দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের গ্বদর সমুদ্রবন্দরে পা জমানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে চিন। বেজিঙের এই পদক্ষেপ নিয়ে সতর্ক করেছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। তাঁদের দাবি, নয়াদিল্লির উপর সামরিক এবং বাণিজ্যিক চাপ তৈরি করতে সংশ্লিষ্ট বন্দরটিকে ব্যবহার করতে পারে ড্রাগন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০২ জুলাই ২০২৫ ০৭:৫২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
চিন্তার নাম গ্বদর! দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তান প্রদেশের অন্তর্গত ওই সমুদ্রবন্দরে ক্রমাগত নিজের অবস্থান মজবুত করছে চিন। পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে আগামী দিনে সেখানে বেজিঙের রণতরী ও ডুবোজাহাজের আনাগোনা যে বাড়বে, তা বলাই বাহুল্য। সে ক্ষেত্রে আরব সাগরে ভারতের ঢোকার রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। ড্রাগনভূমির এ-হেন ‘আগ্রাসন’ কী ভাবে আটকাবে নয়াদিল্লি? তার চুলচেরা বিশ্লেষণে মেতে রয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা।
০২২০
‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসি-র (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডোর) অন্তর্গত গ্বদরকে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলা যেতে পারে। বিশেষজ্ঞদের দাবি, ভারতকে সামরিক এবং বাণিজ্যিক ভাবে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা থেকে বালোচিস্তানে ওই সমুদ্রবন্দর তৈরি করেছে বেজিং। এর মাধ্যমে নয়াদিল্লিকে ‘মুক্তোর সুতো’য় (পড়ুন স্ট্রিং অফ পার্লস) বেঁধে ফেলতে চাইছে ড্রাগন সরকার এবং ফৌজ।
০৩২০
বালোচিস্তানের গ্বদর বন্দরের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই এলাকা থেকে পশ্চিম ভারতের একাধিক সামরিক ঘাঁটির উপর নজরদারি করার সুবিধা রয়েছে। সেই তালিকায় অবশ্যই থাকবে গুজরাতের ভুজ ও জামনগরের বায়ুসেনার ছাউনি, ওখার নৌঘাঁটি, গান্ধীনগরের পশ্চিম ভারতীয় ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থার কমান্ড সেন্টার, পোরবন্দরের উপকূলরক্ষী বাহিনীর দফতর এবং যুদ্ধের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম মজুতের জন্য ব্যবহৃত মুন্দ্রা বন্দর।
০৪২০
গ্বদর বন্দরে চিনের পা জমিয়ে ফেলায় একাধিক বিপদ রয়েছে। প্রথমত, যুদ্ধের সময় ওই এলাকা থেকে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে গুজরাত এবং মহারাষ্ট্রের উপকূলবর্তী সেনাছাউনি এবং শহরগুলিকে সহজেই নিশানা করতে পারবে বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ। দ্বিতীয়ত, আরব সাগরে ভারতীয় রণতরী এবং ডুবোজাহাজের উপর জোরালো আক্রমণ শানাতে গ্বদরকে ব্যবহার করতে পারে ড্রাগনের নৌবাহিনী।
০৫২০
এ ছাড়া গ্বদরে চিনা নৌসেনার উপস্থিতি বাড়লে পশ্চিম এশিয়ার আরব দেশগুলির সঙ্গে নয়াদিল্লির বাণিজ্যিক সম্পর্ক ব্যাহত হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এ দেশের মালবাহী জাহাজগুলির সেখানে যাওয়া আটকাতে পারে পিএলএ নৌবাহিনী। সে ক্ষেত্রে পাল্টা প্রত্যাঘাত হেনে বিভিন্ন জায়গায় অবরোধ তৈরি করেও বিশেষ সুবিধা করতে পারবে না ভারতীয় নৌসেনা। কারণ, গ্বদরকে ব্যবহার করে ইরান এবং মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে দিব্যি বাণিজ্য চালিয়ে যেতে পারবে বেজিং।
০৬২০
এ-হেন গ্বদর প্রথম থেকে পাকিস্তানের হাতে ছিল, এমনটা নয়। বরং স্বাধীনতার পর মাত্র ৩০ লক্ষ পাউন্ডে সংশ্লিষ্ট বন্দরটি কিনে নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়েছিল ভারত। কিন্তু, সুযোগ পেয়েও তাতে না বলে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। ফলে বালোচিস্তানের কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকাটি চলে যায় ইসলামাবাদের হাতে। আর তাই একে পণ্ডিত নেহরুর ‘ঐতিহাসিক ভুল’ বলতেও ছাড়েননি তাঁর সমালোচকেরা।
০৭২০
১৭৮৩ সালে বালোচিস্তানের মাকরান উপকূলবর্তী গ্বদর চলে যায় ওমানের দখলে। দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের ওই এলাকাটি তখন ছিল কালাত রাজ্যের অন্তর্গত। সেখানকার শাসক মীর নুরী নাসির খান বালোচ আরব দেশটির যুবরাজ সুলতান বিন আহমেদকে তা উপহার দিয়েছিলেন। এ ছাড়া গ্বদর সংলগ্ন মৎস্যজীবীদের আরও দু’টি গ্রাম পেশুকান ও সুর বান্দরও ওমানের দখলে ছিল।
০৮২০
বিন আহমেদকে গ্বদর উপহার দেওয়ার সময় কালাতের শাসক তাঁর সঙ্গে একটি চুক্তি করেন। সেখানে বলা হয়, ওমানের কুর্সিতে বসে উপকূলবর্তী এলাকাটি ফেরত দেবেন তিনি। কিন্তু পরবর্তী প্রায় ২০০ বছরে সেটা কখনওই হয়নি। ১৭৯২ সালে সিংহাসনে বসার আগে পর্যন্ত হাতুড়ি আকৃতির ওই এলাকাকে একটি সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করেন বিন আহমেদ।
০৯২০
১৮৯৫ থেকে ১৯০৪ সালের মধ্যে কালাতের শাসকদের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারকে গ্বদর কিনে নিতে বেশ কয়েক বার অনুরোধ করে ওমান। কিন্তু, ইংরেজরা এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে না পারায় পরিস্থিতির কোনও বদল হয়নি। ১৭৬৩ সাল থেকে অবশ্য সেখানে এক জন রাজনৈতিক দালাল মোতায়েন রেখেছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ওমানের সঙ্গে তেলের কারবারের দেখাশোনা করতেন তিনি।
১০২০
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা পর্ষদের (পড়ুন ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইসরি বোর্ড) সাবেক সদস্য প্রমিতপাল চৌধরি জানিয়েছেন, ১৯৫৬ সালে গ্বদর বন্দর কিনে নিতে ভারতকে প্রস্তাব পাঠায় ওমান। কিন্তু নেহরু সেটা প্রত্যাখ্যান করলে ইসলামাবাদের দ্বারস্থ হয় পশ্চিম এশিয়ার ওই আরব দেশ। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মহম্মদ আলি জিন্নার নেতৃত্বে অবশ্য তত দিনে ছলে-বলে-কৌশলে কালাত-সহ প্রায় গোটা বালোচিস্তানকে গিলে ফেলেছে পাকিস্তান। গ্বদর অবশ্য ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিল তাদের।
১১২০
জিন্নার মৃত্যুর ১০ বছরের মাথায় ১৯৫৮ সালে ওমানের থেকে ৩০ লক্ষ পাউন্ডে গ্বদর কিনে নেয় ইসলামাবাদ। ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসার ব্রিগেডিয়ার গুরমিত কানওয়াল জানিয়েছেন, ওই সময়ে নয়াদিল্লি ও ওমানের সম্পর্ক ছিল অত্যন্ত মধুর। তবে গ্বদর বিক্রির প্রস্তাব সম্ভবত মৌখিক ভাবে দিয়েছিলেন সেখানকার সুলতান। প্রধানমন্ত্রী নেহরু বিষয়টিতে আমল না দেওয়ায় যথেষ্ট হতাশই হন তিনি।
১২২০
ইতিহাসবিদদের একাংশের দাবি, এই সিদ্ধান্তের জন্য নেহরুকে একা দায়ী করা ঠিক নয়। কারণ, সরকারি নথি অনুযায়ী তৎকালীন বিদেশ সচিব সুবিমল দত্ত এবং ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো বা আইবি প্রধান বিএন মল্লিক ওমানের সুলতানের প্রস্তাবে তাঁকে রাজি হতে নিষেধ করেন। তাঁদের যুক্তি ছিল, মূল ভূখণ্ড থেকে অনেকটা দূরে পাকিস্তানের মধ্যে থাকা ওই বন্দরকে নিয়ন্ত্রণ করা নয়াদিল্লির পক্ষে সম্ভব হবে না। উল্টে এর জন্য পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সংঘাত তীব্র হওয়ার আশঙ্কা বাড়বে।
১৩২০
২১ শতকে ২০১৫ সালে ফের খবরের শিরোনামে আসে গ্বদর। কারণ ওই বছরই পাকিস্তানের সঙ্গে সিপিইসির চুক্তি করে চিন। বেজিঙের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বা বিআরআই প্রকল্পের অন্তর্গত এই ‘অর্থনৈতিক বারান্দা’টির বিস্তৃতি ড্রাগনভূমির কাশগড় থেকে বালোচিস্তানের গ্বদর পর্যন্ত। এর জন্য মোট ৬,২০০ কোটি ডলার লগ্নি করেছে মান্দারিনভাষীদের সরকার।
১৪২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, আর্থিক এবং সামরিক দিক থেকে ভারতের উত্থানকে মোটেই ভাল চোখে দেখছে না চিন। ভারত মহাসাগর, বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগর এলাকায় নয়াদিল্লির নৌবাহিনীর একচ্ছত্র আধিপত্যে আপত্তি রয়েছে বেজিঙের। সেই কারণেই ‘মুক্তোর সুতো’য় কেন্দ্রকে বেঁধে ফেলার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে তাদের।
১৫২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইরানের সঙ্গে চিনের সম্পর্ক বেশ ভাল। মার্কিন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও তেহরানের থেকে ৪০ শতাংশ খনিজ তেল কিনে থাকে বেজিং। অন্য দিকে বর্তমানে ড্রাগনভূমির আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বড় অংশই চলে ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরের মলাক্কা প্রণালী দিয়ে। ওই সমুদ্রপথ ঘুরে বঙ্গোপসাগর এবং আরব সাগরে ঢোকে মান্দারিনভাষীদের মালবাহী জাহাজ। মলাক্কা প্রণালী দিয়েই ৬০ শতাংশ তেল এবং ৮০ শতাংশ অন্যান্য পণ্য বিদেশে সরবরাহ করে চিন।
১৬২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, গ্বদরকে ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারলে মলাক্কা প্রণালীকে এড়িয়ে আরব সাগর এবং পশ্চিম এশিয়ায় পণ্যবাহী জাহাজ নিয়ে যেতে পারবে বেজিং। আর সেই কারণেই সিপিইসি প্রকল্পটি চিনের কাছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। এই ‘অর্থনৈতিক বারান্দা’টির বেশ কিছু অংশ পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্যে দিয়ে গিয়েছে, যা নিয়ে প্রথম দিন থেকে প্রবল আপত্তি জানিয়ে আসছে নয়াদিল্লি।
১৭২০
চিনের ‘মুক্তোর সুতো’ ষড়যন্ত্রের টের পেতেই নড়েচড়ে বসেছে ভারত। পাল্টা ‘হিরের হারে’ বেজিঙের গলা পেঁচিয়ে ধরার নীলনকশা ছকে ফেলেছে নয়াদিল্লি। কেন্দ্রের কৌশলগত পদক্ষেপ হিসাবে প্রথমেই বলতে হবে ইরানের চাবাহার বন্দরের কথা। গ্বদর থেকে এর দূরত্ব মেরেকেটে ১৭০ কিলোমিটার। সাবেক পারস্য দেশের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে ওই সমুদ্রবন্দরটি তৈরি করেছে ভারত।
১৮২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের বড় অংশই চাবাহারকে নয়াদিল্লির ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে উল্লেখ করেছেন। কারণ ওই সমুদ্রবন্দরকে ব্যবহার করে মধ্য এশিয়ার দেশগুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারছে ভারত। দ্বিতীয়ত, চাবাহারের মাধ্যমে গ্বদরে চিনের গতিবিধির উপর কড়া নজর রাখার সুযোগ পাচ্ছে এ দেশের নৌবাহিনী।
১৯২০
চাবাহারের পাশাপাশি ওমান, ইন্দোনেশিয়া, সেসেলস, মরিশাস এবং ভিয়েতনামে ধীরে ধীরে নৌঘাঁটি তৈরি করছে ভারত। ফলে মলাক্কা প্রণালী-সহ চিনের সমস্ত সামুদ্রিক রাস্তা প্রয়োজনে বন্ধ করতে পারবে নয়াদিল্লি। যুদ্ধের সময় এই ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হলে রাতারাতি ভেঙে পড়তে পারে বেজিঙের অর্থনীতি, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
২০২০
গ্বদরে অবশ্য চিনের পা জমানোর ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় কাঁটা হল বালোচিস্তানের বিদ্রোহ। দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের ওই প্রদেশটি দীর্ঘ দিন ধরেই ইসলামাবাদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। সাম্প্রতিক সময়ে পাক সেনার উপর আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়েছে সেখানকার সশস্ত্র বাহিনী গোষ্ঠী ‘বালোচ লিবারেশন আর্মি’ বা বিএলএ। বেজিঙের শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ারদেরও নিশানা করছে তাঁরা। বালোচ-কাঁটায় চিনের স্বপ্ন পুরোপুরি জলে যায় কি না, সেটাই এখন দেখার।