কবির জীবনে অনেক নাটকীয় ঘটনা থাকে, কিন্তু কবিরে পাবে না তার জীবনচরিতে। কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ব্যতিক্রম নন। তাঁর মতো মহৎ প্রতিভার কবির অর্ধেক জীবনীই তাঁর সৃষ্টিতে বিধৃত অন্তরঙ্গ জীবন। বাইরের জীবনের ঘটনাবলিতে অনেক নাট্যরসদ আছে। কিন্তু সেগুলির নির্বাচনে ও উপস্থাপনায় স্বচ্ছন্দ ও স্বাধীন হওয়া সহজ নয়, কারণ সে সব এখনও সময়ের ব্যবধানে ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতায় সংকলিত হয়নি এবং সুনীল এখনও জীবিত আছেন তাঁর স্বজন, বন্ধু ও বহু কবি ও কবিতা পাঠকের প্রত্যক্ষ পরিচয়ের আবেগ মথিত স্মৃতিতে। তবু চিরঞ্জীব বসুর জোরালো রচনায় এবং দেবাশীষ ঘোষ দস্তিদারের পরিচালনায় হাতেখড়ির প্রয়োজনা ‘সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়’-এর মঞ্চসাফল্য তর্কাতীত। দু’ঘণ্টার প্রযোজনায় আছে একটি সুষ্ঠু সাংগঠনিক রূপ। পরস্পর অন্বিত খণ্ডচিত্র নিয়ে একটি নিটোল জীবন-কাহিনি নয়, গুরুত্ব পেয়েছে অনেকগুলি মুহূর্ত ও ঘটনা নিয়ে ছোট ছোট তীব্র নাটকীয় অভিঘাতের জীবনদৃশ্য। প্রতিটি দৃশ্য বা দৃশ্যগুচ্ছ, সুনীলের এক একটি প্রতিকৃতি, গোটা নাটকটাই, বলা যেতে পারে, জীবনীর সুতোয় গাঁথা প্রতিকৃতির মালা। যেমন যৌবন থেকে মৃত্যুর বছর পর্যন্ত রেমব্র্যান্ডটের সেল্ফ-পোর্ট্রেট।
রেমব্র্যান্ডট এঁকেছিলেন প্রায় একশো প্রতিকৃতি, মঞ্চের ক্যানভাসে আঁকা সুনীলের পোর্ট্রেটের সংখ্যাও কম নয়, কবি ও প্রেমিক সুনীল, স্বাতী ও সুনীল, মার্গারিট ও সুনীল, সুনীল ও রানি (বা নীরা), খালাসিটোলার, অরণ্যের দিনরাত্রির, কৃত্তিবাসের সুনীল, প্রতিষ্ঠান-বিরোধী না প্রতিষ্ঠান আশ্রিত এই বিতর্কের সুনীল, বামপন্থী রাজনীতির আক্রমণের, কুৎসার ষড়যন্ত্রের শিকার সুনীল, অনুজ কবিদের সস্নেহ প্রশ্রয়দাতা, শক্তির সঙ্গে পদ্য ও গদ্যের তর্কে, মদ্যপানে নিত্যাসক্ত কিন্তু সুস্থির সুনীল, সুকণ্ঠ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক এমন আরও কয়েক জন সুনীলকে নিয়ে একটির পর একটি সুবিন্যস্ত টানটান নাটকীয় মুহূর্তের সংকলনে ধরা দিয়েছে বিচিত্র আলোয় বিচ্ছুরিত সুনীলের বহুমুখী ব্যক্তিত্ব ও পরিচিতি। সব ছবিই একই আঙ্গিক বা একই মাধ্যমের পোর্ট্রেট, তা নয়, কোনওটি নিছকই স্কেচ, কোনওটি পরিচ্ছন্ন ড্রয়িং, কোনওটি ফ্যানটাসি (নীরার সুনীল), কোনওটি হাল্কা জলরং (স্বাতীর সঙ্গে সুনীল), কিন্তু পূর্ণাঙ্গ রিয়ালিস্টিক তেলরং মার্গারেটের সুনীল। অবশ্যই উজ্জ্বলতম প্রতিকৃতি কবি সুনীলের, তাই যে কবিতার জন্য তিনি অমরত্বও ত্যাগ করতেন অন্তর্জীবনের আলোড়নে স্পন্দিত সেই সব কবিতা সুনীলের (শঙ্কর চক্রবর্তী) উদাত্ত উচ্চারণে প্রযোজনা এক গভীর মাত্রা পেয়েছে। প্রথম গানটিই সুনীলের কবিতা, সুরে (সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়) ও পরিবেশনে অন্তরঙ্গ আবহ রচনা করে।
সামগ্রিক এই সাফল্য সত্ত্বেও বিরতির পর সাংগঠনিক শিথিলতা নজর এড়ায় না। খুবই নাটকীয় সুনীল মার্গারেটের প্রেম-কাহিনি কিন্তু তা প্রযোজনার নিহিত নির্মিতি ছাপিয়ে ওঠে তার নিজস্ব আবেদনে। কুৎসার ষড়যন্ত্রের দৃশ্য দুর্বল। বিরতির আগে ছিল চমৎকার কৌতুকদৃশ্য। সুনীলের ইন্টারভিউ কবির ব্যক্তিত্বকে আরও উদ্ভাসিত করে। কিন্তু এই বিশুদ্ধ ভাঁড়ামি কুৎসার চেয়েও কুৎসিত একটি সফল সিরিয়াস প্রযোজনায়।
প্রযোজনার প্রাণ সুনীলের ভূমিকায় শঙ্কর চক্রবর্তী, প্রতিটি প্রতিকৃতির তিনি সার্থক শিল্পী। মঞ্চের সুনীলকে তিনি বাস্তবের সুনীল করেননি, কিন্তু দুই সুনীলের মধ্যে এক সুষম সাযুজ্য প্রতিষ্ঠা করেছেন কুশলী অভিনয়ে। এছাড়াও সোনালী চক্রবর্তীর স্বাতী, শুভাশিস গঙ্গোপাধ্যায়ের শক্তি, দোয়েলপাখি দাশগুপ্তের মার্গারেট ও সেঁজুতি সেনগুপ্তের রানি প্রযোজনার অন্যতম সম্পদ। হিরণ মিত্রের অবদানও কম নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy