ইংরেজ আমলের কলকাতায় ‘ফিরিঙ্গি উৎসব’ পালন নিয়ে দেশ পত্রিকায় এক সুখপাঠ্য নিবন্ধ লিখেছিলেন রাধাপ্রসাদ গুপ্ত। তাঁর লেখার অনুসরণে আসুন ফিরে যাই কয়েকশো বছর আগে। যখন কলকাতায় উদযাপনে মেতে উঠতেন লালমুখো গোরা সাহেবরা, নিজেদের মতো করে। তাঁদের বড়দিন ও নিউ ইয়ার্স ইভ উদযাপনের জাঁকজমক ও বিলাস বৈভব ছিল চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়ার মতো।
১৮০০ খ্রিস্টাব্দ বা তার আগে ব্রিটিশদের কাছে গ্রীষ্মে কলকাতা-যাপন ছিল দুর্বিষহ। কারণ তখন টানাপাখাও ছিল না। বর্ষায় ছিল নানা রোগের প্রাদুর্ভাব। ফলে শীতকাল এলে স্বভাবতই সাহেবদের আনন্দ কয়েকগুণ বেড়ে যেত। ধর্মীয় কারণের পাশাপাশি এই যে গরমের হাত থেকে নিষ্কৃতি, সেটাই ছিল উদযাপনের একটা উপলক্ষ। এমনকি, মাঝে মাঝে খাস বিলেতের থেকেও বেশি রঙিন হত কলকাতার সাহেবপাড়ার বড়দিন ও নিউ ইয়ার্স ইভের ভোজসভা।
খাস বিলেতে ১৮৪৬ সালে বড়দিন ও নতুন বছরের কার্ড দেওয়ার রীতি শুরু করেন জেটি হরসলি বলে এক শিল্পী। ব্যবসায়িক ভাবে গ্রিটিংস কার্ডের প্রচলন লন্ডন ও প্যারিসে শুরু হয় ১৮৬০ সাল নাগাদ। কলকাতায় গ্রিটিংস কার্ড আসার আগে ব্রিটিশরা হাতে লেখা চিঠি আদানপ্রদান করত। অনেকটা আমাদের বিজয়ার চিঠির মতো। পার্বণ উদযাপনের চিরাচরিত অংশ হিসেবে ছিল গির্জায় মিডনাইট মাস এবং ফিরিঙ্গিপাড়ার দোকানে দেদার কেনাকাটা।
বড়দিন বা নতুন বছর উপলক্ষে উপহার দেওয়া নেওয়ার বহরও ছিল দেখার মতো। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উপহারের ডালিতে থাকত হিরের আংটি থেকে বুখারা ঘোড়া! এই ‘ডালি’ শব্দটাও ভারতীয় শব্দভাণ্ডার থেকে নিয়েছিলেন ব্রিটিশরা। তাঁরা একে বলতেন ‘ডলি’। বাড়ি বা এস্টেটের সরকার-বেয়ারা-খানসামা-সহ অন্য কর্মচারীরা মাছ-মাংস, কেক, ফলমূল সাজিয়ে ‘ডলি’ দিতেন ব্রিটিশ মনিবকে। এবং অলিখিত নিয়ম অনুযায়ী পাল্টা আরও অনেক দামি উপহার ফিরিয়ে দিতে হত মনিবপক্ষকেও। সেটাও সাহেব-মেমদের কাছে কম ঝামেলার ছিল না!
ওয়ারেন হেস্টিংসের আমলে সরকারি চাকুরেদের আলাদা কারবার করা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে নবাবি কেতায় বড়দিন পালন অনেকটাই ম্রিয়মান হয়ে পড়ে। কিন্ত যা অবশিষ্ট ছিল, তাতেও চোখ ধাঁধিয়ে যাওয়ার উপক্রম! সপ্তদশ শতকের শেষ দিকে উইলসম বা গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একতলার হলঘরটি ছিল ক্রিসমাস ইভ-এর অন্যতম মিলনক্ষেত্র। রকমারি খাবার আর পানীয়ের সমাহারে সেই ভোজসভায় গভীর রাত অবধি চলত খানা-পিনা আর বল নাচ।
পরে গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একতলার হলঘরটিকে ভেঙে ছোট করে বসানো হয় দোকানপাট। ফলে ফিরিঙ্গদের এই মিলনোৎসব বন্ধ হয়ে যায়। পাশাপাশি, গোরা পল্টন ও জাহাজিদের আড্ডার ঠেক ছিল লালবাজারের ট্যাভার্ন বা পাঞ্চ হাউজগুলি। হ্যারি হবসের কথায়, এই শুঁড়িখানাগুলিতে রোজই ছুটত মদের ফোয়ারা। বড়দিন আর নতুন বছর এলে তো আর কথাই থাকত না। লাগামছাড়া হয়ে যেত ফুর্তি।
রাধাপ্রসাদ গুপ্ত তাঁর নিবন্ধে লিখেছেন, ফিরিঙ্গি কলকাতার বড়দিন এবং নিউ ইয়ারের ভোজসভার মূল আকর্ষণ ছিল ‘বোরস হেড’ বা শূকরের মাথা। তেজপাতা, আপেল আর অন্য উপকরণ দিয়ে সাজিয়ে তা পরিবেশন করা হত। সঙ্গে থাকত সুস্বাদু টার্কি, ডাকরোস্ট, ক্রিসমাস পাই, প্লাম পুডিং, ট্যাঞ্জারিন লেবু, খেজুর, বাদাম, কিসমিস আর চকোলেট। পানীয়ের মধ্যে নানারকমের ওয়াইন এবং বড়দিনের বিশেষ পানীয় ‘রামপাঞ্চ’।
এ তো গেল সাহেবদের কথা। পরবর্তী কালে দেশীয় খ্রিস্টানদের বড়দিন ও নতুন বছরের উৎসব পালনের একটি অঙ্গ ছিল নগর সংকীর্তন। রীতিমতো খোল করতাল বাজিয়ে খ্রিস্ট-সঙ্গীত গাইতে গাইতে নগর পরিক্রমা করা হত। তবে গোঁড়া মিশনারি এবং ক্যাথলিকরা খ্রিস্টানমহল এই বিষয়টি সুনজরে দেখতেন না। তাঁদের মতে, এর ফলে ‘হিঁদুয়ানি আর পৌত্তলিকতা’ প্রবেশ করেছিল খ্রিস্টান ধর্মে। কিন্তু তাঁদের আপত্তি ধোপে টেকেনি। বড়দিন উপলক্ষে এই রীতি বহুদিন ধরে পালিত হত কলকাতায়।
বড়দিন বা নতুন বছরের আগমনে এলাহি আয়োজনে উদযাপনে আপত্তি ছিল রক্ষণশীল খ্রিস্টান মহলে। কিন্তু সেই আপত্তি চাপা পড়ে গিয়েছিল ব্রিটিশ শাসকদের আমোদপ্রমোদে। তাঁদের দেখাদেখি ক্রমে বাঙালি বাবুদের কাছেও বড়দিন উদযাপনের উৎসব হয়ে দাঁড়াল। কলকাতা ও তার আশেপাশে বাগানবাড়িতে বড়দিন উপলক্ষে নাচগানের আসর বসাতেন বাবুরা। মাঝে মাঝে সেখানে আমন্ত্রিত থাকতেন সাহেবরাও। ভোজ আর পানীয়ের বন্যায় রাতভর চলত ‘বড়দিন’।
সেই ধারা চলেছে আজও। এখন আর শুধু বাবু শ্রেণি নয়। বরং, বড়দিন আর নিউ ইয়ার্স ইভ এখন সর্বজনীন। সাহেবি কেতা বিদায় নিয়েছে। কিন্তু বাঙালিদের উদযাপনের জোয়ার দিন দিন বাড়ছে। নড়তে নড়তে, চলতে চলতে আমাদের কলকাতা আছে কলকাতাতেই। ঋণস্বীকার: ‘কলকাতায় বড়দিন: সেকাল একাল’, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, দেশ পত্রিকা, ১৮.১২.৯৩। ছবি: আর্কাইভ,শাটারস্টক এবং সোশ্যাল মিডিয়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy