স্পেন, ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ, ঝোপ বুঝে কোপ বার বার! ছোট্ট দেশ কী ভাবে পরিণত হল আজকের আমেরিকায়
১৭৮৩ সালে ব্রিটেনের শৃঙ্খল কেটে বেরিয়ে এসে জন্ম নেয় স্বাধীন আমেরিকা। ওই সময়ে আটলান্টিকের পারে মাত্র ১৩টি উপনিবেশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল দেশটি। ধীরে ধীরে একের পর এক এলাকা কব্জা করে কলেবরে বেড়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
আনন্দবাজার অনলাইন ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ০৮:২৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৫
আটলান্টিকের পারের ১৩টি ছোট ছোট ব্রিটিশ উপনিবেশ। ১৮ শতকে রীতিমতো রক্ত ঝরিয়ে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেন সেখানকার অধিবাসীরা। তার পর অবশ্য সেখানেই থেমে থাকেননি তাঁরা। যত সময় এগিয়েছে, ততই বদলেছে দেশটির মাত্রচিত্র। ছলে-বলে-কৌশলে ধীরে ধীরে আশপাশের জমি দখলের মাধ্যমে ‘সুপার পাওয়ার’ হয়ে উঠেছে ওই রাষ্ট্র।
০২২৫
প্রশান্ত মহাসাগর থেকে আটলান্টিক পর্যন্ত সুবিশাল ভূখণ্ডের উপর সার্বভৌমত্ব থাকা দেশটির নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বর্তমানে আয়তনের নিরিখে এটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম দেশ। কিন্তু ২৫০ বছর আগে আকারে মোটেই এত বড় ছিল না আমেরিকা।
০৩২৫
১৭৭৬ সালের ৪ জুলাই ব্রিটেনের পরাধীনতা থেকে মুক্তি পেতে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র জারি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৩টি উপনিবেশ। ঘোষণাপত্রে নতুন রাষ্ট্রের নাম ‘ইউনাইটেড কলোনিজ় অফ আমেরিকা’ রাখা হয়েছিল। উত্তরের ম্যাসাচুসেট্স থেকে দক্ষিণে জর্জিয়া পর্যন্ত ১১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা ছিল এর অন্তর্গত।
০৪২৫
আমেরিকাবাসীর ওই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র মেনে নেয়নি ব্রিটেন। ফলে একে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে বেধে যায় তুমুল যুদ্ধ। লড়াইয়ে শেষ পর্যন্ত হার মানে ইংরেজ বাহিনী। আটলান্টিকের পার থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয় তাদের। সেখানে জন্ম নেয় স্বাধীন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির প্রথম প্রেসিডেন্ট ছিলেন স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া কিংবদন্তি জর্জ ওয়াশিংটন।
০৫২৫
১৭৮৩ সালের প্যারিস শান্তি চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় ব্রিটেন। ফলে অ্যাপালেশিয়ান পর্বতমালা থেকে মিসিসিপি নদীর তীর পর্যন্ত এলাকা নিয়ে গড়ে ওঠে নতুন দেশ। এর দক্ষিণে ছিল স্পেনীয় উপনিবেশ ফ্লোরিডা আর উত্তরে কানাডা। ওই সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মোট আয়তন ছিল প্রায় ২০ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার।
০৬২৫
নতুন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশের পর প্রথম ২০ বছর আমেরিকার মাত্রচিত্রের কোনও বদল ঘটেনি। রাষ্ট্রের সীমানা বৃদ্ধির প্রথম সুযোগটি আসে ১৮০৩ সালে। ওই বছর এক ধাক্কায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পায় যুক্তরাষ্ট্রের আকার। সৌজন্যে ২১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটারের লুইজ়িয়ানা প্রদেশের অন্তর্ভুক্তি।
০৭২৫
যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-মধ্য এলাকার লুইজ়িয়ানা ছিল ফ্রান্সের দখলে। ১৯ শতকের গোড়ায় ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ান বোনাপার্ট জড়িয়ে পড়েন ইউরোপের যুদ্ধে। এর খরচ চালাতে প্রয়োজন ছিল মোটা টাকার। ফলে লুইজ়িয়ানা বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তিনি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে দ্রুত তাঁর থেকে এলাকাটি কিনে নিতে এতটুকু দেরি করেননি আমেরিকার তৎকালীন শাসকেরা।
০৮২৫
লুইজ়িয়ানা হাতে পেতে ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ানকে তখনকার দিনে ১ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, একরকম জলের দরেই ২১ লক্ষ বর্গ কিলোমিটার এলাকা কব্জা করে আমেরিকা। সেখানকার শাসকদের পরবর্তী নজর পড়েছিল ফ্লোরিডার উপর।
০৯২৫
আটলান্টিকের তীরের ফ্লোরিডা ১৫৬৫ সাল থেকে ছিল স্পেনের উপনিবেশ। কিন্তু ১৯ শতক আসতে আসতে মাদ্রিদ বুঝতে পারে এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ রাখা আর সম্ভব হবে না। তত দিনে এই এলাকা নিয়ে আগ্রাসী মনোভাব দেখাতে শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এই অবস্থায় সমাধানসূত্র পেতে আলোচনার টেবিলকেই বেছে নেন স্পেনীয় শাসকেরা।
১০২৫
১৮১৯ সালে আমেরিকার সঙ্গে যুক্ত হয় ফ্লোরিডা। বিনিময়ে মাত্র ৫০ লক্ষ ডলার নিয়েই খুশি থাকতে হয়েছিল স্পেনকে। ফ্লোরিডার সংযুক্তিতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নেন আমেরিকার তৎকালীন বিদেশ সচিব জন কুইন্সি অ্যাডামস।
১১২৫
লুইজ়িয়ানা ও ফ্লোরিডা অতি সহজে কব্জা করতে পারলেও টেক্সাসের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণের এই রাজ্যটি একটা সময়ে ছিল মেক্সিকোর অংশ। পরবর্তী কালে সেখান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জন্ম নেয় স্বাধীন টেক্সাস প্রজাতন্ত্র। ১৮৪৫ সালে শান্তিপূর্ণ ভাবে তা যোগ দেয় আমেরিকার সঙ্গে।
১২২৫
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে টেক্সাসের অন্তর্ভুক্তি একেবারেই মেনে নেয়নি মেক্সিকো। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাড়তে থাকে উত্তেজনা। ১৮৪৬ সালে মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে আমেরিকার সরকার। পরবর্তী দু’বছর ধরে চলেছিল সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
১৩২৫
এই যুদ্ধেও জয়ী হয় মার্কিন সেনাবাহিনী। পরাজিত মেক্সিকো গুয়াদালুপে হিডালগো চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হয়েছিল। শর্ত অনুযায়ী টেক্সাসের যুক্তরাষ্ট্রে অন্তর্ভুক্তি মেনে নেয় তারা। শুধু তা-ই নয়, ক্যালিফোর্নিয়া, নেভাডা, অ্যারিজ়োনা, কলোরাডো, উটা, নিউ মেক্সিকো এবং ওয়াইয়োমিংকেও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে তুলে দিতে বাধ্য হয় মেক্সিকোর সরকার।
১৪২৫
গুয়াদালুপে হিডালগো চুক্তির ফলে দেশের প্রায় অর্ধেক জমি হারিয়ে অনেকটাই শক্তিহীন হয়েছিল মেক্সিকো। শর্ত অনুযায়ী, মাত্র ১ কোটি ৫০ লক্ষ ডলার ওই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে পেয়েছিল ওই দেশ। এর পর আর কখনওই আমেরিকাকে টেক্কা দেওয়ার মতো জায়গায় নিজেদের নিয়ে যেতে পারেনি মেক্সিকো।
১৫২৫
মেক্সিকোর সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালীনই ওরেগন প্রদেশ নিয়ে ব্রিটেনের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যান মার্কিন শাসকেরা। শেষে একটি চুক্তির মাধ্যমে ওই এলাকাটি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। ওরেগন হাতে পাওয়ার পর আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত হয় আমেরিকার ভূমি। এর সংযুক্তির সালটি ছিল ১৮৪৬।
১৬২৫
১৮৫৩ থেকে ১৮৫৬ সাল পর্যন্ত ইউরোপে চলে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ। এই লড়াইয়ে ব্রিটেন, ফ্রান্স ও অটোমান সাম্রাজ্যের হাতে পরাজিত হয় রাশিয়া। এর পরই আলাস্কা বিক্রি করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব ইউরোপের ওই দেশ। ফলে নতুন এলাকা হাতে পাওয়ার সুযোগ চলে আসে আমেরিকার কাছে।
১৭২৫
রুশ জ়ার (সম্রাট) দ্বিতীয় আলেকজ়ান্ডার আলাস্কাকে কখনওই ব্রিটেনের হাতে তুলে দিতে রাজি ছিলেন না। আর তাই বিক্রির ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেন তিনি। দীর্ঘ দর কষাকষির পর ১৮৬৭ সালের ৩০ মার্চ মাত্র ৭২ লক্ষ ডলারে সুবিশাল এলাকাটি কিনে নেন আমেরিকা।
১৮২৫
১৯৫৯ সালে আলাস্কাকে ৪৯তম রাজ্যের স্বীকৃতি দেয় যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক আট মাসের মাথায় আমেরিকার সঙ্গে ৫০তম রাজ্য হিসাবে যুক্ত হয় প্রশান্ত মহাসাগরের বুকের হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ। দেশটির মূল ভূখণ্ড থেকে এর দূরত্ব প্রায় আড়াই হাজার মাইল।
১৯২৫
আমেরিকার একটি রাজ্য হওয়ার আগে পর্যন্ত হাওয়াইয়ে ছিল সাংবিধানিক রাজতন্ত্র। প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপপুঞ্জটির শেষ রানি ছিলেন লিলু ওকালানি। মার্কিন মেরিনদের সাহায্যে ১৮৯৮ সালে তাঁকে ক্ষমতাচ্যুত করে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এর কয়েক দিনের মাথায় হাওয়াইকে তাদের প্রশাসনিক এলাকা বলে ঘোষণা করে আমেরিকা।
২০২৫
হাওয়াইয়ে ক্ষমতা বদলের বছরেই (পড়ুন ১৮৯৮ সাল) প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় ক্ষমতা দখলকে কেন্দ্র করে স্পেনের সঙ্গে যুদ্ধে জড়ায় যুক্তরাষ্ট্র। মাত্র চার মাসের মধ্যেই স্পেনীয় বাহিনীকে ছিন্নভিন্ন করে দেয় আমেরিকার সেনা। ফলে একে একে ওয়াশিংটনের দখলে যায় গুয়াম, পুয়ের্তো রিকো, ফিলিপিন্স এবং কিউবা।
২১২৫
১৯৪৬ সালে আমেরিকার পরাধীনতার শৃঙ্খল কেটে বেরিয়ে আসে ফিলিপিন্স। কিউবা স্বাধীনতা পায় ১৯০২ সালে। অন্য দিকে গৃহযুদ্ধের সুযোগ নিয়ে আমেরিকান সামোয়া দখল করে যুক্তরাষ্ট্র। সালটা ছিল ১৯০০।
২২২৫
ফিলিপিন্স ও কিউবা স্বাধীনতা পেলেও গুয়াম ও পুয়ের্তো রিকোকে হাতছাড়া করেনি আমেরিকা। ১৯১৭ সালে ডেনমার্কের থেকে ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ কিনে নেয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এর জন্য মার্কিন সরকারের ওই সময়ে খরচ হয়েছিল ২৫ কোটি ডলার।
২৩২৫
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর রাষ্ট্রপুঞ্জের হস্তক্ষেপে উত্তর মারিয়ানা দ্বীপপুঞ্জ, মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া যুক্তরাজ্য এবং পালাউকে হাতে পায় আমেরিকা। কিন্তু পরবর্তী কালে চুক্তির মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে স্বাধীনতা লাভ করে মার্শাল দ্বীপপুঞ্জ, মাইক্রোনেশিয়া যুক্তরাজ্য এবং পালাউ। তবে এই দেশগুলিতে আমেরিকার নৌবাহিনীর অবাধ যাতায়াত রয়েছে।
২৪২৫
চলতি বছরে দ্বিতীয় বার আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসাবে শপথ নিয়েছেন ডোনান্ড ট্রাম্প। ইতিমধ্যেই কানাডা এবং গ্রিনল্যান্ডের উপর দাবি জানিয়েছেন তিনি। কানাডাকে আমেরিকার ৫১তম রাজ্য করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। আর সুমেরু সাগর সংলগ্ন পৃথিবীর বৃহত্তম দ্বীপ গ্রিনল্যান্ডকে ডেনমার্কের থেকে কিনে নেওয়ার ইচ্ছাপ্রকাশ করেছেন ট্রাম্প।
২৫২৫
এর পাশাপাশি মেক্সিকো উপসাগরের নাম বদল করেছেন আমেরিকার নতুন প্রেসিডেন্ট। পানামা খালের নিয়ন্ত্রণও যুক্তরাষ্ট্রের হাতে থাকা উচিত বলে মন্তব্য করতে শোনা গিয়েছে তাঁকে। ফলে আগামী দিনে আমেরিকা কলেবর আরও বৃদ্ধি পায় কি না, সেটাই এখন দেখার।