ডোনাল্ড ট্রাম্পের একের পর নীতির বিরোধিতা করে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে শুরু হয়েছে ‘নো কিংস’ আন্দোলন। পাত্তা না দিয়ে সমাজমাধ্যমকে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক একটি ভিডিয়ো পোস্ট করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এর জেরে বিক্ষোভের আগুনে হাওয়া লাগতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২০ অক্টোবর ২০২৫ ১৬:০৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
‘নো কিংস’ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল আমেরিকা। যত সময় গড়াচ্ছে ততই বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট তথা রিপাবলিকান পার্টির নেতা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে জোরালো হচ্ছে প্রতিবাদ। রাজধানী ওয়াশিংটন থেকে শুরু করে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, বস্টন বা লস অ্যাঞ্জেলস— প্রতিটা বড় শহরেই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভে সামিল হয়েছেন অগণিত মানুষ। যদিও কোনও কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে এই নিয়ে মশকরা করেছেন ট্রাম্প। তাঁর ওই আচরণ বিক্ষোভের আগুনে যে ঘি ঢেলেছে, তা বলাই বাহুল্য।
০২১৮
চলতি বছরের ১৯ অক্টোবর ‘নো কিংস’ আন্দোলনকে নিশানা করে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ একটি কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ভিডিয়ো পোস্ট করেন ট্রাম্প। সেখানে বর্ষীয়ান মার্কিন প্রেসিডেন্টকে লড়াকু জেট থেকে বিক্ষোভকারীদের উপর কয়েক হাজার টন মল-মূত্র ফেলতে দেখা গিয়েছে। যুদ্ধবিমানটির গায়ে লেখা ছিল ‘রাজা (কিং) ট্রাম্প’। এআই ভিডিয়োয় রাজমুকুট পরিহিত অবস্থায় লড়াকু জেটের ককপিটে বসে থাকতে দেখা গিয়েছে তাঁকে।
০৩১৮
ট্রাম্পের পোস্ট করা এই ভিডিয়ো নিজের অ্যাকাউন্ট থেকে শেয়ার করেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্স। ফলে কিছু ক্ষণের মধ্যেই তা সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, ‘নো কিংস’ আন্দোলনকে কটাক্ষ করে পাল্টা প্রচারে নেমেছে তাঁদের দল রিপাবলিকান পার্টি। যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে চলা বিক্ষোভকে ‘আমেরিকাকে ঘৃণা’ (হেট আমেরিকা) করার সামিল বলে উল্লেখ করেছেন তাঁরা। এর মাধ্যমে ‘মাগা’ (মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন) সমর্থকদের পালের হাওয়া নিজেদের দিকে টানতে চাইছে রিপাবলিকান দল, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
০৪১৮
ভাইস প্রেসিডেন্ট ভান্সের ‘ব্লুস্কাই’ নামের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্মে একটি অ্যাকাউন্ট রয়েছে। সেখানে আবার ভাইরাল হয়েছে আর একটি কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ভিডিয়ো। তাতে ট্রাম্পের রাজসভায় প্রধান বিরোধী দল ডেমোক্র্যাটিক পার্টির নেতা-নেত্রীদের নতজানু হয়ে তাঁর সামনে প্রার্থনা করতে দেখা গিয়েছে। সংশ্লিষ্ট ভিডিয়োয় যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্টকে ‘ঐশ্বরিক ক্ষমতাসম্পন্ন এক পরম শাসক’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
০৫১৮
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য ট্রাম্প ও তাঁর দলের এ-হেন প্রচার কৌশলকে দু’ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁদের যুক্তি, গোটা বিষয়টির মধ্যে একটা নির্মল হাস্যরস রয়েছে। ফলে তাঁদের অতিবড় সমালোচকও সংশ্লিষ্ট ভিডিয়োগুলিকে ‘অশ্লীল’ বলে প্রচার করতে পারছেন না। তবে এর মাধ্যমে রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট ও দলের স্বৈরাচারী মনভাবের পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে। এর প্রভাব আগামী বছরের মধ্যবর্তী নির্বাচনে (মিডটার্ম ইলেকশান) পড়বে বলে মনে করছেন তাঁরা।
০৬১৮
কৃত্রিম মেধাভিত্তিক ভিডিয়ো ছড়িয়ে দিয়ে আমজনতার মন জয় করা অবশ্য ট্রাম্পের কোনও নতুন প্রচার কৌশল নয়। গত জানুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নেওয়ার কয়েক মাসের মাথায় পূর্বসূরি তথা ডেমোক্র্যাট নেতা বারাক হুসেন ওবামাকে নিয়ে একটি এআই ভিডিয়ো ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ পোস্ট করেন তিনি। সেখানে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্টকে হাতকড়া পরিয়ে স্থানীয় পুলিশ গ্রেফতার করছে দেখানো হয়েছিল। ভিডিয়োটি জনসমক্ষে আসার পর ওই ঘটনা ঘটতে চলেছে বলে রীতিমতো হুঙ্কার দেন ট্রাম্প।
০৭১৮
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র জুড়ে ‘আমেরিকায় কোনও রাজা নেই’ (নো কিংস) আন্দোলন শুরু হওয়ার নেপথ্যে একাধিক কারণ রয়েছে। প্রথমত, কুর্সিতে বসা ইস্তক পূর্ববর্তী সরকারের একাধিক নীতি আমূল বদলে ফেলেছেন তিনি। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে একের পর এক কড়া পদক্ষেপ করতে দেখা গিয়েছে তাঁকে। এর পাশাপাশি এইচ-১বি ভিসায় মোটা অঙ্কের মূল্য চাপানোয় তাঁর উপর দেশের তাবড় ব্যবসায়ী সংগঠন এবং তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পসংস্থাগুলি যে বেজায় চটেছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই।
০৮১৮
‘নো কিংস’ আন্দোলনের দ্বিতীয় কারণ হল ট্রাম্পের শুল্কনীতি। এর জেরে একাধিক ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। উল্টো দিকে ঘরোয়া বাজারে বেড়েছে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, হঠাৎ হঠাৎ বিভিন্ন ইস্যুতে পরস্পরবিরোধী কথা বলছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। তার সরাসরি প্রভাব দেখা যাচ্ছে ওয়াল স্ট্রিটের শেয়ার বাজারে। গত কয়েক মাসে একাধিক বার ধরাশায়ী হয়েছে স্টকের সূচক। এর জন্য ট্রাম্পকেই দুষেছেন বিপুল লোকসানের মুখ দেখা লগ্নিকারীরা।
০৯১৮
মার্কিন গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘নো কিংস’ আন্দোলনে পথে নেমেছেন সাবেক সেনাকর্তা থেকে শুরু করে সেখানকার অবসরপ্রাপ্ত পদস্থ সরকারি আধিকারিকদের একাংশ। তাঁদের দাবি, ট্রাম্পের জন্য আন্তর্জাতিক মঞ্চে তিল তিল করে গড়ে তোলা আমেরিকার ভাবমূর্তি কলুষিত হচ্ছে। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট এ সব যুক্তি মানতে নারাজ। তাঁর দাবি, দেশের আমজনতার স্বার্থেই অভিবাসীদের তাড়াতে চাইছেন তিনি, এইচ-১বি ভিসা নীতিতে এনেছেন কড়াকড়ি।
১০১৮
গত ১ অক্টোবর থেকে ‘শাটডাউন’-এর কবলে পড়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ফলে জরুরি পরিষেবা বাদ দিয়ে বাকি সমস্ত প্রশাসনিক কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে আমেরিকায়। এর জেরে বহু সরকারি কর্মীকে বেতন ছাড়া কাজ করতে হচ্ছে। গোদের উপর বিষফোড়ার মতো শিক্ষা এবং গবেষণাখাতে বরাদ্দ কমিয়েছেন ট্রাম্প। ফলে বহু গুণী ব্যক্তি মার্কিন মুলুক ছেড়ে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেই তালিকায় সস্ত্রীক নোবেলজয়ী ভারতীয় অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম আছে বলেও জানা গিয়েছে।
১১১৮
‘নো কিংস’ আন্দোলনের সমর্থকেরা এই সব কিছুর জন্য ট্রাম্পকে দায়ী করেছেন। এর জেরে তাঁর বিরুদ্ধে ২,৭০০ বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দেওয়া হয়। সেখানে আট থেকে ৮০, সবাইকে প্ল্যাকার্ড হাতে স্লোগান দিতে দেখা গিয়েছে। আন্দোলনরত বছর ৭০-এর অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী পেগি কোল বলেছেন, ‘‘সরকার চালানোর নামে আমেরিকার গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করছেন প্রেসিডেন্ট। আর তাই আজ আমাদের বলতেই হবে, আমেরিকার কোনও রাজা নেই।’’
১২১৮
আন্দোলনকারীরা ইতিমধ্যেই ‘নো কিংস’ কর্মসূচি নিয়ে একটি ওয়াবসাইট প্রকাশ করেছেন। সেখানে লেখা রয়েছে, ‘‘প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ভাবেন তাঁর রাজত্বই সর্বশ্রেষ্ঠ। সেটাই তাঁর স্বৈরাচারী মনোভাবের পরিচয়। আমরা কোনও বিশৃঙ্খলা, দুর্নীতি এবং নিষ্ঠুরতা সহ্য করব না।’’ উদ্যোক্তাদের দাবি, গত ১৮ অক্টোবর সংশ্লিষ্ট বিক্ষোভে অংশ নিতে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায় নামেন ৭০ লক্ষের বেশি মানুষ। আটলান্টা প্রদেশে সামিল হন এক ডেমোক্র্যাট নেতাও। তবে কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানারে হচ্ছে না ‘নো কিংস’ আন্দোলন।
১৩১৮
ট্রাম্পের বিরুদ্ধে রাজাসুলভ আচরণের আরও অনেক অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি আর্থিক জালিয়াতির অভিযোগে সাবেক রিপাবলিকান নেতা জর্জ স্যান্টোসকে সাত বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আমেরিকার একটি আদালত। কিন্তু, ১৭ অক্টোবর বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে সেই শাস্তি রুখে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। শুধু তা-ই নয়, সংশ্লিষ্ট রায়টিকে বাতিল করে দেন তিনি।
১৪১৮
এর পরই ট্রাম্পের সুখ্যাতি করে গণমাধ্যমে মুখ খোলেন জর্জ স্যান্টোস। বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্ট যদি ক্রুশবিদ্ধ অবস্থায় প্রভু যিশুকে ক্ষমা করতেন, তা হলেও তার সমালোচনা হত। এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা।’’ রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, এই ধরনের বিবৃতি দিয়ে ট্রাম্পকে মহান রোমান সম্রাটদের সঙ্গে এক আসনে বসাতে চেয়েছেন ওই সাবেক রিপাবলিকান নেতা।
১৫১৮
গত বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে খোলাখুলি ভাবে ট্রাম্পকে সমর্থন করেন ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতি ইলন মাস্ক। বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতার জন্য তাঁকে প্রচার করতেও দেখা গিয়েছিল। প্রতিদানে কুর্সি পেয়ে মাস্ককে বিশেষ পরামর্শদাতা (অবৈতনিক) পদে নিয়োগ করেন ট্রাম্প। টেসলা-কর্তার জন্য তৈরি হয় একটি বিশেষ দফতর, নাম ‘ডজ়’ বা ডিপার্টমেন্ট অফ গভর্নমেন্ট এফিসিয়েন্সি। সংশ্লিষ্ট দফতরটির কাজ ছিল ‘অপ্রয়োজনীয়’ খরচ কাটছাঁট করে ট্রাম্প প্রশাসনকে সাহায্য করা।
১৬১৮
গত জুনে জনস্বার্থে একটি বিলে সই করেন ট্রাম্প। একে ‘বড় ও সুন্দর’ বলে ব্যাখ্যা করেন তিনি। এর কয়েক দিনের মাথাতেই ‘ডজ়’ থেকে ইস্তফা দেন মাস্ক। শুধু তা-ই নয়, পদত্যাগের পরই মার্কিন প্রেসিডেন্টের সমালোচনার নামে রীতিমতো কুৎসা করা শুরু করেন তিনি। দাবি তোলেন ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে ট্রাম্পকে সরিয়ে ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সকে ক্ষমতায় আনার।
১৭১৮
একটা সময়ে এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) মাস্কের পোস্ট ছিল, ‘‘আমি ট্রাম্পকে ভালবাসি সে ভাবেই, যে ভাবে এক জন বিসমকামী পুরুষ আর এক জন পুরুষকে ভালবাসতে পারে।’’ কিন্তু কয়েক মাসের মধ্যেই ধনকুবের মার্কিন শিল্পপতি বলেন, ‘‘বিরাট ভুল হয়ে গিয়েছে। বিকারগ্রস্ত একজনকে ভোটে জিতিয়ে ক্ষমতাশালী করেছে আমেরিকাবাসী।’’ যুক্তরাষ্ট্রের আমজনতার ক্ষেত্রেও কি সেই বিলম্বিত বোধদয়? ‘নো কিংস’ আন্দোলন ঘিরে উঠছে প্রশ্ন।
১৮১৮
গত বছর ছাত্র-যুব আন্দোলনে উত্তাল হয় বাংলাদেশ। ফলে পতন ঘটে নির্বাচিত শেখ হাসিনা সরকারের। এ বছরের সেপ্টেম্বরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাওয়া যায় নেপালে। হিমালয়ের কোলের রাষ্ট্রটিতে ক্ষমতা হারান কেপি শর্মা ওলি। দু’টি দেশেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল স্বৈরশাসনের। এর বিরুদ্ধে পথে নেমে বিক্ষোভে সামিল হয় জ়েন জি। ‘নো কিংস’-এর জমায়েত দেখে যুক্তরাষ্ট্রেও সেই ছবি দেখতে পাওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দিচ্ছেন বা বিশ্লেষকদের একাংশ।