আগামী ৭ অগস্ট থেকে ভারতীয় পণ্যে ৫০ শতাংশ করে শুল্ক নেবে আমেরিকা। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই নীতির জেরে চৌপাট হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি। গবেষণা রিপোর্টে স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) বিস্ফোরক দাবি ঘিরে শুরু হয়েছে হইচই।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০২৫ ০৭:৫৪
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
ভারতের সঙ্গে শুল্ক-যুদ্ধে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প! তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্তের কেমন প্রভাব পড়বে এ দেশের অর্থনীতিতে? আমেরিকারই বা লোকসান হবে কতটা? হিসাবের দাঁড়িপাল্লায় সেই অঙ্ক ইতিমধ্যেই কষতে শুরু করে দিয়েছেন দেশ-দুনিয়ার তাবড় আর্থিক বিশ্লেষকেরা। এই আবহে প্রকাশ্যে এল স্টেট ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার (এসবিআই) একটি রিপোর্ট। শুল্ক-সংঘাত চালিয়ে গেলে যুক্তরাষ্ট্রের কপালে যে অশেষ দুর্গতি লেখা আছে, তা স্পষ্ট করেছে এ দেশের সর্ববৃহৎ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক।
০২১৯
সম্প্রতি প্রকাশিত গবেষণাপত্রে ভারতের উপরে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপকে ‘খারাপ ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত’ বলে উল্লেখ করে এসবিআই। স্টেট ব্যাঙ্কের দাবি, এর জন্য মার্কিন অর্থনীতির মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বা জিডিপি (গ্রস ডোমেস্টিক প্রোডাক্টস) বৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। পাশাপাশি, পাল্লা দিয়ে বাড়বে মুদ্রাস্ফীতি। এ ছাড়া দুর্বল হতে পারে ডলার। এই ত্রিমুখী চাপ সহ্য করা আমেরিকার পক্ষে কঠিন হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট রিপোর্টে সতর্ক করা হয়েছে।
০৩১৯
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতিতে ক্ষতবিক্ষত হচ্ছে মার্কিন অর্থনীতি। এসবিআইয়ের গবেষকেরা জানিয়েছেন, সেটা এসেছে বিভিন্ন দেশের উপরে ট্রাম্পের চাপানো শুল্কনীতির জন্য। এর জেরে ২০২৬ সাল পর্যন্ত দু’শতাংশের উপরেই থাকবে আমেরিকার মুদ্রাস্ফীতির হার। পাশাপাশি, ডলারের মূল্যে বড় পতন প্রত্যক্ষ করবে বিশ্ব। যুক্তরাষ্ট্রের বর্ষীয়ান প্রেসিডেন্ট এই বিপদ ঠেকাতে পারবেন কি না, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দিহান আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
০৪১৯
এসবিআইয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, ট্রাম্পের শুল্কনীতির জন্য যুক্তরাষ্ট্রে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। ফলে স্বল্প সময়ের জন্য ঘর-গৃহস্থালির খরচ গড়ে বৃদ্ধি পাবে ২,৪০০ ডলার। সে ক্ষেত্রে কম আয়ের পরিবারগুলির অতিরিক্ত ১,৩০০ ডলার পর্যন্ত ব্যয় বৃদ্ধি হতে পারে। বেশি আয়ের পরিবারগুলির ক্ষেত্রে এই ধাক্কার অঙ্ক দাঁড়াবে পাঁচ হাজার ডলার।
০৫১৯
২০১৭ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রথম বার প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন আমদানি করা ইস্পাত এবং অ্যালুমিনিয়ামের উপর ১০ থেকে ২৫ শতাংশ পর্যন্ত শুল্ক চাপিয়ে দেন ট্রাম্প। এর ফল হয় হিতে বিপরীত। ওই সময়ে আমেরিকার ঘরোয়া বাজারে ওয়াশিং মেশিন ও রেফ্রিজারেটর থেকে শুরু করে একাধিক পণ্যে দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়। ফলে ওই সমস্ত বৈদ্যুতিন সরঞ্জামের বিক্রির সূচক হঠাৎ করে অনেকটা নেমে গিয়েছিল।
০৬১৯
বর্তমানে ভারতীয় পণ্যের সর্বাধিক আমদানিকারী দেশ হল আমেরিকা। এখানকার রফতানি বাণিজ্যের ২০ শতাংশ সামগ্রী যায় যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে। রফতানির তালিকায় নজর রাখলে দেখা যাবে, শীর্ষস্থানে থাকা বাকি ১০টি দেশকে মোট বাণিজ্যের ৫৩ শতাংশ পণ্য বিক্রি করতে পারে নয়াদিল্লি। এই পরিস্থিতিতে শুল্ক নিয়ে ট্রাম্প অনড় মনোভাব দেখালে কেন্দ্রকে বিকল্প পথের সন্ধান করতে হবে। সে ক্ষেত্রে মার্কিন বাজারে সস্তা পণ্যের সঙ্কট দেখা দিতে পারে, যার অবশ্যম্ভাবী প্রভাব পড়বে অর্থনীতির উপর।
০৭১৯
বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম, রত্ন ও অলঙ্কার এবং ওষুধের ক্ষেত্রে ভারতের উপরে অনেকটাই নির্ভরশীল আমেরিকা। এত দিন পর্যন্ত এই সমস্ত পণ্যে কোনও শুল্ক নিত না যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। কিন্তু ট্রাম্পের নতুন নীতিতে এগুলির উপরে চাপবে অন্তত ২৫ শতাংশ শুল্ক। সে ক্ষেত্রে মার্কিন বাজারে ওষুধের দাম ৪৭ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে। বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত দামি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
০৮১৯
ট্রাম্প অবশ্য দাবি করেছেন, শুল্কের চাপে পড়ে আগামী দিনে যাবতীয় প্রয়োজনীয় সামগ্রী আমেরিকার ভিতরেই তৈরি করবে একাধিক শিল্প সংস্থা। কিন্তু এসবিআইয়ের গবেষকদের দাবি, সেটা একেবারেই সহজ নয়। কারণ, ওষুধ বা বৈদ্যুতিন সরঞ্জাম উৎপাদনের পরিকাঠামো তৈরি করতে সময় লাগবে চার থেকে পাঁচ বছর। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রে সস্তা শ্রমিক পাওয়া দুষ্কর। ফলে অনেকটাই বাড়বে যে কোনও পণ্য বা ওষুধ তৈরির খরচ। স্বাভাবিক ভাবেই সেই বর্ধিত মূল্য চোকাতে হবে মার্কিন আমজনতাকে।
০৯১৯
এসবিআইয়ের রিপোর্টে আরও একটি বিষয়ের ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। স্টেট ব্যাঙ্ক জানিয়েছে, ওষুধের মতো জীবনদায়ী পণ্যের ক্ষেত্রে শুল্কের চাপ মারাত্মক আকার নিতে পারে। মার্কিন বাজারে এর ঘাটতি তৈরি হলে শুরু হবে ব্যাপক কালোবাজারি। তবে ভারতের রফতানি করা ওষুধের ৪০ শতাংশই যায় আমেরিকায়। ট্রাম্পের শুল্ক বজায় থাকলে ২০২৫-’২৬ আর্থিক বছরে এ দেশের ফার্মা সংস্থাগুলির রাজস্বের পরিমাণ হ্রাস পাবে দুই থেকে চার শতাংশ।
১০১৯
ভারতের ওষুধ এবং চিকিৎসা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলির ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ রাজস্ব আসে মার্কিন বাজার থেকে। সেই অঙ্কের কিছুটা হেরফের হতে পারে। সংবাদসংস্থা ব্লুমবার্গের রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০১৮ সালে ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানোর জেরে যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালুমিনিয়ামের উৎপাদন ৩২ শতাংশ এবং ইস্পাত উৎপাদন ৩.৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল।
১১১৯
২০১৮ সালে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে পাশ হওয়া ‘জাতীয় নিরাপত্তা আইন’ মোতাবেক আমদানি করা ধাতুর উপর উচ্চ হারে শুল্ক আরোপ করেন ট্রাম্প। ব্লুমবার্গ জানিয়েছে, দু’বছর পর পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিল হয়েছিল। এর জেরে মার্কিন ইস্পাতশিল্পে তৈরি হয় মাত্র হাজার কর্মসংস্থান। অন্য দিকে গাড়ি, ওয়াশিং মেশিন নির্মাণকারী সংস্থাগুলিতে যে ৭৫ হাজার চাকরির সুযোগ ছিল, সেগুলি রাতারাতি নষ্ট হয়ে যায়।
১২১৯
উচ্চ হারে শুল্কের জন্য ইস্পাতের আমদানি হ্রাস পাওয়ায় এর দাম খুচরো বাজারে হু হু করে বাড়তে শুরু করে। ফলে মার্কিন ভোক্তাদের পকেট থেকে দিতে হয়েছিল অতিরিক্ত ন’লক্ষ ডলার। ফলে মাত্র দু’বছরের ব্যবধানে ইস্পাতের উপর শুল্ক তুলে নিতে প্রেসিডেন্টের ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) এসেছিল এক লাখের বেশি অনুরোধ। আর সেগুলি পাঠিয়েছিলেন সে দেশের বড়-মেজো-ছোট শিল্পপতিরা।
১৩১৯
এ বারের শাসনকালে ট্রাম্প ফের আগ্রাসী শুল্কনীতি নেওয়ায় ঠান্ডা পানীয় সংস্থা কোকা কোলা, গাড়ি নির্মাণকারী কোম্পানি ফোর্ড এবং মহাকাশ গবেষণা সংক্রান্ত সরঞ্জাম প্রস্তুতকারী সংস্থাগুলি সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইতিমধ্যেই মুখ খুলেছেন ফোর্ডের সিইও জিম ফার্লি। তিনি বলেন, ‘‘প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত ঘরোয়া উৎপাদন এবং ব্যবসার জগতে বিশৃঙ্খলা তৈরি করবে।’’
১৪১৯
আমেরিকার গাড়ি নির্মাণকারী সংস্থাগুলি কাঁচামালের একাংশ মেক্সিকো এবং কানাডা থেকে আমদানি করে থাকে। শুল্কের জন্য সেগুলির দর চড়া হলে ঘরোয়া বাজারে বাড়বে গাড়ির দাম। সে ক্ষেত্রে গাড়ি বিক্রির সূচক নিম্নমুখী হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কা থেকে ইতিমধ্যেই পদক্ষেপ করতে শুরু করেছে একাধিক কোম্পানি।
১৫১৯
গত বছরের নভেম্বরে আমেরিকার গাড়ি নির্মাণ শিল্প নিয়ে একটি সমীক্ষা রিপোর্ট প্রকাশ করেন বার্নস্টাইন গোষ্ঠীর বিশ্লেষকেরা। সেখানে বলা হয়, স্টেলান্টিস তাদের যানবাহনের ৩৯ শতাংশ তৈরি করে মেক্সিকো এবং কানাডায়। একই ভাবে জেনারেল মোটরস এবং ফোর্ডের যথাক্রমে ৩৬ এবং ১৮ শতাংশ গাড়ি তৈরি হয় ওই দুই দেশে। শুধু তা-ই নয়, উত্তর আমেরিকায় ব্যবহৃত গাড়ির তিন-চতুর্থাংশ মেক্সিকোয় তৈরি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সমীক্ষকেরা। এর মধ্যে রয়েছে জেটা, টিগুয়ান এবং টাওসের মতো জনপ্রিয় এবং সাশ্রয়ী চার চাকার যানের ব্র্যান্ড।
১৬১৯
আমেরিকার বিভিন্ন নামী বস্ত্রবিপণি সংস্থাকে পোশাক এবং জুতো সরবরাহ করে ভারত। সেই তালিকায় নাম রয়েছে ‘দ্য গ্যাপ ইনকর্পোরেটেড’, ‘পেপে জিন্স’, ‘ওয়ালমার্ট ইনকর্পোরেটেড’ এবং ‘কস্টকো হোলসেল কর্পোরেশন’-এর। কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রির আশঙ্কা, ট্রাম্পের শুল্কের কারণে ‘কঠিন চ্যালেঞ্জের’ মুখে পড়বে এই শিল্প। ‘বর্ধমান টেক্সটাইল লিমিটেড’, ‘ওয়েলসপান লিভিং লিমিটেড’, ‘ইন্দো কাউন্ট ইন্ডাস্ট্রিজ় লিমিটেড’ এবং ‘অরবিন্দ ফ্যাশন্স লিমিটেড’-এর মতো সংস্থাগুলির লাভের অঙ্ক কমতে পারে। যদিও এসবিআইয়ের গবেষকদের দাবি, এর ফলে বেশি টাকা দিয়ে জামাকাপড় কিনতে হবে মার্কিন বাসিন্দাদের।
১৭১৯
এশিয়ার অন্য দেশগুলির তুলনায় ভারতের উপরে তুলনামূলক ভাবে বেশি হারে শুল্ক চাপিয়েছেন ট্রাম্প। ভিয়েতনামের পণ্যের উপরে ২০ শতাংশ, ইন্দোনেশিয়ার উপর ১৯ শতাংশ, জাপানের উপর ১৫ শতাংশ হারে শুল্ক চাপিয়েছেন তিনি। সেখানে নয়াদিল্লির পণ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার নেবে ২৫ শতাংশ শুল্ক। পাশাপাশি ব্যবসায় রুশ-ঘনিষ্ঠতার জন্য একটি পৃথক জরিমানার কথাও বলেছেন তিনি।
১৮১৯
আর্থিক বিশ্লেষকদের দাবি, এই পরিস্থিতিতে সংশ্লিষ্ট দেশগুলি পাল্টা আমেরিকার উপরে শুল্ক চাপিয়ে দিলে উল্টে বিপাকে পড়বেন ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই সেই সাহস দেখাতে শুরু করেছে চিন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বা কানাডার মতো যুক্তরাষ্ট্রের বন্ধু দেশগুলিও তাঁর এই নীতির জেরে যথেষ্ট বিরক্ত। শুল্ক-যুদ্ধের আবহে কিছু দিন ওয়াশিংটনে বিরল খনিজ পদার্থ পাঠানো বন্ধও রেখেছিল বেজিং।
১৯১৯
২০১২-’১৩ আর্থিক বছরে ভারতের সঙ্গে আমেরিকার বাণিজ্য ঘাটতি ছিল ১,১০০ কোটি ডলার। গত অর্থবর্ষে (পড়ুন ২০২৪-’২৫) সেটা বেড়ে পৌঁছোয় ৪,৩০০ কোটি ডলারে। ২০২৪ সালের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে এই অঙ্ক ১,২৭০ কোটিতে ঘোরাফেরা করছিল। আগামী ৭ অগস্ট থেকে চালু হবে ট্রাম্পের নতুন শুল্ক। তার আগে চাঙ্গা রয়েছে স্টকের সূচক। পাশাপাশি, আর্থিক লোকসান এড়াতে আফ্রিকা ও ইউরোপে নতুন বাজারের খোঁজ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি।