Donald Trump introducing capitalism 2.0 through taking stocks of private companies in America dgtl
Trump’s Crony Capitalism
চিনের মতো হওয়ার চেষ্টায় দেশের সমস্ত বেসরকারি সংস্থায় অংশীদারি চাইছেন ট্রাম্প! ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’কে সামনে রেখে ‘মুক্ত চিন্তা’র বলি?
সেমিকন্ডাক্টর থেকে ইস্পাত, গাড়ি হোক বা প্রতিরক্ষা সংস্থা। একের পর এক বেসরকারি কোম্পানির স্টক কিনে সরকারি অংশীদারি রাখতে চাইছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’কে সামনে রেখে অর্থনীতির চাকা অন্য ভাবে ঘোরাবেন তিনি?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:২৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরছে চরম পুঁজিবাদী আমেরিকা! প্রশ্নের মুখে সেখানকার মুক্ত চিন্তা। অচিরেই বন্ধ হবে বাজারের চাহিদা মেনে মুনাফায় লাল হয়ে ওঠা বেসরকারি সংস্থাগুলির দাপাদাপি? মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নীতিতে সেই ছাপ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা। কেউ কেউ আবার গোটা বিষয়টির সঙ্গে তুলনা টেনেছেন রাশিয়া, চিন এবং ভারতের। এই আবহে সামনে এসেছে একটা নতুন তত্ত্ব, নাম ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’ বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ।
০২২০
সংবাদসংস্থা ‘এএফপি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, সম্প্রতি ‘লিথিয়াম আমেরিকাস’ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার স্টক কিনতে উঠেপড়ে লেগেছে যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার। এই ইস্যুতে বেশ কিছু দূর এগিয়েছে দু’পক্ষের আলোচনা। উল্লেখ্য, কিছু দিন আগেই বহুজাতিক সেমিকন্ডাক্টর জায়ান্ট ইন্টেল এবং বিরল ধাতুর সংস্থা এমপি মেটেরিয়াল্স-এর শেয়ার কিনে নেয় তারা। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ সে কথা ফলাও করে ঘোষণা করেন বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
০৩২০
ঐতিহ্যগত ভাবে মার্কিন অর্থনীতি ‘মুক্ত বাজার’-এ বিশ্বাসী। এত দিন সেই নীতির উপরে ভর করেই বিশ্বের এক নম্বর স্থানে পৌঁছেছে আমেরিকা। কিন্তু কেন হঠাৎ স্রোতের সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে হেঁটে অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ সংস্থাগুলির স্টক কব্জা করার চেষ্টা করছেন ট্রাম্প? তাঁর এই পরিকল্পনার নেপথ্যে রয়েছে কোনও গভীর ষড়যন্ত্র? সরকারি ভাবে বিভিন্ন সংস্থার শেয়ার কিনতে তাঁর সরকার ঝাঁপিয়ে পড়তেই উঠে গিয়েছে সেই প্রশ্ন।
০৪২০
চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের ইস্পাত সংস্থা ‘ইউনাইটেড স্টেটস স্টিল’ কিনে নেয় জাপানের ‘নিপ্পন স্টিল’। সূত্রের খবর, এই লেনদেনেও বিক্রির শর্ত হিসাবে ওয়াশিংটনের হাতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির স্টকের ‘সোনালি অংশ’ থাকবে বলে শর্ত দেন ট্রাম্প। শেষ পর্যন্ত তা মেনেও নয় টোকিয়ো। ফলে মালিকানা হস্তান্তরের পরেও গোটা ইস্পাত সংস্থাটির উপরে সম্পূর্ণ ভাবে নিয়ন্ত্রণ পেলেন জাপানি কর্তৃপক্ষ, এমনটা নয়। একেই ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’ বলছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০৫২০
শিল্প বিপ্লবের পর ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রে পুঁজিবাদের দ্রুত প্রসার ঘটতে থাকে। সমাজতান্ত্রিক চিন্তার জনক কার্ল মার্কসের অভিন্নহৃদয় বন্ধু ফ্রেডরিক এঙ্গেল্স একে ‘চরম পুঁজিবাদ’ বলে উল্লেখ করেছিলেন। ১৯ শতকে বিশ্ব জুড়ে এর সর্বাধিক বিকাশ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু, গত শতাব্দীর ৩০-এর দশকে কিছু ক্ষেত্রে এর আমূল বদল ঘটিয়ে দেন জার্মান ফ্যুয়েরার অ্যাডল্ফ হিটলার। আজকের ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’-এর সঙ্গে তার বেশ মিল পাওয়া যায়।
০৬২০
১৯২৫ সালে জার্মানির প্রেসিডেন্ট হন পল ভন হিন্ডেনবার্গ। কুর্সিতে বসেই দেশের যাবতীয় প্রতিরক্ষা সংস্থার জাতীয়তাকরণ করেন তিনি। ১৯৩৩ সালে ক্ষমতায় আসেন হিটলার। দেশের সামরিক শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলিকে বিপুল পরিমাণে আর্থিক অনুদান দিতে থাকে তাঁর সরকার। পাশাপাশি, উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য জারি হয় নির্দেশ। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ (১৯৩৯-’৪৫)। তাতে প্রাণ হারান প্রায় পাঁচ থেকে সাড়ে আট কোটি মানুষ।
০৭২০
১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লবের পর জ়ারশাসিত রাজতন্ত্রকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে বলশেভিক পার্টি। মস্কোর কুর্সিতে বসেন ভ্লাদিমির ইলিচ উইলিয়ানভ লেনিন। পূর্ব ইউরোপের দেশটির তখন চরম দুরবস্থা। অর্থনীতি প্রায় ভেঙে পড়েছে। আকাশছোঁয়া মুদ্রাস্ফীতি আর হু-হু করে বেড়ে চলা বেকারত্ব সামাল দিতে রীতিমতো হিমসিম খাচ্ছে ক্রেমলিন। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৯২১ সালে ‘নতুন আর্থিক নীতি’ (নিউ ইকোনমিক পলিসি বা এনইপি) নিয়ে আসেন লেনিন।
০৮২০
হিন্ডেনবার্গের চালু করা জাতীয়করণ নীতি থেকে এটা ছিল সামান্য আলাদা। এনইপিতে রাষ্ট্রায়ত্ত মালিকানায় দেশের যাবতীয় কারখানা খোলার নির্দেশ দেন লেনিন। এর আওতায় ছিল সার, ইস্পাত, গাড়ি ও প্রতিরক্ষা থেকে শুরু করে সমস্ত ভারী শিল্প। শুধু তা-ই নয়, সেখানে উৎপাদিত পণ্যের ব্যবহার রুশ নাগরিকদের জন্য বাধ্যতামূলক করে দেন তিনি। ফলে খুব অল্প দিনের মধ্যে ঘুরে দাঁড়ায় মস্কোর অর্থনীতি। পূর্ব ইউরোপের দেশটি হয়ে ওঠে স্বয়ংসম্পূর্ণ।
০৯২০
১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই নীতি কিছুটা গ্রহণ করেন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু। ১৯৫১ সালে পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা নিয়ে আসেন তিনি। ফলে সরকারি উদ্যোগে খুলতে থাকে একের পর এক ইস্পাত সংস্থা। তৈরি হয় ‘স্টিল অথরিটি অফ ইন্ডিয়া লিমিটেড’। তবে নেহরু আবার লেনিনের মতো সমস্ত সংস্থার রাষ্ট্রায়ত্তকরণ করেননি। একটা ‘আধা সমাজতান্ত্রিক’ ব্যবস্থায় বিশ্বাস করতেন তিনি। ফলে উন্নতির সুযোগ পায় টাটা, বিড়লা, মাহিন্দ্রা বা রিলায়্যান্সের মতো বেসরকারি সংস্থাও।
১০২০
এগুলির থেকে কতটা আলাদা ট্রাম্প জমানার ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’? আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই তত্ত্ব পুরোপুরি পুঁজিবাদকে সমর্থন করে না। আবার সমাজতান্ত্রিক মতাদর্শ মেনেও চলে না এটি। এই নীতিতে সরকারি ভাবে কোনও সংস্থা খুলবে না যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসন। কিন্তু দেশের যাবতীয় উৎপাদনশীল কোম্পানির নিয়ন্ত্রণের চাবিকাঠি থাকবে তাদের হাতে। প্রয়োজন হলেই তা ব্যবহার করতে পারবে তারা।
১১২০
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যেতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় সংস্থাগুলির মাত্র ১০ শতাংশ স্টক নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাইছে ট্রাম্প সরকার। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির অংশীদারিত্ব পাবে তারা। কিন্তু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা চালানোর খরচ বহন করতে হবে না প্রশাসনকে। উল্টে তাদের লভ্যাংশের টাকা ঢুকবে সরকারি কোষাগারে। এতে সব সময়ে চাঙ্গা থাকবে দেশের অর্থনীতি।
১২২০
কিন্তু এই ব্যবস্থায় সবচেয়ে বড় সমস্যার জায়গা হল মুক্ত চিন্তা। সরকারি অংশীদারি থাকার কারণে আগামী দিনে কোনও সংস্থার পক্ষেই প্রেসিডেন্টের সমালোচনা করা সম্ভব হবে না। পাশাপাশি, ঘরোয়া রাজনীতি হোক বা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, ইচ্ছামতো সংশ্লিষ্ট কোম্পানিকে ব্যবহার করতে পারবেন দেশের শীর্ষ পদে থাকা রাষ্ট্রনেতারা। থাকছে তথ্য বিকৃত করার আশঙ্কাও।
১৩২০
‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’ নীতি অবলম্বনের চিন্তা ট্রাম্পই যে প্রথম যুক্তরাষ্ট্রে এনেছেন, এমনটা নয়। আমেরিকার প্রতিরক্ষা সংস্থাগুলির ক্ষেত্রে এটা বার বার ঘটতে দেখা গিয়েছে। ওয়াশিংটনের প্রেসিডেন্টরা ইচ্ছামতো তাদের ব্যবহার করেছেন। ফলে বরাত নিয়েও সময় মতো বিদেশি কোনও রাষ্ট্রকে হাতিয়ার সরবরাহ বন্ধ রাখার বহু অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। যদিও ওই কোম্পানিগুলিতে কোনও অংশীদারি নেই মার্কিন সরকারের।
১৪২০
২০০৮ সালে মন্দা চলাকালীন বেশ কিছু বেসরকারি সংস্থাকে বড় অঙ্কের আর্থিক প্যাকেজ দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। ফলে লোকসান সামলে ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয় বিমা কোম্পানি এআইজি এবং গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থা জেনারেল মোটর্স ও ক্রাইস্লোরে। বিনিময়ে এদের কিছু পরিমাণ স্টক চলে আসে ওয়াশিংটনের প্রশাসনের হাতে। ট্রাম্পের পূর্বসূরি জর্জ ডব্লিুউ বুশ এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।
১৫২০
যদিও কিছু দিনের মধ্যেই বাজার ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করলে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির যাবতীয় শেয়ার বিক্রি করে দেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। আর্থিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’-এর সঙ্গে চিনা অর্থনীতির পুরোপুরি মিল রয়েছে। সেটারই হুবহু নকল আমেরিকায় নিয়ে আসতে চাইছেন ট্রাম্প। উৎপাদনের নিরিখে ওয়াশিংটনেক বিশ্বের এক নম্বরে নিয়ে যাওয়াই তাঁর মূল লক্ষ্য।
১৬২০
তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট যে রাস্তায় চলছেন, তাতে একাদিক বিপদ রয়েছে বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁদের যুক্তি, প্রথমত চিনের মতো আমেরিকায় কোনও একদলীয় ব্যবস্থা নেই। ফলে মাত্র ১০ শতাংশ স্টক কুক্ষিগত করে যাবতীয় সংস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে ব্যবসা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে পারে তারা।
১৭২০
দ্বিতীয়ত, সংস্থার অংশীদার হওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্প শুধু লাভের দিকটাই দেখছেন। এ ভাবে কোম্পানির শেয়ার কুক্ষিগত করলে তাদের লোকসান এবং বিপুল ঋণের বোঝাও গিয়ে চাপবে যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের ঘাড়ে। পাশাপাশি যে কোনও ধরনের ব্যর্থতার দায়ও নিতে হবে সরকারকে।
১৮২০
তৃতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের তথ্যপ্রযুক্তি এবং সেমিকন্ডাক্টর সংস্থাগুলির ব্যবসা ছড়িয়ে আছে বিশ্ব জুড়ে। আমেরিকার সরকার সেগুলির অংশীদার জানলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলি থেকে মুখ ফেরাতে পারে তারা। কারণ, এর জেরে গুগ্ল বা চ্যাটজিপিটির মাধ্যমে ভুয়ো তথ্য ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ থাকবে ওয়াশিংটনের হাতে। জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থেই সেই ঝুঁকি কখনওই নিতে চাইবে না ভারত বা মুক্ত চিন্তার কোনও ইউরোপীয় দেশ।
১৯২০
ট্রাম্পের এই নীতির তাই প্রবল সমালোচনা করেছেন গবেষণা সংস্থা ‘এন্টারপ্রাইজ় ইনস্টিটিউট’-এর শীর্ষ কর্তা মাইকেল স্টেইন। তাঁর কথায়, ‘‘কোনও সংস্থায় যখনই সরকারি অংশীদারি আসবে, তখনই কাজের ক্ষেত্রে বাড়বে অদক্ষতা। কারণ প্রশাসনিক আধিকারিকরা আমজনতাকে সেবা দিয়ে থাকেন। তাঁদের কাজ ব্যবসা করা বা উৎপাদন বৃদ্ধি নয়। এই সারসত্য রোনাল্ড রিগ্যান থেকে বারাক হুসেন ওবামা পর্যন্ত পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্টরা বুঝতে পেরেছিলেন।’’
২০২০
কেউ কেউ আবার ‘রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ’-এর আড়ালে ট্রাম্পের ব্যক্তিগত লাভের অভিযোগ তুলেছেন। উদাহরণ হিসাবে আইফোন নির্মাণকারী সংস্থা অ্যাপ্লের প্রসঙ্গ তুলেচেন তাঁরা। গত অগস্টে মার্কিন টেক জায়ান্টটির ‘চিফ এক্জ়িকিউটিভ অফিসার’ বা সিইও টিম কুক হোয়াইট হাউসে গিয়ে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেন। ওই সময়ে ২৪ ক্যারেটের একটি সোনার মুদ্রা ট্রাম্পকে উপহার হিসাবে দিয়েছিলেন তিনি।