চন্দ্রপৃষ্ঠে চিনা রকেট বুস্টার আছড়ে পড়ে জোড়া গর্ত তৈরি করেছে বলে জানিয়েছে নাসা। আমেরিকার দাবি, চাঁদ দখলের পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। যদিও সমস্ত অভিযোগ অস্বীকার করেছে ড্রাগন।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১১:২৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
চাঁদ দখলের নেশায় মজে ড্রাগন! চিনা রকেট বুস্টার চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়তেই দুনিয়া জুড়ে এই খবর রাষ্ট্র করে বেড়াচ্ছে আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের এ-হেন আশঙ্কাকে একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কারণ বেজিঙের রকেট বুস্টারের ধাক্কায় চাঁদের গায়ে তৈরি হয়েছে দু’টি বড় গর্ত। শুধু তা-ই নয়, সেখান থেকে নির্গত হয়েছে বিপুল পরিমাণ শক্তিও। যদিও গোটা বিষয়টিকে ‘আমেরিকার চক্রান্ত’ বলে উড়িয়ে দিয়েছে চিনের শি জিনপিং সরকার।
০২২১
২০২২ সালের ৪ মার্চ। বিকেল ৪টে ৫৫ মিনিট নাগাদ একটি উড়ন্ত বস্তুকে বিদ্যুৎগতিতে চাঁদের দিকে ধেয়ে যেতে দেখেন আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সঙ্গে সঙ্গেই বুলেট গতিতে ছুটে চলা বস্তুটি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হয়ে পড়েন তাঁরা। কিন্তু, সেই সুযোগ একেবারেই পাননি মার্কিন মহাকাশ গবেষকেরা। কারণ, চোখের নিমেষে বস্তুটি ছুটে গিয়ে চন্দ্রপৃষ্ঠে মারে রামধাক্কা!
০৩২১
মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দাবি, ওই বস্তুটির ধাক্কায় চাঁদের বুকে ঘটে এক বিরাট বিস্ফোরণ। ফলে সেখান থেকে লাগাতার শক্তি নির্গত হতে শুরু করে। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতটাই ছিল যে, তাতে এক লহমায় ধুলোয় মিশে যেত গোটা মুম্বই শহর, বলছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা।
০৪২১
চন্দ্রপৃষ্ঠে এই ধরনের বিস্ফোরণের ঘটনা নতুন নয়। কিন্তু মার্কিন গবেষকদের এ ক্ষেত্রে বিষয়টিকে আলাদা করে দেখার নেপথ্যে অন্য কারণ রয়েছে। তাঁরা জানিয়েছেন, বাইরে থেকে আসা কোনও বস্তুর এক ধাক্কায় চাঁদের বুকে একসঙ্গে দু’টি গর্ত তৈরি হওয়ার ঘটনা বিরল। গর্তগুলি এতটাই বড় যে সেখানে অনায়াসেই একসঙ্গে চার চারটি স্কুলবাস পার্কিং করা যাবে বলে স্পষ্ট করেছে নাসা।
০৫২১
এই নিয়ে কিছু দিন গবেষণার পর মার্কিন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা চন্দ্রপৃষ্ঠে ধাক্কা মারা ওই উড়ন্ত বস্তুটিকে চিনের রকেট বুস্টার বলে চাঞ্চল্যকর দাবি করে বসেন। বিষয়টি নিয়ে সংবাদমাধ্যমের কাছে মুখ খোলেন নাসার তৎকালীন অ্যাডমিনিস্ট্রেটর বিল নেলসন। আরও এক কদম এগিয়ে তিনি বলেন, ‘‘একটু একটু করে চাঁদের জমি দখল করার পরিকল্পনা রয়েছে বেজিঙের। সেই লক্ষ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে সাফল্যও পেয়েছে ড্রাগন।’’ তাঁর ওই মন্তব্যের পর দুনিয়া জুড়ে রীতিমতো হইচই পড়ে যায়।
০৬২১
নাসা অ্যাডমিনিস্ট্রেটর যে এ কথা হাওয়ায় বলেছিলেন, এমনটা নয়। ২০১৯ সালে ‘চ্যাংই-৪’ নামের একটি কৃত্রিম উপগ্রহকে চাঁদের দূরতম প্রান্তে অবতরণ করায় চিন। পৃথিবী থেকে চন্দ্রপৃষ্ঠের ওই অংশটি দেখতে পাওয়া যায় না। সেখানে কৃত্রিম উপগ্রহ অবতরণকারী প্রথম দেশ হিসাবে ১৬ আনা কৃতিত্ব রয়েছে ড্রাগনের।
০৭২১
‘চ্যাংই-৪’ চন্দ্র মিশন সফল হতেই রাশিয়ার সঙ্গে হাত মেলায় চিন। ২০৩০ সালের মধ্যে আরও দু’টি চন্দ্রাভিযানের পরিকল্পনা ইতিমধ্যেই সেরে ফেলেছে এই দুই দেশ। এর মধ্যে প্রথমটি হবে ২০২৬ সালে। ওই বছর চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠানোর ইচ্ছা রয়েছে বেজিঙের।
০৮২১
দ্বিতীয় মিশনে রাশিয়ার সাহায্যে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনের আদলে চাঁদের বুকে ‘লুনার রিসার্চ স্টেশন’ গড়ে তোলার চেষ্টা চালাবেন বেজিঙের জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তবে ২০২৭ সালের আগে ওই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হওয়ার সম্ভাবনা কম। চাঁদের দক্ষিণ মেরুতে ‘লুনার রিসার্চ সেন্টার’ তৈরি করতে চায় চিন, সূত্র মারফত মিলেছে খরব।
০৯২১
নাসার বিজ্ঞানীদের দাবি, চন্দ্রপৃষ্ঠে স্থায়ী গবেষণা কেন্দ্র তৈরি করে ফেলতে পারলেই বেজিঙের হাতের মুঠোয় চলে আসবে পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ। তখন সেখানে অন্য কোনও দেশের কৃত্রিম উপগ্রহ অবতরণের সুযোগই পাবে না। চাঁদের জমি ও খনিজের একচ্ছত্র দখল চিন নিজের কাছে রাখতে চায় বলেও জানিয়েছেন তাঁরা।
১০২১
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের একাংশ অবশ্য ড্রাগনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের এই ধরনের অভিযোগ নিয়েই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কারণ, গত শতাব্দীর ঠান্ডা লড়াইয়ের সময়ে চাঁদকে কয়েকটি খণ্ডে টুকরো করার নীল নকশা ছকে ফেলেছিল মার্কিন প্রশাসন। যদিও পরে সেই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে ওয়াশিংটন।
১১২১
১৯৫০-এর দশকে তৎকালীন সোভিয়েত রাশিয়া এবং আমেরিকার মধ্যে শুরু হয় মহাকাশ প্রতিযোগিতা। সেখানে প্রাথমিক পর্যায়ে ওয়াশিংটনের থেকে অনেকটাই এগিয়ে ছিল মস্কো। সোভিয়েতের পর পর সাফল্য দেখে ১৯৫৮ সালে ভয়ঙ্কর এক সিদ্ধান্ত নেয় যুক্তরাষ্ট্র। ঠিক হয়, চন্দ্রপৃষ্ঠে ঘটানো হবে বড় আকারের বিস্ফোরণ, যা পৃথিবী থেকে স্পষ্ট দেখতে পাবে আমজনতা। গোটা অপারেশনের দায়িত্ব পান পদার্থবিজ্ঞানী লিওনার্ড রিফেল এবং মার্কিন বায়ুসেনা।
১২২১
আমেরিকার অত্যন্ত গোপন এই মিশনের নাম ছিল ‘প্রজেক্ট এ১১৯’। কিন্তু পরিকল্পনামাফিক কাজ শুরু করতে গিয়ে হোঁচট খায় মার্কিন প্রশাসন। তারা বুঝতে পারে, চাঁদে আণবিক বিস্ফোরণ ঘটালে চুপ করে বসে থাকবে না সোভিয়েত রাশিয়া। এই দৌড়ে কোমর বেঁধে নেমে পড়বে মস্কোও। এতে পরিস্থিতি আরও জটিল হওয়ার আশঙ্কা। শুধু তা-ই নয়, এতে শেষ পর্যন্ত মহাকাশ যুদ্ধ বাধলে পরাজয়ের মুখ দেখতে হতে পারে বলেও মনে করেছিলেন তাঁরা।
১৩২১
‘প্রজেক্ট এ১১৯’ থেকে সরে আসার পর অ্যাপোলো মিশন শুরু করে আমেরিকা। এর লক্ষ্য ছিল চাঁদে নভশ্চর প্রেরণ। সেখানে অবশ্য সোভিয়েত রাশিয়াকে হারিয়ে দিতে সক্ষম হয় যুক্তরাষ্ট্র। প্রথম বার চাঁদের বুকে পা রাখেন মার্কিন মহাকাশচারী নীল আর্মস্ট্রং এবং এডুইন (বাজ়) অলড্রিন। তারিখটা ছিল ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই।
১৪২১
বিশেষজ্ঞদের দাবি, মহাকাশের লড়াইয়ে প্রথম দিকে পিছিয়ে থাকায় কিছুটা ভয়েই পেয়েছিল আমেরিকা। তাদের মতো চাঁদ উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা যাতে আর কেউ না করে, এ বার তাতে তৎপর হন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রনেতারা। ১৯৬৭ সালে ১১৫টি দেশের সঙ্গে ‘মহাকাশ চুক্তি’ করে ওয়াশিংটন। সেখানে কোনও দেশকেই মহাশূন্যে পরমাণু বিস্ফোরণের অধিকার দেওয়া হয়নি।
১৫২১
পাশাপাশি, এই চুক্তিতে মহাশূন্যের উপর কোনও নির্দিষ্ট দেশের দখলদারি চলবে না বলেও স্পষ্ট করা হয়। সেখানে গবেষণা চালানোর সমস্ত রাষ্ট্রের রয়েছে সমান অধিকার। এই চুক্তি সত্ত্বেও পরবর্তী কালে তৈরি হয় নতুন সমস্যা। বর্তমানেও তাতে ভুগছেন জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। সেটি হল, মহাকাশে বাড়ছে জঞ্জাল।
১৬২১
গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকের পর থেকে নতুন নতুন দেশ মহাকাশ গবেষণায় উন্নতি করতে শুরু করে। ফলে তাদের পাঠামো কৃত্রিম উপগ্রহে ভরে উঠছে মহাশূন্য। মিশন শেষ করার পর পৃথিবীর নিম্নকক্ষে বুলেট গতিতে ঘুরতে থাকা কৃত্রিম উপগ্রহের সংখ্যা বর্তমানে ১৩ কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। এদের মধ্যে ৬৫০-এর বেশি সংঘর্ষও হয়েছে, জানিয়েছে নাসা।
১৭২১
মহাশূন্যের এই জঞ্জাল পরিষ্কার করতে জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করেছেন একটি অভিনব পদ্ধতি। কিছু কৃত্রিম উপগ্রহকে মিশন শেষ করার পর পৃথিবীতে ফিরিয়ে আনছেন তাঁরা। কিন্তু এই পদ্ধতিতে উপগ্রহের লঞ্চার রকেট বুস্টারকে ফেরানো সম্ভব নয়। ফলে সেগুলির উপর নজরদারি ব্যবস্থা করেছে নাসার জেট প্রপালশান ল্যাব।
১৮২১
২০১৫ সালে নাসার জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা একটি রকেট বুস্টারকে পৃথিবীর নিম্নকক্ষে ঘোরাফেরা করতে দেখেন। সেটি কোথা থেকে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে তা বুঝতে রেডিয়ো তরঙ্গ এবং একটি নির্দিষ্ট সফ্টঅয়্যারের সাহায্য নেন তাঁরা। এই দুয়ের মাধ্যমে মার্কিন মহাকাশ গবেষকেরা বুঝতে পারেন এটি চিনের ‘লং মার্চ ৩সি’ রকেটের বুস্টার। সেটির বুলেট গতিতে চাঁদের দিকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলেও পূর্বাভাস দিয়েছিলেন তাঁরা।
১৯২১
আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সেই ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যায় ২০২২ সালে। চিনা রকেট বুস্টারটি চন্দ্রপৃষ্ঠে ধাক্কা মারার পর ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানতে কৃত্রিম উপগ্রহ পাঠিয়ে সেখানকার ছবি তোলে নাসা। সেগুলি বিশ্লেষণ করে মার্কিন মহাকাশ গবেষকেরা বুঝতে পারেন, পূর্বাভাসে বলে দেওয়া জায়গার থেকে ১৬ কিলোমিটার দূরে আছড়ে পড়েছে বেজিঙের রকেট বুস্টার।
২০২১
উল্লেখ্য, এর আগে চন্দ্রপৃষ্ঠে অন্তত ৪৭ বার ধাক্কা খেয়েছে আমেরিকার রকেট বুস্টার। প্রতিটি ক্ষেত্রেই চাঁদের বুকে তৈরি হয়েছে একটি গর্ত। এ ক্ষেত্রে কী ভাবে দু’টি গর্ত তৈরি হল, তার উত্তর অবশ্য এখনও পাননি জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা। তাঁদের কারও কারও দাবি, চন্দ্রপৃষ্ঠে আছড়ে পড়ার মুখে চিনা রকেট বুস্টারটি দু’টুকরো হয়ে গিয়েছিল। এর ফলে দু’টি গর্ত তৈরি হয়েছে।
২১২১
বেজিং অবশ্য এই যুক্তি মানতে নারাজ। তৎকালীন চিনা বিদেশ মন্ত্রকের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিনকে এই নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘‘আমাদের রকেট বুস্টার পৃথিবীর কক্ষপথেই জ্বলে পুরোপুরি নিঃশেষ হয়ে গিয়েছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে এই নিয়ে আতঙ্ক তৈরি করা হচ্ছে।’’ গোটা ঘটনাটিকে নাসার কল্পনা বলেও উড়িয়ে দেন তিনি।