Advertisement
০৭ মে ২০২৪
Presents
মিউচুয়াল ফান্ড

লাভের ভাগে লগ্নি

বাজার চড়া। কিন্তু সব সংস্থা একই ভাবে দৌড়চ্ছে কই? কারও ঘোড়ায় জিন, তো কেউ শামুক-গতি। এই অবস্থায় মুশকিল আসান হতে পারে ডিভিডেন্ড ইল্ড। জানালেন, নীলাঞ্জন দে।বাজার চড়া। কিন্তু সব সংস্থা একই ভাবে দৌড়চ্ছে কই? কারও ঘোড়ায় জিন, তো কেউ শামুক-গতি। এই অবস্থায় মুশকিল আসান হতে পারে ডিভিডেন্ড ইল্ড। জানালেন, নীলাঞ্জন দে।

শেষ আপডেট: ২৪ এপ্রিল ২০১৪ ০২:১২
Share: Save:

শেয়ার বাজারে কান পাতলে এখন ফিসফাস। মনমোহন-ম্যাজিকে নয়, সেনসেক্স না কি সাড়ে ২২ হাজার টপকেছে মোদী-মন্ত্রে ভর করে। এই আশায় যে, ভোট মিটলেই দিল্লির মসনদে আসবে স্থায়ী, পোক্ত সরকার। তার হাত ধরে জোয়ার আসবে আর্থিক সংস্কারে। ঝটপট ছাড়পত্র পাবে দীর্ঘ দিন ঝুলে থাকা প্রকল্প। ফলে তরতরিয়ে আরও উঠবে শেয়ার সূচক!

কিন্তু এই সব দেখে-শুনে দুশ্চিন্তায় আরও গলদঘর্ম হচ্ছেন আপনি। যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত ভাবেই ভাবছেন, যদি এমনটা না হয়? যদি একটা ত্রিশঙ্কু ফলাফল উঠে আসে লোকসভা নির্বাচনে? কিংবা নতুন সরকারের সঙ্গে স্থায়ী না হয় শিল্প কিংবা বাজারের প্রত্যাশার এই মধুচন্দ্রিমা? তখন?

অথচ সব শেয়ার ও ফান্ডের লগ্নি তুলে নিয়ে এই উঁচু বাজার ছেড়ে বেরিয়ে যেতেও একেবারেই মন সায় দিচ্ছে না আপনার। বিশেষত যেখানে প্রত্যাশা ছাপানো মুনাফা বৃদ্ধির কথা ঘোষণা করছে একের পর এক সংস্থা। তা হলে? আমার মতে, এই দোটানায় আপনাকে কিছুটা ভরসা জোগাতে পারে ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ড। এখন বাজারের যা পরিস্থিতি, তাতে ইকুইটি নির্ভর ফান্ডে টাকা ঢালতে এই ধরনের ফান্ড আপনার অন্যতম সেরা বাজি হতে পারে।

দাঁত ভাঙা নাম!

মেনে নিচ্ছি যে, এই ফান্ডের নামটা বেশ খটমট। কিন্তু তা বলে বিষয়টা কিন্তু আদৌ ততটা জটিল নয়। আসুন, একটু সহজ করে বোঝার চেষ্টা করি ডিভিডেন্ড কথাটার সঙ্গে তো আমরা সকলেই পরিচিত। কোনও সংস্থা যখন তার মুনাফার একটা অংশ শেয়ারহোল্ডারদের মধ্যে ভাগ করে দেয়, তাকে আমরা বলি ডিভিডেন্ড। ধরুন কোনও সংস্থা তার আর্থিক ফলাফল ঘোষণার সময় জানাল যে, শেয়ার-পিছু ২ টাকা ডিভিডেন্ড দেবে তারা। তার মানে, হাতে যদি ওই সংস্থার ১০টি শেয়ার থাকে, তবে মোট ২০ টাকা ডিভিডেন্ড ঘরে তুলবেন আপনি।

কিন্তু তা হলে ডিভিডেন্ড ইল্ড কী?

সহজ করে বললে, শেয়ার-পিছু ডিভিডেন্ডের অঙ্ক ওই শেয়ারের বর্তমান বাজার মূল্যের কত শতাংশ, তা-ই হল তার ডিভিডেন্ড ইল্ড।

মনে করুন, শেয়ার-পিছু ২ টাকা ডিভিডেন্ড দিচ্ছে কোনও সংস্থা (সাধারণত তা প্রতি শেয়ারেই দেওয়া হয়)। যার শেয়ারের দর এই মুহূর্তে ৫০ টাকা। সুতরাং তার ডিভিডেন্ড ইল্ড (২/৫০ X ১০০)= ৪%।

লাভের ভাগে লগ্নি

সুতরাং ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ড হচ্ছে সেই সমস্ত ফান্ড, যাদের তহবিল মূলত লগ্নি করা হয় ভাল ডিভিডেন্ড ইল্ড দেওয়া সংস্থাগুলির শেয়ারে।

দেখুন, এমনিতে ডিভিডেন্ড পেতে পছন্দ করেন অধিকাংশ লগ্নিকারীই। কারণ, তাতে সংস্থার লাভের একটা ভাগ অংশীদার হিসেবে তাঁদের পকেটে আসে। তার উপর এতে করও দিতে হয় না। তাই কোনও ফান্ড যদি বিভিন্ন শিল্প ক্ষেত্র থেকে খুঁজে খুঁজে এমন সমস্ত সংস্থায় টাকা ঢালে, যাদের ডিভিডেন্ড ইল্ড বেশি, তা হলে সেই ফান্ডের লগ্নিকারী হিসেবে আপনার তা মন্দ লাগার কথা নয়। আর সেই কারণেই এই ফান্ড বেশ জনপ্রিয়।

কেন এখন ভাল?

আপনি যদি মিউচুয়াল ফান্ডে টাকা ঢালতে আগ্রহী হন, তা হলে এই ফান্ড যে কোনও সময়ই আপনার পোর্টফোলিওতে থাকতে পারে। কিন্তু আমার মতে, বিশেষত বাজারের এখন যা পরিস্থিতি, তাতে লগ্নির কৌশল হিসেবে এই ফান্ড আরও প্রাসঙ্গিক।

একটু খেয়াল করে দেখুন, শেয়ার বাজার দুরন্ত গতিতে সাড়ে ২২ হাজার পেরিয়ে গিয়েছে। প্রায়ই নতুন রেকর্ড গড়ছে সেনসেক্স। কিন্তু তা বলে সব সংস্থা বা সমস্ত শিল্প যে এই উত্থানের একই রকম অংশীদার, তেমনটা কিন্তু মোটেও নয়। কোনও সংস্থার শেয়ার দর দ্রুত বাড়ছে। কেউ আবার হাঁটছে কচ্ছপ-গতিতে। কোনও শিল্পের মুনাফা বৃদ্ধি দেখে যদি ঘোড়দৌড়ের কথা মনে পড়ে, তো তার পাশে আর একটি শিল্প হয়তো নেহাতই শামুক। সুতরাং সকলের মুনাফা তা হলে একই ভাবে বাড়ছে না। আবার মুনাফা হলে যে কোনও সংস্থা মোটা ডিভিডেন্ড ঘোষণা করবেই, এমনও কোনও কথা নেই।

কিন্তু তা হলে আগামী দিনে মুনাফা ভাল হওয়া সংস্থাগুলি যদি তার একটা অংশ ডিভিডেন্ড হিসেবে ভাগ করে দেয়, তবে কি বঞ্চিত হতে চাইবেন আপনি? নিশ্চয়ই না? ফলে সে ক্ষেত্রে ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ড কিন্তু আপনার মোক্ষম অস্ত্র হতে পারে। মনে রাখবেন, এই ফান্ডের লগ্নিকারী হিসেবে দু’দিক থেকে লাভবান হতে পারেন আপনি। এক, ফান্ড ডিভিডেন্ড ঘোষণা করলে, আপনি কর না-দিয়েই তা হাতে পেতে পারেন। আর দুই, যে সব সংস্থার শেয়ারে ফান্ডের লগ্নি রয়েছে, তাদের দর বাড়লেও আপনার পোয়াবারো। কারণ, সে ক্ষেত্রে আপনার লগ্নি (ন্যাভ) ‘গোকূলে’ বাড়বে।

সুতরাং এই ফান্ডে টাকা ঢাললে, দীর্ঘ মেয়াদে বেশ মোটা অঙ্কের সম্পদ তৈরি হতে পারে আপনার। তা ছাড়া, যাঁরা বিভিন্ন ধরনের ইকুইটি-নির্ভর ফান্ডে লগ্নি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে চান, আমার মতে তাঁদের জন্যও কিন্তু এই ফান্ড বেশ ভাল।

মাথায় রাখুন

তা হলে মোদ্দা কথাটা স্পষ্ট ভাবে মাথায় রাখুন। এই ধরনের ফান্ডের তহবিল লগ্নি হচ্ছে সেই সব সংস্থার শেয়ারে, যারা সাধারণত আকর্ষণীয় ডিভিডেন্ড দেয় কিংবা তা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। ফলে এ ক্ষেত্রে—

• আপনার টাকা সেই সমস্ত সংস্থার শেয়ারেই বিনিয়োগ হওয়ার কথা, যাদের আর্থিক ভিত পোক্ত (নইলে মোটা মুনাফা করবে কোথা থেকে?)। এবং একই সঙ্গে যারা সেই লাভ শেয়ারহোল্ডারদের সঙ্গে ভাগ করে নেয়।

• দীর্ঘ মেয়াদে সংস্থাগুলির শেয়ার দর বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আপনার প্রাথমিক লগ্নি ফুলেফেঁপে ওঠার সম্ভাবনা আছে।

• ভাল ডিভিডেন্ড দেওয়ার নজির রয়েছে কিছু ডিভিডেন্ড ইল্ড ফান্ডেরও। গত এক বছরে এ ধরনের বেশ কিছু ফান্ড ২০% রিটার্ন দিয়েছে।

তবে হ্যাঁ, এই ধরনের ফান্ডের সংখ্যা এখনও তেমন বেশি নয়। কোথায় লগ্নি করতে পারেন তা জানতে, সঙ্গের সারণিতে চোখ রাখুন।

ঝুঁকির কাঁটা

শুধু গুণগান শুনে ভুলেও ভাববেন না যে, ঝুঁকির কাঁটা এই ফুলে নেই। অবশ্যই আছে। যেমন

• অন্য যে কোনও ফান্ডের মতো নিশ্চিত রিটার্নের গ্যারান্টি এখানেও নেই। তা সে যত ভাল সংস্থার শেয়ারেই লগ্নি করা হোক না কেন।

• এখানে ফান্ড ম্যানেজারের প্রথম লক্ষ্য, সেই সব সংস্থাকে খুঁজে বার করা, যারা সাধারণত ভাল ডিভিডেন্ড ইল্ড দেয়। ফলে সব সময় যে তা বড় সংস্থা (লার্জ ক্যাপ) হবে, তেমন কোনও কথা নেই। মাঝারিও (মিড ক্যাপ) হতে পারে। ফলে সে ক্ষেত্রে কিছুটা বাড়তি ঝুঁকি থেকেই যায়।

• ডিভিডেন্ড ইল্ডের সংজ্ঞাও অনেক সময় বুমেরাং হতে পারে। হয়তো দেখা গেল, কোনও সংস্থা শেয়ার-পিছু ডিভিডেন্ড এক পয়সাও বাড়ায়নি। কিন্তু তার শেয়ার দর পড়ে যাওয়ার কারণে ওই ইল্ড বেড়ে গিয়েছে।

কী ভাবে? আমরা আগেই দেখেছি, কোনও সংস্থা যদি শেয়ার-পিছু ২ টাকা ডিভিডেন্ড দেয়, আর তার শেয়ার দর হয় ৫০ টাকা, তবে তার ডিভিডেন্ড ইল্ড ৪%। এ বার মনে করুন, ডিভিডেন্ডের অঙ্ক একই রইল। কিন্তু মাঝে মুনাফা পড়ার কারণে শেয়ার দর নেমে এল ৪০ টাকায়। সে ক্ষেত্রে সংস্থাটির ডিভিডেন্ড ইল্ড দাঁড়াবে (২/৪০ X ১০০)= ৫%।

ফলে ফান্ড ম্যানেজারের কম্পিউটারের অ্যালগোরিদ্ম যদি এখন ভাল ডিভিডেন্ড ইল্ড খোঁজে, তবে এই ৫ শতাংশকে তো আরও ভাল মনে হবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নয় তো? এই বিষয়গুলি সম্পর্কে সাবধান থাকবেন।

সুতরাং...

ফান্ড বাছাইয়ের সময় শুধু ডিভিডেন্ড ইল্ডের উপর ভরসা করলে চলবে না। ইকুইটি-নির্ভর ফান্ডে লগ্নি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে দিতে এটি অবশ্যই উপযোগী। কিন্তু তা বলে সব টাকা এখানেই ঢালবেন না। পুরো বিনিয়োগ-কৌশলের খুঁটিও যেন এ ধরনের ফান্ড না হয়।

কেউ ভাল বন্ধু হলেই তার উপর চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করবেন কেন?

লেখক মিউচুয়াল ফান্ড বিশেষজ্ঞ (মতামত ব্যাক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

nilanjan dey mutual fund
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE