Advertisement
১১ মে ২০২৪
Presents
সিইও-র টেবিল থেকে

সংশয় থাকলে বিমা কিনবেন না

এইচডিএফসি লাইফের সিইও এবং এমডি অমিতাভ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় সুপর্ণ পাঠকএইচডিএফসি লাইফের সিইও এবং এমডি অমিতাভ চৌধুরীর সঙ্গে আলাপচারিতায় সুপর্ণ পাঠক

শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৪ ০০:০৫
Share: Save:

• আপনারা সম্প্রতি একটা নতুন পেনশন প্ল্যান এনেছেন। আইনি পরিমণ্ডলেও বেশ পরিবর্তন এসেছে।

দেখুন, পেনশনের ক্ষেত্রে বেশ কিছু দিন ধরেই গ্রাহকদের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কী কী পরিবর্তন আনা উচিত, তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা চলছে। যার মূল জায়গা অবশ্যই স্বচ্ছতা। সেই সঙ্গে যাঁরা বিনিয়োগ করছেন, তাঁদের টাকা যাতে সুরক্ষিত থাকে, তা দেখা। তা ছাড়া, কেউ যদি প্রকল্প থেকে বেরিয়ে যেতে চান, তাঁকেও যাতে অযথা হয়রান হতে না হয়, প্রকল্পে বিনিয়োগ বা সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পদ্ধতি যেন এত জটিল না হয়, যাতে লগ্নিকারীরা কোনও ভাবে অসুবিধায় না পড়েন, এই সমস্ত বিষয়গুলিই চিন্তাভাবনার আওতায় রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে পেনশন, মিউচুয়াল ফান্ড এবং বিমার প্রিমিয়ামে বিনিয়োগের অঙ্ক প্রায় সমান। প্রতি ক্ষেত্রে প্রায় ২৫ লক্ষ কোটি ডলার। সুতরাং প্রিমিয়ামের অঙ্কের নিরিখে পেনশনের বাজার যে কত বড়, তা আমরা মাথাতেই রাখি না।

আমাদের দেশে বেসরকারি ক্ষেত্রে এত লোক কাজ করেন, কিন্তু তাঁদের জন্য এতদিন অবসর ভাতার কোনও ব্যবস্থা ছিল না। ব্যক্তিগত সঞ্চয়ই ছিল অবসরের একমাত্র অবলম্বন। দীর্ঘকালীন সঞ্চয়ের খুব একটা সুযোগও ছিল না। ফিক্সড ডিপোজিটের মতো সঞ্চয়ই ছিল মানুষের পছন্দের লগ্নি গন্তব্য।

এই পরিপ্রেক্ষিতে পেনশন প্রকল্পের সম্ভাবনা বিরাট। তাই পেনশনের জন্য সঞ্চয়কে আপেক্ষিক ঝুঁকির জায়গা থেকেও তুলনামূলক ভাবে নিশ্চিত গন্তব্য করে তোলাও নিয়ন্ত্রক সংস্থার পক্ষে জরুরি ছিল। জোর দেওয়ার জায়গাটা ছিল, লগ্নি যেন মার না খায়।

আমরা চাইছি এই সুযোগটা নিতে। আর একটা কথা মাথায় রাখতে হবে। এ রকম নয় যে, পেনশন প্রকল্প বলে বাজারে কোনও প্রকল্প বিক্রি করা হয়নি। কিন্তু তা ছিল আসলে দীর্ঘকালীন সঞ্চয় প্রকল্প। আপনি পেনশনের নামে দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে কিছু টাকা জমালেন। মেয়াদ শেষে আপনি সেই টাকা হাতে পেলেন। তার পরে সিদ্ধান্ত নিলেন যে, কী ভাবে সেই টাকা দিয়ে অ্যানুইটি কিনে মাসিক আয়ের ব্যবস্থা করা যায়। অর্থাৎ মাসিক আয়ের এবং সঞ্চয়ের জায়গা দু’টো ছিল আসলে দু’টো আলাদা প্রকল্প।

কিন্তু নতুন ব্যবস্থায় এখন এই দুই প্রকল্প মিশে যাচ্ছে একটা প্রকল্পে। পেনশন প্রকল্পে বিনিয়োগ করা মানে এই প্রকল্প থেকেই আপনার অবসর ভাতা আসবে। এই নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে। কিন্তু এখন সিদ্ধান্ত হল, আপনি যে সংস্থার কাছ থেকে পেনশন প্রকল্প কিনবেন, সেই সংস্থা আপনার সঞ্চয় তাদের নিজেদের অ্যানুইটিতে বিনিয়োগ করবে। সহজ কথায়, আপনি যে সংস্থার কাছ থেকে পেনশন প্রকল্প কিনবেন, তার কাছ থেকেই আপনার সঞ্চয়ের অনুপাতে অবসরভাতাও পাবেন। আগে শুধুমাত্র একটা সংস্থার কাছ থেকেই এই সুবিধা পাওয়া যেত।

• কিন্তু বেসরকারি সংস্থায় টাকা রাখতে সাধারণ মানুষ ইতস্তত করে। বাজার অর্থনীতির সঙ্গে পা মিলিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এই সংশয় অনেকটাই কেটেছে। কিন্তু তবু বেসরকারি সংস্থা সম্পর্কে দ্বিধা রয়েই গিয়েছে।

নতুন ব্যবস্থায় তো এই দ্বিধার কোনও জায়গা নেই। প্রতিটি সংস্থাই এখন একই আইনের আওতায়। প্রতিযোগিতার বাজারে কেউ বেশি দেবে আর অন্যরা কম দেবে সেটা তো হবে না। সবাইকেই লড়াই করে বাজার দখল করতে হবে।

এর বাইরেও আমাদের প্রতিটি প্রকল্পকে নিয়ন্ত্রকের সম্মতি নিয়ে বাজারে ছাড়তে হয়। পুরো ব্যবস্থাটাই এখন স্বচ্ছ। কে কত দিচ্ছে তা ক্রেতা নিজেই দেখে নিতে পারবেন।

• পেনশন প্রকল্প নিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন নিয়মগুলো কী?

প্রায় ছ’সাতটা বড় পরিবর্তন এসেছে। প্রথমেই বলি, বিভিন্ন প্রকল্পের নির্দিষ্ট ব্যাখ্যা। এতদিন পর্যন্ত বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে নির্দিষ্ট সংজ্ঞা ছিল না। এ বার সেটা করা হয়েছে। যেমন ইউলিপ। নিয়ন্ত্রক স্পষ্ট বলে দিয়েছে, ঠিক কী ভাবে একটা বিমা প্রকল্প তার বিনিয়োগ পরিকল্পনা করলে তাকে ইউলিপ বলা যাবে।

আবার প্রত্যেকটা প্রকল্পের ক্ষেত্রে বলে দেওয়া আছে বিমাকারীকে ন্যূনতম কত বিনিয়োগ করতে হবে, বিমা সারেন্ডার করলে সে বাবদ কত টাকা কাটতে পারবে একটি সংস্থা ইত্যাদি। বিমাকারী মারা গেলে কী ভাবে তাঁর টাকা ফেরত দিতে হবে, তা-ও বলে দেওয়া আছে নতুন নিয়মে। বলা আছে কোন কোন ক্ষেত্রে গ্যারান্টির প্রয়োজন আছে, তা-ও।

প্রথাগত প্রকল্পের ক্ষেত্রেও নানা গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়েছে।

আগে সারেন্ডার করলে, বিমাকারী প্রায় কিছুই ফেরত পেতেন না। মেয়াদ শেষের আগে প্রিমিয়াম বন্ধ করলে ক্ষতি হত গ্রাহকেরই। আর লাভ হত বিমা সংস্থার। নতুন নিয়মে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কত দিন ধরে প্রিমিয়াম দিয়ে বন্ধ করে দিলে কত টাকা ফেরত পাওয়া যাবে, তা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে।

এর ফলে লাভ হয়েছে গ্রাহকদেরই। কারণ, বিমার ক্ষেত্রে গ্রাহকদের যে কোনও সমস্যার সমধান দ্রুত হবে। তাঁদের অযথা ঘুরতে হবে না।

• পরিবর্তিত এই নিয়ম আপনি বলছেন বিমার সার্বিক পরিমণ্ডলে স্বচ্ছতা এনেছে। কিন্তু যাঁরা ধরুন এই পরিবর্তন হওয়ার আগে পলিসি কিনেছেন, তাঁরাও কী এই সমস্ত কিছুর সুযোগ পাবেন?

যাঁরা আগে কিনেছেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এই পরিবর্তন প্রযোজ্য নয়।

• মিসসেলিং কথাটা এখন সাধারণ মানুষের আলোচনায় নিত্য ব্যবহৃত। নানা মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে এজেন্টরা সাধারণ মানুষকে বোকা বানিয়ে পলিসি বিক্রি করছেন। বিমা সংস্থার কর্মীরাও যে এর সঙ্গে জড়িত নন, তা জোর করে বলা যায় না। বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ গ্রাহক যখন এই নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন, তখন স্থানীয় অফিস চেষ্টা করছে ঘটনাটা ধামাচাপা দেওয়ার।

এটা একটা বিরাট সমস্যা। এটা এই ভাবে ঘটছে— আপনি একটা পলিসি সারেন্ডার করলেন। তার টাকাও পেয়ে গেলেন। এ বার আপনাকে কেউ ফোন করল। বলল, “আপনার এখনও কিছু টাকা পাওনা আছে। আমি আপনাকে সাহায্য করতে পারি। তবে তার জন্য এই টাকা দিয়ে একটা পলিসি কিনতে হবে আপনাকে।”

আপনি ভাবলেন, ক্ষতি কী? তখন সেই এজেন্ট কাগজপত্র সই করিয়ে আপনাকে বলল, “অল্প কিছু টাকা আপনাকে আরও দিতে হবে।” বা এ ধরনেরই কিছু হয়তো বলল। আপনি আর একটা পলিসি কিনে ফেললেন। অথচ আপনার ওই পলিসি কেনার কোনও দরকারই ছিল না।

এটা গোটা শিল্পের পক্ষে খারাপ হচ্ছে। সাধারণ গ্রাহক ভাবছেন বিমা সংস্থাগুলো গ্রাহকদের ঠকাতেই চায়।

আমরা এই সমস্যা ঠেকাতে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছি। এই ধরনের জালিয়াতি যেখানেই হচ্ছে সেখানেই আমাদের সহকর্মীরা আইনের সাহাহ্য নিচ্ছেন। কিন্তু এখানেও একটা সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এই ধরনের সমস্যায় অনেক সময়ই পুলিশ চট করে কোনও পদক্ষেপ করতে চায় না।

আমরা তাই এখন কোনও পলিসি প্রস্তাব পেলে, গ্রাহককে সরাসরি ফোন করছি। কিন্তু এখানেও সমস্যা আছে। এই এজেন্টরা গ্রাহকদের বলে দিচ্ছেন, সব কিছুতেই হ্যাঁ বলতে। গ্রাহকদের বলা হচ্ছে, অন্য কিছু বললে সমস্যা হবে। গ্রাহকদের যে ফোন নম্বরটা দেওয়া হচ্ছে, সেটাও ওদেরই।

• তা হলে?

এই সমস্যা এড়াতে আমরা এখন বাড়িতে গিয়ে গ্রাহকদের সঙ্গে সরাসরি কথা বলছি। এখানেও সমস্যা হচ্ছে। গ্রাহকরা অনেক সময় দেখা করতে চাইছেন না। ছবি তুলতে চাইছেন না। আমাদের কর্মীদের সঙ্গে আই প্যাড বা ট্যাব থাকে। তাতে পলিসি কেনার সময় গ্রাহক যে তথ্য দিচ্ছেন, তা সঙ্গে সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়। এতে গ্রাহকদেরই সুবিধা হয়। কোনও রকম জোচ্চুরির শিকার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না।

সব বিমা সংস্থাই কিন্তু এখন চেষ্টা করছে যাতে গ্রাহকরা কোনও হেরাফিরির শিকার না হন।

আর একটা সমস্যা রয়েছে। অনেক সময়ই গ্রাহকদের যে ভুল পলিসি বিক্রি করা হয়, তা নয়। গ্রাহকদের যখন তাঁদের চাহিদা শুনে পলিসির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে বোঝানো হয়, তখন তাঁরা মন দিয়ে তা শোনেন না। এখান থেকেও সমস্যা শুরু হয়। পরে গিয়ে তাঁরা যখন বোঝেন, যে পলিসি তাঁরা কিনেছেন, আসলে সেই পলিসি তাঁর চাহিদা অনুযায়ী নয়, তখন তাঁরা বলতে থাকেন যে, তাঁদের ঠকানো হয়েছে।

তাই পলিসি বিক্রি করার পরে আবার গ্রাহকদের সঙ্গে যাচাই করে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, যে পলিসি তিনি কিনছেন, ঠিক সেই পলিসিই তিনি চেয়েছিলেন কি না।

নতুন ব্যবস্থায় আপনি পলিসি কিনলে, পলিসি বন্ডের সঙ্গে যে যে কাগজে আপনি সই করেছেন, তার ফটোকপিও আপনাকে পাঠানো হবে। যাতে আপনি যাচাই করে নিতে পারেন যে কী কী কাগজে সই করেছেন।

এর পরেও সমস্যা হচ্ছে। কলকাতাতেই এ রকম ঘটনা ঘটেছে। পলিসি কেনার পরে গ্রাহকের হঠাৎ মনে হয়েছে পলিসিটি তাঁর মনের মতো নয়। ব্যস, পুলিসের কাছে গিয়ে নালিশ। তাঁর সই জাল করে যে পলিসি তিনি চাননি, সেটাই তাঁকে বিক্রি করা হয়েছে। অথচ চুক্তিতে করা সইয়ের সঙ্গে তাঁর সই হুবুহু এক।

সমস্যার এই দিকটাও কিন্তু আমাদের মাথায় রাখতে হবে। তবে মিসসেলিং একটা বড় সমস্যা। শুধু আমাদের দেশে নয়, বিশ্বব্যাপী।

আমরা তাই সমীক্ষা শুরু করেছি। যাঁরা কথা বলতে রাজি হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, কোনও অভিযোগ নেই। তিন থেকে পাঁচ শতাংশের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, পলিসি নিয়ে তাঁরা পুরোপুরি খুশি নন। যাঁরা বলছেন তাঁরা একেবারেই খুশি নন, তাঁদের কাছে পলিসি বিক্রি করা হচ্ছে না।

• পলিসি-চুক্তি ইংরেজিতে লেখা থাকে। এমনিতে শিক্ষিত মানুষই আইনি ইংরেজি বুঝে উঠতে পারেন না। সাধারণ মানুষ তো আরও পারবেন না। সমস্যা তো এখানেই লুকিয়ে রয়েছে।

ঠিকই। পলিসি চুক্তির ভাষা একটু খটমট। আমরা এটা এড়াতে স্থানীয় ভাষায় পুস্তিকা তৈরি করে গ্রাহকদের দিচ্ছি। আগামী দিনে পলিসি বন্ডও ডিম্যাট হয়ে যাবে। আপনি হাতে পলিসি পাবেন না। কিন্তু আমরা আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছি। যাতে এই সমস্ত সমস্যা সামলানো যায়।

এটা এড়ানোর উপায় একটাই। সততা কেন জরুরি, তা সবারই বোঝা উচিত। কারণ, এতে তো সবারই ক্ষতি। এটা আমাদের বুঝতে হবে।

• গ্রাহকদের আপনি কী পরামর্শ দেবেন?

বিমা কেনার আগে বুঝে কিনুন। বিন্দুমাত্র সংশয় থাকলে বিমা কিনবেন না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

suparna pathak
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE