতেন। উনি নাকি একদিন বলেন, ‘‘আচ্ছা বেলা, তুমি এত রান্নার কথা জানলে কী করে?’’ উত্তরে বেলাদি বলেছিলেন, ‘‘আমার মায়ের একটা রান্নার খাতা আছে, তাই দেখে বলি। তাছাড়া বিদেশ গিয়েও সে-দেশের কিছু রান্না সংগ্রহ করে এনেছি।’’ এর পর প্রেমেন্দ্র মিত্ররই উদ্যোগে বেলাদির প্রথম রান্নার বই বেরোয়।

তাতে অবশ্য আমার প্রশ্নের কোনও সমাধান হয়নি। গারস্টিন প্লেসের সাহেব-ভূতের মতো তা আজও আমার কাছে রহস্যই থেকে গেছে।

বেলাদির মতো অমন মিষ্টি মানুষের নানা স্মৃতির মধ্যে এই অনুদ্ঘাটিত রহস্যটুকু আমার কিন্তু বেশ লাগে!

কয়েকটি তথ্য: কলকাতা বেতার, সম্পাদনা: ভবেশ দাশ, প্রভাতকুমার দাস (পূর্বাঞ্চল সংস্কৃতি কেন্দ্র)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE