Advertisement
০৫ ডিসেম্বর ২০২৫
Hakkoda Mountains Tragedy

বরফের রাজ্য থেকে বেঁচে ফিরতে পারেননি ১৯৯ জন সেনা, হাক্কোদার পাহাড়ে আজও ‘শোনা যায়’ আর্তনাদ!

১৯০২ সালের জানুয়ারি মাস। রুশ–জাপান যুদ্ধ আসন্ন। অতিরিক্ত ঠান্ডায় কী ভাবে যুদ্ধ করা যায়, যে কোনও উপায়ে তার কৌশল আয়ত্ত করতেই হবে জাপানকে। মোট ২১০ জন সেনা নিয়ে হাক্কোদায় শুরু হল ঠান্ডায় টিকে থাকার প্রশিক্ষণ। কিন্তু প্রশিক্ষণ শেষে ফিরলেন মাত্র ১১ জন। তা-ও ভয়াবহ অভিজ্ঞতা নিয়ে।

আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ৩০ অগস্ট ২০২৫ ১৭:২৭
Share: Save:
০১ ১৭
Hakkoda Tragedy

১৯০৪-এর ৮ ফেব্রুয়ারি, শুরু হয় রুশ-জাপান যুদ্ধ। কোরিয়া ও মাঞ্চুরিয়ায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। কিন্তু এই যুদ্ধের আগে জাপানি সেনাদের অতিরিক্ত ঠান্ডা আবহাওয়ায় টিকে থাকার কৌশল শেখানোর কারণে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কী ভাবে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও টিকে থাকা যায় তা শেখার জন্য ২১০ জন সেনাকে পাঠানো হয়েছিল উত্তর জাপানের হাক্কোদায়।

০২ ১৭
Hakkoda Tragedy

২১০ জন সেনা প্রশিক্ষণের স্বার্থে গেলেও ফিরে এসেছিলেন মাত্র ১১ জন। বাকি ১৯৯ জনের মৃত্যু হয় হাক্কোদা পাহাড়ের বরফের মধ্যে। বেশির ভাগ সেনার হাত-পা জমে যায় ঠান্ডায়। ‘ফ্রস্টবাইট’-এর শিকার হন তাঁরা। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত লড়াই চালানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হয় তাঁদের।

০৩ ১৭
Hakkoda Tragedy

১৯০২ সালের ২৩ জানুয়ারি। ২১০ জন জাপানি সেনা শুরু করেন হাক্কোদা অভিযান। নাম দেওয়া হয় ‘হাক্কোদা স্নো মার্চ’। সময় যত বাড়তে থাকে তাপমাত্রা ক্রমশ কমতে থাকে। এক সময় হিমাঙ্কের ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি নীচে নেমে যায় তাপমাত্রা। তার সঙ্গে শুরু হয় প্রবল তুষারঝড়। বন্দুকও ধরতে পারছিলেন তাঁরা। ঠান্ডার সঙ্গে যুঝতে সেনারা কোনও মতে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

০৪ ১৭
Hakkoda Tragedy

অভিযানের উচ্চপদস্থ কর্তারা ভেবেছিলেন শীতের পাহাড়ে সৈন্যদের কষ্ট সহ্য করার ক্ষমতা যাচাই করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে এটি যে মৃত্যুফাঁদ হয়ে দাঁড়াবে তা কল্পনাতেও ছিল না কারও। মেজর টোকোহিরো ইয়াসুমা নেতৃত্বে ছিলেন এই অভিযানের। এ ছাড়াও মাঠে নেমে নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন বুমকিচি কাননারি। যদিও দু’জনের কেউই শেষ পর্যন্ত বেঁচে ফিরতে পারেনি।

০৫ ১৭
Hakkoda Tragedy

অভিযানের জন্য প্রয়োজনীয় কিছুই ছিল না সেনাদের কাছে। দুর্বল পরিকাঠামোকেই এত সেনার মৃত্যুর অন্যতম কারণ হিসাবে দাগিয়েছেন গবেষকেরা। সেনাদের কাছে না ছিল পর্যাপ্ত খাবার, না ছিল শীতের সঙ্গে লড়াই করার মতো পোশাক। সৈন্যদের গায়ে ছিল পাতলা কোট, পায়ে সাধারণ বুট। বিশেষ জুতো, গগলস কিংবা সঠিক খাবার কিছুই ছিল না তাঁদের কাছে।

০৬ ১৭
Hakkoda Tragedy

২১০ জন সেনার যাত্রা শুরু হয় আওমোরি থেকে। শুরুতেই প্রচণ্ড ঝড়ের সম্মুখীন হন তাঁরা। শোনা যায়, যাত্রা শুরুর সময়ই সেখানকার গ্রামবাসীরা সেনাদের সতর্ক করেছিলেন। তাঁরা নাকি বলেছিলেন, “এ সময়ে হাক্কোদায় যাওয়া মানে আত্মহত্যা।” যদিও তাঁদের কথাকে নাকি তোয়াক্কাই করা হয়নি বলে অভিযোগ উঠেছিল।

০৭ ১৭
Hakkoda Tragedy

ধীরে ধীরে ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে থাকেন সেনারা। প্রবল বৃষ্টিতে যেমন হাঁটুসমান জল জমে যায়, তুষারঝড়ে তেমনই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। এই হাঁটুসমান বরফই ধীরে ধীরে সেনাদের বুকসমান হয়ে যায়। ঠান্ডা হাওয়ার দাপট এতটাই প্রবল ছিল যে শ্বাস নিতেও কষ্ট হচ্ছিল তাঁদের।

০৮ ১৭
Hakkoda Tragedy

তাঁদের পথপ্রদর্শকও দিক্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ছিলেন। কম্পাস আর মানচিত্র থাকা সত্ত্বেও দিক বোঝা যাচ্ছিল না। জাপানি সেনারা পরে এই যাত্রাকে উল্লেখ করে বলেন, ‘‘মানব ইতিহাসে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর হোয়াইটআউট।’’ পথ হারিয়ে যাওয়ার ফলে অনেক সেনা দলছুট হয়ে পড়েন। একা একা ঘুরতে থাকেন। কয়েক ঘণ্টা কেটে গেলেও সেই সেনাদের কোনও হদিসই আর মেলেনি।

০৯ ১৭
Hakkoda Tragedy

পিঠে ভারী বোঝা, অল্প খাবারের কারণে সৈন্যদের শরীর ধীরে ধীরে ভেঙে পড়ছিল। হালকা কোটও হার মানছিল প্রবল ঠান্ডা ঝড়ের কাছে। অভিযানের প্রথম দিনেই মৃত্যু হয় বেশ কিছু সেনার। অনেকেই বরফের মধ্যে পড়ে যান। সহযোদ্ধারা অনেক চেষ্টা করলেও মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে নিথর হয়ে যায় সেনাদের দেহ।

১০ ১৭
Hakkoda Tragedy

একসময় নাকি চারপাশে শুধু ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ আর্তনাদ শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সেই চিৎকারও দ্রুত ঝড়ের সঙ্গে মিলিয়ে যাচ্ছিল। সেনাদের থেকে কয়েকশো মিটার দূরেই ছিল মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচার ঘর। কিন্তু আশ্রয়ের কাছে গিয়েও শেষমেশ ব্যর্থ হন তাঁরা।

১১ ১৭
Hakkoda Tragedy

সেনারা বার বার ফিরে যাওয়ার অনুরোধ জানালেও কোনও লাভ হয়নি। অভিযানের নেতৃত্বে যাঁরা ছিলেন, তাঁরা কেউই আবেদনে সাড়া দেননি। তাঁরা নাকি বার বার বলেছিলেন, “ফিরে যাওয়া কাপুরুষের কাজ।” তাঁর এই জেদে প্রাণ যায় ১৯৯ জনের।

১২ ১৭
Hakkoda Tragedy

কিছু সেনা বরফ খুঁড়ে বসে বাঁচার চেষ্টা চালান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সেই গর্তই তাঁদের কাছে কবর হয়ে দাঁড়ায়। দল বেঁধে শেষ শক্তি দিয়ে একে অপরকে আগলে রাখলেও শীতের কাছে শেষ পর্যন্ত হার মানতে বাধ্য হন তাঁরা। একসঙ্গে অনেকেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলেন বরফের মধ্যে

১৩ ১৭
Hakkoda Tragedy

যাঁরা বেঁচে ছিলেন তাঁরা এতটাই দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন যে দাঁড়ানোর ক্ষমতাটুকুও হারিয়ে গিয়েছিল। মুখে বরফ জমে যাচ্ছিল। চোখ খোলা থাকলেও নিঃশ্বাস পড়ছিল না আর! শেষমেশ উদ্ধারকারীর দল কোনও মতে পৌঁছোয় হাক্কোদায়। তারা গিয়ে দেখে, মাত্র ১১ জন কোনও মতে টিকে রয়েছেন। তাঁদের শরীরের বেশির ভাগ অঙ্গই ফ্রস্টবাইটে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কেউ কেউ সহযোদ্ধার মৃতদেহের পাশে গা ঘেঁষে শুয়ে শরীর গরম রাখার চেষ্টা করেছিল বলেও শোনা যায়।

১৪ ১৭
Hakkoda Tragedy

মর্মান্তিক দৃশ্য চাক্ষুষ করেছিলেন উদ্ধারকারীরা। কেউ হাঁটু গেড়ে বসে ছিলেন, কেউ হাত বাড়িয়ে রেখেছেন, অনেক মৃত সেনার হাতে বন্দুক শক্ত করে ধরা ছিল, কারও আবার ডায়েরির পাতায় লেখা ছিল শেষ কথা— সব মিলিয়ে যেন শেষ মুহূর্তে অদৃশ্য কিছুকে আঁকড়ে ধরার চেষ্টা করছিলেন তাঁরা। কাছে যাওয়ার পরে বোঝা গিয়েছিল যে সকলেই মৃত। বলা হয়, একসঙ্গে ১৯৯ জনের মৃত্যুর ‘আর্তনাদ’ আজও পাহাড়ের বুকে শোনা যায়।

১৫ ১৭
Hakkoda Tragedy

এমন ঘটনায় পুরো দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। সমালোচনা এড়াতে প্রথমে সত্য গোপন করার চেষ্টা করা হয় বলেও দাবি। কিন্তু পরে সামনে চলে আসে গোটা ঘটনা। যদিও পরের বছর থেকেই বিশেষ শীতকালীন সরঞ্জাম মজুত রাখা বাধ্যতমূলক হয়েছিল বলেও খবর পাওয়া যায়।

১৬ ১৭
Hakkoda Tragedy

যা যা নথি উদ্ধার হয়েছিল, সবই জাপানের সামরিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে। মৃতদের স্মৃতিচারণ করা হয় প্রতি বছর। মেমোরিয়াল মার্চ আয়োজন করা হয় হাক্কোদা পর্বতে। সেখানে জাপানি সেনারা অংশ নেন। এই ভুল যেন আর না হয় সেই শপথ নেন তাঁরা। এই ঘটনার এতটাই প্রভাব পড়েছিল জাপানি সংস্কৃতিতে যে, এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৭৭-এ ‘মাউন্ট হাক্কোদা’ নামে একটি সিনেমাও তৈরি হয়েছিল।

১৭ ১৭
Hakkoda Tragedy

গবেষকরা বলেন, এটা শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগ নয়, বরং ‘কমান্ড ডিসিপ্লিন’ বনাম বাস্তব অভিজ্ঞতার সংঘর্ষ। স্থানীয়েরা পথ চিনতেন, কিন্তু সেনারা ‘সামরিক গর্বে’ তা অগ্রাহ্য করেছিলেন। এর ফলেই মৃত্যু হয় প্রায় গোটা বাহিনীর। ইতিহাসবিদেরা জানান, হাক্কোদা অভিযান শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার স্বার্থে আয়োজিত হলেও প্রকৃতির বিরুদ্ধে নয়। আর প্রকৃতিকে অবহেলা করলে ইতিহাস সবচেয়ে নির্মম শাস্তি দেয় বলেই মত ইতিহাসবিদদের।

সব ছবি: সংগৃহীত।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy