স্বপন (৩৬) • স্ত্রী (২৪) • ছেলে (১) • মা (৬১)
সরকারি কর্মী • স্ত্রী গৃহবধূ • মা পেনশন পান • বাড়ি জেলা-শহরে
• চান সচ্ছল অবসর • লক্ষ্য সন্তানের জন্য সঞ্চয় • ইচ্ছে জমি ও গাড়ি কেনা
বাঙালি বরাবরের বিমা প্রিয়। তা ঝুঁকি ছেঁটে ফেলতে তত্পরতার কারণেই হোক বা কর বাঁচানোর তাগিদে। পরিচিত এজেন্টের কথা ফেলতে না-পেরে আমরা অনেক সময়েই কম কভারেজের একখানা বিমা করে ফেলি। ভাবি না, পরে সত্যিই তা আমাদের কাজে লাগবে কি না। স্বপনকেই দেখুন। ১২টি বিমা প্রকল্পে বছরে ৫৬ হাজার টাকারও বেশি ঢালছেন তিনি। অথচ কভারেজ? মাত্র ১১.৭৭ লক্ষ টাকা। পলিসির সব টাকা যদি ম্যাচিওর-ও করে। তবেই বা কত টাকা পাবেন তিনি? আমি নিশ্চিত খুব বেশি নয়। তা হলে লাভ? আজ স্বপনের প্রোফাইল নিয়ে কথা বলার আগে এটা আলোচনায় তুলে আনলাম। কারণ এটা শুধু স্বপন নয়, আমাদের অনেকের সমস্যা।
অন্য সবার মতোই স্বপনের ইচ্ছা নিজের ও পরিবারের ভবিষ্যত্ সচ্ছল করে তোলা। সে জন্য লগ্নির পথে পা বাড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু সেখানে কিছু ক্ষেত্রে ভুলও হয়েছে। যার মধ্যে বিমার কথা প্রথমেই বলেছি। অন্য ভুলগুলিও চিহ্নিত করার চেষ্টা করব। তার পর দেখব, কী ভাবে তার সমাধান করা যায়। তবে তার আগে সংক্ষেপে স্বপনের আর্থিক অবস্থায় এক বার চোখ রাখি।
স্বপন পরিবারের সঙ্গে থাকেন জেলা-শহরে। নিজের বেতন ও মায়ের পেনশন মিলিয়ে পরিবারের মাসিক নিট আয় ৩০ হাজার টাকা। সংসার চালানোর পাশাপাশি সাধ্য মতো নিজের টাকা বিভিন্ন প্রকল্পে ছড়িয়ে দিয়েছেন। কিন্তু হিসাব করলে দেখা যাচ্ছে সব মিলিয়ে তাঁর হাতে মাস গেলে থাকে ১,৫০০ টাকার সামান্য বেশি। অর্থাত্ নতুন করে লগ্নির খুব বেশি সুযোগ নেই। অথচ সঞ্চয় না-বাড়িয়ে উপায় নেই। দেখা যাক কোন পথে হাঁটলে তা করা সম্ভব। তবে তার জন্য সবার আগে জরুরি নিজের সঞ্চয়ের সমস্যাগুলি ধরতে পারা।
সমস্যা ১: বিমার বাড়বাড়ন্ত
• স্বপনের মোট জীবনবিমা মূল্য ১১,৭৭,৫০০ টাকা। অর্থাত্ স্বপনের কিছু হলে তাঁর পরিবার ওই অর্থ পাবেন। কিন্তু এই টাকা কি আদৌ যথেষ্ট? কারণ, ৯% সুদের কোনও প্রকল্পে ওই টাকা রাখলে বছরে পাওয়া যাবে ১,০৫,৯৩০ টাকা বা মাসে ৮,৮২৮ টাকা। সেই টাকায় সংসার চলবে? চড়া মূল্যবৃদ্ধির কথা মাথায় রাখলে কিন্তু এই টাকা কোনও ভাবে যথেষ্ট নয়।
• সাধারণত আমাদের প্রবণতা থাকে জীবনবিমা পলিসিগুলিকে প্রিমিয়ামের অঙ্ক দিয়ে বিচার করার। বেশি প্রিমিয়াম দিচ্ছি মানেই যেন ভাল পলিসি। নয়তো আবার আমরা অল্প অল্প করে বেশি সংখ্যক পলিসি করে রাখি। ভাবি, পলিসির সংখ্যা বেশি হওয়া মানেই বেশি সুরক্ষা। স্বপনও ব্যতিক্রম নন। তাঁর ক্ষেত্রে আমরা মূলত দ্বিতীয়টি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু আসলে এ ভাবে লগ্নি করায় তাঁর পরিকল্পনার অভাবই স্পষ্ট।
• স্বপনের প্রতিটি পলিসিই দীর্ঘ মেয়াদের। কিন্তু তার সবক’টিই শেষ হচ্ছে ২০৩০ সাল বা তার আগে। অর্থাত্ ৫২ বছর বয়সেই তাঁর সমস্ত জীবনবিমার মেয়াদ ফুরোচ্ছে। এ ক্ষেত্রেও সেই পরিকল্পনার অভাব। কারণ, যখন বিমা সবচেয়ে জরুরি, সেই সময়েই তাঁর কভারেজ থাকবে না। লগ্নির সময়ে যা মাথায় রাখা হয়নি।
এই তথ্যগুলি বিশ্লেষণ করে আমার মনে কয়েকটি প্রশ্ন উঠে এসেছে। সেগুলি এক বার বলে নিচ্ছি—
• স্বপনের ১২টি জীবনবিমা রয়েছে। তিনি কি কর বাঁচানোর জন্য এ ভাবে লগ্নি করেছেন? অথচ এই লক্ষ্য পূরণে পিপিএফ বা ইএলএসএস-এর মতো প্রকল্প রয়েছে। যেখানে করছাড় তো মেলেই, বেশি রিটার্নও পাওয়া যায়।
• বিমার মধ্যে লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্যই কি ছোট ছোট অঙ্কে নানা প্রকল্পে টাকা ঢালার এই পথ বেছেছেন তিনি? সে ক্ষেত্রে আমি বলব ইউলিপ বাদে যে-বিমা প্রকল্পেই লগ্নি করুন না-কেন, আসলে তো সব টাকাই যাচ্ছে ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পে। ফলে তার মধ্যে আবার ভাগ করে লাভ নেই।
• এই ভাবে লগ্নি কি সুরক্ষিত প্রকল্পে টাকা রেখে বেশি রিটার্ন পাওয়ার জন্য? তা হলে বলব গত কয়েক বছরে যে-সব পলিসিতে বোনাস ঘোষণা হয়েছে, সেই হার মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে নীচে এবং তা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে না। অর্থাত্ মূল্যবৃদ্ধি বাদ দিলে রিটার্ন প্রায় শূন্য বা শূন্যের নীচে। লগ্নির সুরক্ষাই যদি লক্ষ্য হয়, তা হলে তো ব্যাঙ্ক বা ডাকঘরে স্থায়ী আমানতে টাকা রাখলেই হয়। সেখানে বরং বেশি রিটার্ন মেলে।
সমস্যা ২: রিটার্ন কই?
জীবনবিমা, পিপিএফ বা কিসান বিকাশ পত্রের মতো ঋণপত্র নির্ভর কোনও না কোনও সুরক্ষিত প্রকল্পেই সবচেয়ে বেশি লগ্নি করেছেন স্বপন। সাধারণত দেখা যায় ঋণপত্র নির্ভর প্রকল্পগুলি থেকে ৮.৫-৯% হারে সুদ পাওয়া যায়। বিমায় আরও কম। এ দিকে আবার বর্তমান খুচরো বাজারের মূল্যবৃদ্ধিও এই হারেই ঘোরাফেরা করছে। অর্থাত্ বলতে গেলে এই প্রকল্পগুলি থেকে আদতে কোনও রিটার্ন মিলছে না। শেয়ার তো ছেড়েই দিলাম, স্বপন মিউচুয়াল ফান্ডেও লগ্নি করেননি। অথচ সেটা করলে মূল্যবৃদ্ধি যুঝতে সুবিধা হত।
সমস্যা ৩: টাকা কোথায়?
স্বপনের বেশির ভাগ বিনিয়োগই দীর্ঘ মেয়াদের। যে-কারণে হঠাত্ করে টাকার প্রয়োজন হলে সমস্যা হবে। তখন টাকা জোগাতে গেলে তাঁকে নিজের সঞ্চয় ভাঙতে হবে। যা আদৌ কাম্য নয়।
সমস্যা ৪: স্বাস্থ্যবিমা যথেষ্ট নয়
এটা ভাল যে স্বপন স্বাস্থ্যবিমায় লগ্নি করেছেন। কিন্তু সেখানেও ছোট্ট সমস্যা রয়েছে। এখন তাঁর ২৩ হাজার টাকা বেতনে ৩.৫ লক্ষ টাকার স্বাস্থ্যবিমা অনেক বেশি মনে হলেও, আসলে কিন্তু তা নয়। ফলে বিমা বাড়ান।
এতক্ষণ কথা বললাম স্বপনের লগ্নির সমস্যা নিয়ে। কিন্তু এই পর্যন্ত পড়ে তাঁর উত্সাহ হারানোর কিছু নেই। পরিকল্পনা মাফিক সঞ্চয় শুরু করলে এখনও সামলে ওঠা যাবে। আসুন সেই সমাধানের পথ খুঁজি—
সমাধানের উপায়
• জীবনবিমায় ভাল কভারেজই যদি স্বপনের লক্ষ্য হয়, তা হলে এখনই তাঁকে একটি ভাল অঙ্কের টার্ম পলিসি করতে হবে। যেহেতু হাতে নগদ প্রায় থাকছেই না, সে জন্য তাঁকে কিছু বিমা বন্ধ করতে হবে। বিশেষত যেগুলি কম অঙ্কের বা যে-বিমা থেকে সে রকম রিটার্ন মেলার আশা নেই। বরং সেই প্রিমিয়ামের টাকা দিয়ে একটি টার্ম পলিসি কিনুন। বেতন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে যার অঙ্ক বাড়ানো যাবে।
• পিপিএফে বছরে লগ্নির সীমা বেড়ে এখন ১.৫০ লক্ষ টাকা হয়েছে। অর্থাত্ বছরে ওই অর্থ রাখার জন্য যেমন কর দিতে হবে না, তেমনই তার সুদও থাকবে সম্পূর্ণ করমুক্ত। পাশাপাশি, এই খাতে জমা টাকা চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ে। স্বপন ইতিমধ্যেই পিপিএফে লগ্নি করেছেন। এ বার তা ধাপে ধাপে বাড়ানোর পরামর্শ দেব আমি।
• ডাকঘরে রেকারিং প্রকল্পে মাসে ৫,০০০ টাকা রাখেন। এই খাতে নতুন করে লগ্নি করবেন না। বরং হাতে আসা টাকার কিছু অংশ ব্যাঙ্কে রেকারিং করুন। ডাকঘরে ৫ বছরের জন্য রেকারিং করতেই হয়। ব্যাঙ্কে তা নয়। কম সময়ের জন্য টাকা রাখলে নগদের জোগান বজায় থাকবে। যা জরুরি অবস্থায় কাজে লাগবে। আর বাকি অংশ মিউচুয়াল ফান্ডে ঢালুন। সে জন্য ডাইভার্সিফায়েড ইকুইটি ফান্ডে এসআইপি পদ্ধতিতে টাকা রাখুন। এতে লগ্নি যেমন ছড়িয়ে দেওয়া হবে, তেমনই রিটার্নও মিলবে অনেক বেশি।
• কিসান বিকাশ পত্র এবং এনএসসি-র টাকা ফের এই প্রকল্পগুলিতেই লগ্নি করুন। এতে লগ্নি ছড়িয়ে দেওয়া হবে। কিসান বিকাশ পত্র নতুন করে শুরু করছে কেন্দ্র। আগে দেখে নিতে হবে নতুন নিয়মে কী কী সুবিধা মেলে। আর তা না-চাইলে প্রকল্প থেকে পাওয়া টাকা ব্যাঙ্কে স্থায়ী আমানতে রাখতে পারেন।
(অনুরোধ মেনে নাম পরিবর্তিত)
স্বপনের মতো বিশেষজ্ঞের পরামর্শ পেতে পারেন আপনিও। নিজের ঠিকানা ও ফোন নম্বর জানিয়ে চিঠি লিখুন
‘বিষয়’, ব্যবসা বিভাগ, আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা, পিন-৭০০০০১.
ই-মেল: bishoy@abp.in
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy