Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Presents

অ্যানুইটির এ দিক সে দিক

পেনশন পেতে যে অ্যানুইটিই কিনতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? যে-প্রকল্পেই জমান আর পরে যেখানেই তা রাখুন, লক্ষ্য শুধু ভাল রিটার্ন। নামে কী আসে যায়?পেনশন পেতে যে অ্যানুইটিই কিনতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? যে-প্রকল্পেই জমান আর পরে যেখানেই তা রাখুন, লক্ষ্য শুধু ভাল রিটার্ন। নামে কী আসে যায়?

শৈবাল বিশ্বাস
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৪ ০১:২২
Share: Save:

আমি বরাবরই ক্রিকেটের ভক্ত। হয়তো সেই কারণেই পেনশন নিয়ে কেউ পরামর্শ চাইলে আগে ওয়ান-ডে ক্রিকেটের উদাহরণ তুলে আনি আমি। বলি, আচ্ছা ৫০ ওভারে ৩০০ রান তাড়া করতে নামার আগে একটা দল কী ভাবে? এই তো যে, জিততে হলে ৫০ ওভারে ৩০১ করতে হবে? মানে প্রতি ওভারে গড়ে অন্তত ছ’রান। আমার প্রশ্ন, পেনশন নিয়েও আমরা এ ভাবে ভাবি না কেন? কেন অ্যানুইটি কেনাকে অনেক সময়ে পেনশন পাওয়ার একমাত্র উপায় মনে করি?

আচ্ছা, অ্যানুইটি বা পেনশন প্রকল্পের লক্ষ্যটা কী? অবসরের পরেও প্রতি মাসে একটা নির্দিষ্ট টাকা হাতে আসার বন্দোবস্ত করা, তাই তো? মোটামুটি কত টাকা জমাতে পারলে ওই ‘পেনশন’ পাওয়া যাবে, তার একটা আন্দাজ নিশ্চয় করতে পারেন। এও জানেন যে, ওই তহবিল তৈরির জন্য হাতে সময় কত আছে (চাকরি যত দিন বাকি)। তা হলে সেই অনুযায়ী জমাতে শুরু করুন। তা সে যে-প্রকল্পেই হোক।

পেনশনের জন্য অ্যানুইটিই কিনতে হবে, এমন মাথার দিব্যি কে দিয়েছে? পঞ্চাশ ওভারে ৩০১ চাই। প্রতি ওভারে ছয়। কিন্তু তা বলে স্ট্রেট ড্রাইভ না কি কভার ড্রাইভ মেরে সেই রান তোলা হবে, তা কোনও দল ঠিক করে কি? নিশ্চয়ই না? ফলে আপনিই বা হঠাত্‌ তা করতে যাবেন কেন?

পাখির চোখ পেনশন

পেনশনের প্রয়োজনীয় অঙ্ককেই পাখির চোখ করুন। কোন পথে হেঁটে তার জন্য টাকা জমবে, সে বিষয়ে বরং নমনীয় থাকাই ভাল। কারণ, পেনশন প্রকল্পই কিনুন বা অন্য কোনও ভাবে পেনশন পাওয়ার রাস্তা খুঁজুন, সিঁড়ি দু’টো—

(১) প্রথমে তার জন্য টাকা জমানো।

(২) সেই জমানো তহবিল এমন ভাবে রাখা, যেন সেখান থেকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট টাকা হাতে আসে।

ফলে প্রথম পর্যায়ে তহবিল তৈরির সময়ে এমন প্রকল্প বাছুন, যেখানে রিটার্ন চড়া। একই সঙ্গে ঝুঁকিও এত নয় যে, পুরো টাকা জলে যাবে। যত্ন নিয়ে বাছাই করা শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড ইত্যাদি এ ক্ষেত্রে মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে। তেমনই দ্বিতীয় পর্যায়ে বাছতে হবে এমন কোনও প্রকল্প, যা যেমন সুরক্ষিত, তেমনই ভাল সুদ দেওয়ারও ক্ষমতা রাখে। এর জন্য কোনও ভাল অ্যানুইটি প্রকল্প যেমন কিনতে পারেন, তেমনই টাকা রাখতে পারেন মিউচুয়াল ফান্ড, মেয়াদি আমানত কিংবা মাসিক আয় প্রকল্পে।

তা বলে ঝগড়া নেই

এই পর্যন্ত দেখে মনে হতে পারে যে, অ্যানুইটির সঙ্গে বুঝি আমার খুব ঝগড়া। তাই ওই প্রকল্প কিনতেই বারণ করছি। কিন্তু ঘটনা তা নয়। আমি আসলে বোঝাতে চাইছি, সচ্ছল অবসর নিশ্চিত করতে পেনশনের বন্দোবস্ত করা অবশ্যই জরুরি। কিন্তু তার জন্য যে অ্যানুইটিই কিনতে হবে, এমনটা নয়। কেন? আসুন বোঝার চেষ্টা করি।

দু’ভাবে অ্যানুইটি কেনা সম্ভব:—

(১) ওই প্রকল্পেই অল্প অল্প করে টাকা জমিয়ে। যাকে আমরা বলি ডেফার্ড অ্যানুইটি।

(২) থোক টাকা ঢেলে। যেখানে লগ্নির প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পেনশন পাওয়া শুরু হয়ে যায়। এর নাম ইমিডিয়েট অ্যানুইটি।

দু’ক্ষেত্রেই অসুবিধা কী কী রয়েছে, তা এক ঝলকে দেখে নেওয়া যাক।

অসুবিধা কোথায়

ডেফার্ড অ্যানুইটি

এ ক্ষেত্রে অন্য কোনও চড়া রিটার্নের প্রকল্পে টাকা জমিয়ে তহবিল তৈরির সুযোগ নেই। টাকা জমাতে হবে ওই প্রকল্পেই। সাধারণত যেখানে রিটার্ন শেয়ার, মিউচুয়াল ফান্ড, ইনডেক্স ফান্ড ইত্যাদির তুলনায় অনেকটা কম। অনেক ক্ষেত্রে তা কম হতে পারে মেয়াদি আমানতের মতো সুরক্ষিত প্রকল্পের থেকেও। প্রশ্ন হল, তা হলে আর আপনি এখানে টাকা জমাবেন কেন?

জীবনভর কষ্ট করে জমানো টাকায় যে অ্যানুইটি প্রকল্প কিনবেন, তা থেকে কী হারে রিটার্ন মিলবে, তার নিশ্চয়তা কিন্তু সে ভাবে নেই। কারণ, অধিকাংশ অ্যানুইটি প্রকল্পেই এই রিটার্নের হার স্পষ্ট করা থাকে না। অনেক ক্ষেত্রেই (বিশেষত যেগুলিতে বিমার কভারেজ রয়েছে) তা বেশ কম হতে পারে। এমনকী ৪ শতাংশও!

বিমার সুরক্ষা থাকা মানেই জীবনের ঝুঁকি, এজেন্টের কমিশন ইত্যাদি খাতে নানা চার্জ গুনতে হবে। বিশেষত প্রথম দিকের বছরগুলির জন্য। তার উপর কেন কত টাকা কাটা হচ্ছে, তা-ও গ্রাহকদের পক্ষে বোঝা শক্ত।

এই ধরনের প্রকল্পে টাকা জমাতে পারলে যে করছাড়ের বেশি সুবিধা মেলে, এমনটা নয়। তার উপর নমনীয়তা কম টাকা তোলার ক্ষেত্রেও। কিছু ক্ষেত্রে জমানো টাকার এক-তৃতীয়াংশ এক লপ্তে তোলা যায় ঠিকই। কিন্তু যদি ছেলে-মেয়ের বিয়ে বা উচ্চশিক্ষার মতো কোনও কারণে আরও বেশি প্রয়োজন হয়, তা হলে?

ইমিডিয়েট অ্যানুইটি

এই প্রকল্প অন্তত ডেফার্ড অ্যানুইটির তুলনায় ঢের ভাল। কারণ, এখানে টাকা জমানো যায় যেখানে খুশি। নিজের পছন্দসই জায়গায়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এরও কিছু অসুবিধা আছে। যেমন—

অধিকাংশ ইমিডিয়েট অ্যানুইটি প্রকল্পের সুদ ১০ বছরের মেয়াদি আমানতের (ফিক্সড ডিপোজিট) তুলনায় কম। তার উপর ওই আমানতে করছাড় মেলায় সুবিধা আরও বেশি।

অনেকে বলতে পারেন, আমানতে সুদ যে-কমবে না, এমন নিশ্চয়তা কোথায়? ঠিক, সুদ কমতেই পারে। কিন্তু তেমনই মনে রাখবেন, সুদ কমতে পারে অ্যানুইটি প্রকল্পেও। সাধারণত মূল্যবৃদ্ধির হারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে তা ওঠে-নামে।

এ বার একটা অঙ্ক কষা যাক। মনে করুন, রামবাবু অবসরের সময় পিএফ, গ্র্যাচুইটি ইত্যাদি বাবদ ৪০ লক্ষ টাকা পেলেন। তিনি চান এমন কোথাও তা লগ্নি করতে, যেখানে ৯% সুদ (বছরে ৩.৬ লক্ষ টাকা) মেলে। এ বার এ জন্য তিনি কোনও অ্যানুইটির খোঁজ করতে পারেন কিংবা লগ্নি করতে পারেন একটু অন্য ভাবে। কী রকম?

ধরুন, ৪০ লক্ষের মধ্যে ১৮ লক্ষ টাকা রামবাবু রাখলেন কোনও ক্যাশ ফান্ডে। ফলে পরের পাঁচ বছরে প্রতি বার ৩.৬ লক্ষ টাকা করে তুলতে পারবেন তিনি। সে ক্ষেত্রে ওই তহবিল পাঁচ বছর পরে খালি হয়ে যাবে। পড়ে থাকবে শুধু রিটার্নটুকু।

কিন্তু ওই পাঁচ বছরের জন্য তেমনই বাকি ২২ লক্ষ টাকা অন্য কোনও ফান্ডে ঢালতে পারেন তিনি। ধরা যাক, ঝঁুকি কমাতে তিনি এমন ফান্ড বাছলেন, যেখানে ঋণপত্র ও ইকুইটির অনুপাত ৭০:৩০। সে ক্ষেত্রে ২২ লক্ষ টাকার ৭০% (১৫.৪ লক্ষ) খাটছে ঋণপত্রে। আর বাকিটা (৬.৬ লক্ষ) ইকুইটিতে। ফলে ঋণপত্র ও ইকুইটিতে ১০% ও ১৬% রিটার্ন ধরলে, রামবাবু পাবেন যথাক্রমে ২৫.৩৩ লক্ষ এবং ১৪.৭০ লক্ষ টাকা। সে ক্ষেত্রে পাঁচ বছরের শেষে প্রায় ৪০ লক্ষ টাকাই রয়ে গেল। উপরন্তু পেলেন প্রথম ১৮ লক্ষ টাকার রিটার্ন। সঙ্গে মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করার কর সংক্রান্ত সুবিধাও।

সুতরাং...

ডেফার্ড অ্যানুইটি দুয়োরানি নয়। অবশ্যই কাজের। কিন্তু তা বলে সচ্ছল অবসরের একমাত্র উপায় নয়। তাই সেখানে টাকা ঢালার আগে বিচার করুন রিটার্ন কেমন। তার বদলে ফান্ড, শেয়ার, পিপিএফ, মেয়াদি আমানত, এনএসসির মতো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে টাকা খাটিয়ে গড়ে তোলা তহবিলের অঙ্ক আরও বেশি হবে কি না।

একই কথা খাটে ইমিডিয়েট অ্যানুইটির ক্ষেত্রেও। তা কিনতেই পারেন। কিন্তু আগে হিসেব কষে দেখুন, বিভিন্ন ব্লু-চিপ শেয়ারের ডিভিডেন্ড, ফান্ডের রিটার্ন, মেয়াদি আমানত, মাসিক আয় প্রকল্পের সুদ ইত্যাদি মিলিয়ে-মিশিয়ে তুলনায় বেশি রিটার্ন পাবেন কি না।

তাই শুধু অ্যানুইটির পিছনে না-ছুটে জমাতে শুরু করুন তাড়াতাড়ি। টাকা ঢালুন ভাল রিটার্ন মেলে এমন সুরক্ষিত প্রকল্পে। আসল ফারাক তৈরি হয় ওখানেই (সঙ্গের চার্ট দেখুন)।

৫০ ওভারে ৩০১-ই পাখির চোখ। তা সে যে-শটেই আসুক।

লেখক বিনিয়োগ বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

annuity saibal biswas bishoy ashoy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE