China speeds up dam with hydroelectric project work in Khyber Pakhtunkhwa in Pakistan, know its impact on India dgtl
China Construct Dam in Pakistan
জলের জন্য জ্বলছে সিন্ধ, মন্ত্রীর বাড়িতে আগুন! চিনা বাঁধ নির্মাণে গতি বাড়িয়ে ‘পেশোয়ারি চাল’ দিল শুষ্ক পাকিস্তান
পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়ায় ৭০০ ফুট উঁচু বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ নির্মাণের কাজ চালাচ্ছে চিনের একটি সরকারি সংস্থা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে গতি বৃদ্ধির জন্য বেজিঙের কাছে দরবার করল ইসলামাবাদ। অন্য দিকে চোলিস্তান খাল প্রকল্পকে কেন্দ্র করে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সিন্ধ প্রদেশে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০২৫ ১৩:৫৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
‘জলশূন্য’ পাকিস্তানে জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র! আফগানিস্তান লাগোয়া খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে এ বার নদীর উপর বাঁধ তৈরির কাজ শুরু করল ইসলামাবাদ। এই প্রকল্পেও ‘প্রিয় বন্ধু’ চিনকে পাশে পেয়েছে তারা। ৭০০ ফুট উঁচু ওই বাঁধটি বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম হতে যাচ্ছে বলে জানা গিয়েছে। ভারত সিন্ধু জলবণ্টন চুক্তি স্থগিত করার পর তড়িঘড়ি বাঁধ নির্মাণে জোর দেওয়ায় একে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।
০২২০
খাইবার-পাখতুনখোয়ার রাজধানী পেশোয়ার থেকে প্রায় ৩৭ কিলোমিটার উত্তরে পাথুরে উপত্যকার মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে সোয়াত নদী। এর উপরেই মোহমন্দ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে পাকিস্তানের শাহবাজ় শরিফ সরকারের। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বর্তমানে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির কাজ দ্রুত গতিতে শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। এই বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়তে ১২০ কোটি ডলার খরচ করবে ইসলামাবাদ।
০৩২০
২০১৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে মোহমন্দ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের কাজ শুরু করে ‘চায়না এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং কর্পোরেশন’ নামের বেজিঙের রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। আগামী বছরের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করে ফেলার কথা রয়েছে। ড্রাগনের সরকারি গণমাধ্যমগুলির দাবি, সম্প্রতি বাঁধের কংক্রিটের ঢালাইয়ের কাজ শুরু হয়েছে। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক বলে উল্লেখ করেছে।
০৪২০
গত ১৯ মে বেজিং সফরে গিয়ে চিনা কূটনীতিক ওয়াং ইয়ের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেন পাক উপপ্রধানমন্ত্রী তথা বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। সূত্রের খবর, সেখানে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির কাজ দ্রুত শেষ করার উপর জোর দেন তিনি। এর পরই মোহমন্দ বাঁধ ও জলবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজে গতি এনেছে ড্রাগনের সরকারি সংস্থা। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি খাইবার-পাখতুনখোয়ার অর্থনীতিতে বড় প্রভাব রাখতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৫২০
শরিফ সরকারের দাবি, মোহমন্দ বাঁধের মাধ্যমে প্রায় ৮০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এ ছাড়া পেশোয়ার-সহ বিস্তীর্ণ এলাকায় ৩০ কোটি গ্যালন পানীয় জল সরবরাহ করতে পারবে তারা। ওই জল চাষের কাজেও ব্যবহার হবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের কৃষি পুরোপুরি নদীর জলের উপর নির্ভরশীল। আর তাই সংশ্লিষ্ট বাঁধটি খাইবার-পাখতুনখোয়ার অর্থনীতিতে বদল আনবে বলে আশাবাদী ইসলামাবাদ।
০৬২০
বিশ্লেষকদের দাবি, আগামী দিনে জলের জন্য পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। কারণ ইতিমধ্যেই এই ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে সিন্ধ প্রদেশ। সেখানকার মরু এলাকার মধ্যে চোলিস্তান খাল প্রকল্পের কাজ চালাচ্ছে শরিফ প্রশাসন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে তাঁরই সরকারের অন্যতম বড় জোট শরিক পাকিস্তান পিপল্স পার্টির (পিপিপি)। তাঁদের বিরোধিতার জেরে অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠে সিন্ধ প্রদেশের নওশাহরো ফিরোজ জেলা।
০৭২০
গত ২১ মে সিন্ধ প্রদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জিয়াউল হাসান লাঞ্জারের বাসভবনে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয় একদল উন্মত্ত বিক্ষোভকারী। ঘরে ঢুকে চলে দেদার ভাঙচুর। পরে মন্ত্রীর বাড়ি সংলগ্ন দু’টি ১০ চাকার ট্রেলারেও অগ্নিসংযোগ করা হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে স্থানীয় পুলিশ সেখানে পৌঁছোলে দু’পক্ষের মধ্যে বেধে যায় তুমুল সংঘর্ষ। পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠে গুলি চালানোর অভিযোগ। তাতে দু’জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গিয়েছে। অন্য দিকে আহত হন এক ডিএসপি-সহ ছয় পুলিশকর্মী।
০৮২০
কৃষিভিত্তিক পাকিস্তানের পঞ্জাব প্রদেশের দক্ষিণাঞ্চল বেশ শুষ্ক। আর তাই সেখানকার চাষের জমিতে জল পৌঁছে দিতে চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্পের পরিকল্পনা করে শরিফ সরকার। কিন্তু প্রথম দিন থেকেই সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি নিয়ে আপত্তি তোলে একাধিক শরিক দল। এর মধ্যে অন্যতম হল সে দেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলি ভুট্টোর তৈরি পাকিস্তান পিপল্স পার্টি বা পিপিপি।
০৯২০
শরিফ সরকারের অন্যতম বড় শরিক পিপিপি। পাকিস্তানের সিন্ধ প্রদেশ এই রাজনৈতিক দলটির গড় হিসাবে পরিচিত। পিপিপির অভিযোগ, চোলিস্তান সেচ খাল প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে চাষের জলের একচেটিয়া অধিকার পাবেন পঞ্জাবের কৃষকেরা। অন্য দিকে সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবে সিন্ধু নদীর নিম্ন অববাহিকার সিন্ধ প্রদেশ। আর তাই প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরু হতে না হতেই রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ কর্মসূচি চালায় পিপিপি।
১০২০
এই পরিস্থিতিতে সমস্যা মেটাতে গত এপ্রিলে শরিক দলটির চেয়ারম্যান বিলাবল ভুট্টো জ়ারদারির সঙ্গে বৈঠক করেন পাকিস্তান মুসলিম লিগ-নওয়াজ়ের (পিএমএল-এন) নেতা তথা প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। পরে যৌথ সাংবাদিক বৈঠকে বিলাবল বলেন, ‘‘পারস্পরিক সম্মতিতে চোলিস্তান সেচ খালের কাজ আপাতত বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সকলের ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ ব্যাপারে পরবর্তী পদক্ষেপ করবে সরকার।’’
১১২০
গত মাসে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটি বাতিল করে শাহবাজ় সরকারের ‘কমন ইন্টারেস্ট কাউন্সিল’ বা সিসিআই। জলবণ্টন এবং সেচ খাল নিয়ে পাক পঞ্জাব ও সিন্ধ প্রদেশের মধ্যে সুনির্দিষ্ট চুক্তির দাবি তুলেছে পিপিপি-সহ একগুচ্ছ শরিক দল। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির জন্য ২১ হাজার ১৪০ কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দ করেছিল শাহবাজ় প্রশাসন। এর মাধ্যমে চার লক্ষ একর জমিকে চাষের যোগ্য করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
১২২০
২০২৩ সালে ‘পাকিস্তানের সবুজায়ন উদ্যোগ’ (গ্রিন পাকিস্তান ইনিশিয়েটিভ) নামের একটি প্রকল্পের সূচনা করে ইসলামাবাদ। এর মূল উদ্দেশ্য হল কৃষির উন্নতিসাধন। সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির আওতায় চোলিস্তান সেচ খাল কাটার কথা ছিল। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— এই তিনটি প্রদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় চাষের জল পৌঁছোনোর কথা ছিল।
১৩২০
চোলিস্তান প্রকল্পে কয়েক লক্ষ একর মরু এলাকায় মোট ছ’টি খাল কাটার কথা বলা রয়েছে। এর মাধ্যমে পঞ্জাব, সিন্ধ ও বালোচিস্তান— তিন প্রদেশের জন্য দু’টি করে খাল বরাদ্দ করেছিল পাক সরকার। শুধু তা-ই নয়, পাঁচটি খাল সিন্ধু নদী এবং একটি খাল সিন্ধুরই শাখানদী শতদ্রু থেকে কাটার পরিকল্পনা করে ইসলামাবাদ।
১৪২০
গত মার্চে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিকে কেন্দ্র করে সিন্ধ প্রদেশে সর্বাধিক বিক্ষোভ দানা বাঁধে। সেখানকার বিধানসভায় এর বিরোধিতা করে পাশ হয় একটি প্রস্তাব। পাশাপাশি এই ইস্যুতে শরিফ সরকারকে ‘ফল ভুগতে হবে’ বলে হুঙ্কার দেয় অন্যতম শরিক দল পিপিপি। তখন থেকেই পরিস্থিতি জটিল হচ্ছিল।
১৫২০
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। এর ঠিক এক দিন পরে (পড়ুন ২৩ এপ্রিল) সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিতের কথা ঘোষণা করে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ ব্যাপারে পাক জলসম্পদমন্ত্রী সৈয়দ আলি মুর্তজাকে চিঠি পাঠান এ দেশের জলশক্তি মন্ত্রণালয়ের সচিব দেবশ্রী মুখোপাধ্যায়। সেখানেই আনুষ্ঠানিক ভাবে সিন্ধুচুক্তি বাতিলের বিষয়টি পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটিকে জানিয়ে দেওয়া হয়।
১৬২০
১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু ও তৎকালীন পাক প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খানের মধ্যে সিন্ধু নদীর জলবণ্টন নিয়ে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। পাকিস্তানের করাচি শহরে গিয়ে এই চুক্তিপত্রে সই করেছিলেন পণ্ডিত নেহরু। দীর্ঘ ন’বছর আলোচনা চলার পর চুক্তিটি বাস্তবের মুখ দেখেছিল। এর মধ্যস্থতাকারী হিসাবে বিশ্ব ব্যাঙ্ক একটি সালিশি আদালত তৈরি করে। এর প্রবল বিরোধিতা করে এসেছে নয়াদিল্লি।
১৭২০
চুক্তি অনুযায়ী, সিন্ধু অববাহিকার পূর্ব দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ বিপাশা, ইরাবতী ও শতদ্রুর উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ থাকবে ভারতের। অন্য দিকে পশ্চিম দিকের সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল ব্যবহার করতে পারবে পাকিস্তান। জলের নিরিখে সিন্ধু এবং তার শাখা ও উপনদী মিলিয়ে ৩০ শতাংশ ভারত ও ৭০ শতাংশ পাবে পাকিস্তান।
১৮২০
পশ্চিম দিকের তিনটি নদী, অর্থাৎ সিন্ধু, চন্দ্রভাগা ও বিতস্তার জল নয়াদিল্লি যে একেবারেই ব্যবহার করতে পারবে না, এমনটা নয়। চুক্তিতে বলা হয়েছে এই তিনটি নদীর জল স্থানীয় ভাবে সেচের কাজে ব্যবহার করতে পারবে ভারত। পাশাপাশি বিদ্যুৎ উৎপাদন, নৌ চলাচল ও মাছচাষের জন্য ভারতের এই তিনটি নদী ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনও বাধা নেই।
১৯২০
সংশ্লিষ্ট চুক্তিটি স্থগিত হওয়ায় পাকিস্তানে তীব্র জলসঙ্কট তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর তাই সিন্ধু জলবণ্টন নিয়ে ক্রমাগত হুঙ্কার দিয়ে চলেছেন ইসলামাবাদের রাজনৈতিক নেতারা। বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে চিনের সাহায্যে খাইবার-পাখতুনখোয়ায় বাঁধের কাজ দ্রুত শেষ করে পাল্টা চাপ তৈরির চেষ্টা করছেন প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ়। তবে আফগানিস্তান লাগোয়া এই প্রদেশটিতে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপির বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দাপাদাপি রয়েছে। ফলে প্রকল্পের কাজ কতটা সময়ে শেষ হবে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
২০২০
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, চুক্তি স্থগিত থাকায় ভবিষ্যতে নয়াদিল্লি সিন্ধুর জল বন্ধ করলে ফের সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নামতে পারে পাকিস্তান। ইতিমধ্যেই তার প্রস্তুতি শুরু করছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। আগামী অগস্টে চিনের থেকে পঞ্চম প্রজন্মের ‘স্টেল্থ’ যুদ্ধবিমান জে-৩৫এ-র প্রথম ব্যাচটি হাতে পাওয়ার কথা রয়েছে তাঁদের। মোট ৪০টি এই লড়াকু জেট কিনতে প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে ইসলামাবাদ। বেজিং এই যুদ্ধবিমানগুলির দাম ৫০ শতাংশ হ্রাস করেছে বলে জানা গিয়েছে।