India imports huge soybean oil from Argentina due to scrap of export tax, may price cut in festive season dgtl
Indian Import of Soybean Oil
মেসি-মারাদোনার দেশ থেকে দু’দিনে তিন লক্ষ টন সয়াবিন তেল আমদানি, রুশ কায়দায় ঝোপ বুঝে কোপ নয়াদিল্লির!
খাদ্যদ্রব্যের উপর থেকে কর প্রত্যাহারে হু হু করে নেমেছে দাম। ফলে আর্জেন্টিনা থেকে সস্তা দরে বিপুল পরিমাণে সয়াবিনের তেল কিনছে নয়াদিল্লি। উৎসবের মরসুমে একে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘মাস্টারস্ট্রোক’ বলে মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৫২
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
ফের ঝোপ বুঝে কোপ! উৎসবের মরসুমে মাত্র দু’দিনে আর্জেন্টিনার থেকে তিন লক্ষ মেট্রিক টন সয়াবিন তেল কিনল ভারত। এর আগে বুয়েনস আইরেসের থেকে এই হারে কখনওই কোনও খাদ্যদ্রব্য আমদানি করেনি নয়াদিল্লি। আর তাই কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারের এ-হেন সিদ্ধান্তকে ‘মাস্টারস্ট্রোক’ হিসাবেই দেখছেন আর্থিক বিশ্লেষকদের একাংশ। এর জেরে ইন্দোনেশিয়া এবং মালয়েশিয়ার উপরে নির্ভরশীলতা অনেকটাই কমবে বলেই দাবি করেছেন তাঁরা।
০২২১
সম্প্রতি বেশ কিছু খাদ্যদ্রব্যের উপর রফতানি কর বাতিল করে আর্জেন্টিনা। সেই তালিকায় রয়েছে সয়াবিন তেল। বর্তমানে যার মজুত কমানোর চেষ্টা করছে বুয়েনস আইরেস। রফতানি কর প্রত্যাহার হতেই হু-হু করে নেমে যায় দাম। সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ আমেরিকার দেশটি থেকে বিপুল পরিমাণে ওই ভোজ্য তেল আমদানি শুরু করেছে ভারত। এতে আর্থিক দিক থেকে নয়াদিল্লি যে লাভবান হচ্ছে, তা বলাই বাহুল্য।
০৩২১
এ দেশের খাদ্যদ্রব্য ডিলারদের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরের ২৩ এবং ২৪ সেপ্টেম্বর আর্জেন্টিনা থেকে এসেছে তিন লক্ষ টন সয়াবিন তেল। মাত্র দু’দিনের নিরিখে এই অঙ্ককে সর্বাধিক বলেছেন তাঁরা। ভোজ্যতেলের মধ্যে ভারতের ঘরোয়া বাজারে পাম অয়েলের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। সেই তেল আসে মূলত ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া থেকে। বুয়েনস আইরেসের সঙ্গে ব্যবসা সেই সূচককে নিম্নমুখী করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
০৪২১
আর্জেন্টিনার থেকে সয়াবিন তেল সরকারি ভাবে আমদানি করেনি কেন্দ্র। এর জন্য বুয়েনস আইরেসের সঙ্গে চুক্তি সেরে নিয়েছে এখানকার একাধিক বেসরকারি সংস্থা। সমঝোতা অনুযায়ী, আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত ভোজ্যতেলটির সরবরাহ বজায় রাখবে ওই দক্ষিণ আমেরিকার দেশ।
০৫২১
বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের কাছে মুখ খুলেছেন দিল্লির এক ডিলার। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই ব্যক্তি বলেন, ‘‘এত অল্প সময়ের মধ্যে এই পরিমাণ কেনাকাটা অভূতপূর্ব। ভারতের ব্যবসায়ীরা এত দিন শুধুমাত্র পাম তেলের উপরে নির্ভরশীল ছিলেন। সেই একমুখী লেনদেনের থেকে এ বার কিছুটা সরে আসার সুযোগ পাবেন তাঁরা।’’
০৬২১
গত ২২ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করা এবং বিদেশি মুদ্রাভান্ডারে ডলারের অঙ্ক বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয় আর্জেন্টিনার সরকার। খাদ্যদ্রব্যের উপর রফতানি কর প্রত্যাহার করে তারা। আর্থিক বিশ্লেষকদের অবশ্য দাবি, বুয়েনস আইরেসের সামনে এটা ছাড়া অন্য কোনও রাস্তা খোলা ছিল না। কারণ বর্তমানে অত্যন্ত দুর্বল হয়ে গিয়েছে তাদের মুদ্রা পেসো। ফলে ঘরোয়া বাজারে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম।
০৭২১
অন্য দিকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় উদ্ভিজ্জ ভোজ্যতেলের ক্রেতা হল ভারত। নয়াদিল্লি বিদেশ থেকে মূলত সয়াবিন এবং পাম তেল আমদানি করে থাকে। সর্ষের তেল উৎপাদনের বেশির ভাগটাই হয় ঘরের মাটিতে। ডিলারেরা জানিয়েছে, সাধারণত মাসে তিন লক্ষ সয়াবিন তেল আসে বিদেশ থেকে। যেটা মাত্র দু’দিনে আর্জেন্টিনা থেকে সরবরাহ হয়েছে। এর জন্য বুয়েনস আইরেসে রফতানি কর প্রত্যাহারের সিদ্ধান্তকেই দায়ী করেছেন তাঁরা।
০৮২১
সূত্রের খবর, দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির থেকে টনপিছু সয়াবিন তেল ১,১০০ থেকে ১,১২০ ডলারে কিনেছে ভারত। এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বিমা এবং পরিবহণ খরচ। এ দেশের শীর্ষ বাণিজ্য সংস্থা ‘সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন অফ ইন্ডিয়া’ জানিয়েছে, আর্জেন্টিনা রফতানি কর প্রত্যাহার করায় সয়াবিন তেলের দাম টনপ্রতি ৫০ ডলার কমে যায়। এর পরই পাম তেল ছেড়ে ওই ভোজ্য তেল আমদানিতে মেতে ওঠেন এখানকার ব্যবসায়ীরা।
০৯২১
গত অগস্টে ভারতে সয়াবিন তেলের আমদানি ২৫.২৭ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৩ কোটি ৬৭ হাজার ৯১৭ টনে গিয়ে পৌঁছোয়। শেষ চার মাসের নিরিখে যেটা সর্বনিম্ন। আর্জেন্টিনা ছাড়াও ব্রাজ়িল, রাশিয়া এবং ইউক্রেন থেকে সংশ্লিষ্ট ভোজ্যতেলটি কিনতে থাকে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া সংশ্লিষ্ট দেশগুলি থেকে ভারতে আসে সূর্যমুখী তেলও।
১০২১
অগস্টে সামগ্রিক ভাবে উদ্ভিজ্জ তেলের আমদানি বাড়িয়েছিল কেন্দ্র। ফলে এর সূচক ৪.৭ শতাংশ ঊর্ধ্বমুখী হয়ে পৌঁছোয় ১৬ লক্ষ ২০ হাজার টনে। গত বছরের জুলাইয়ের পর এই অঙ্ক সর্বোচ্চ বলে জানা গিয়েছে। পরিসংখ্যান বলছে, ফি বছর উৎসবের মরসুমে এ দেশের ঘরোয়া বাজারে বৃদ্ধি পায় পাম, সূর্যমুখী এবং সয়াবিন তেলের চাহিদা। কারণ, এই সময় ভাজা খাবার তৈরি ও বিক্রি হয় বেশি।
১১২১
চলতি বছরের জুলাইয়ে আর্জেন্টিনা সফর করেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সেখানকার প্রেসিডেন্ট জেভিয়ার মিলেইয়ের সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক সারেন তিনি। তাতে উপস্থিত ছিলেন বিদেশমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর এবং বিদেশসচিব বিক্রম মিস্রীও। এর দু’মাসের মাথাতেই দক্ষিণ আমেরিকার দেশটির সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক বাড়াল নয়াদিল্লি।
১২২১
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গত ৫৭ বছরে ভারতের কোনও প্রধানমন্ত্রী আর্জেন্টিনায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেননি। যদিও রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে মোদীর এটা দ্বিতীয় সফর। এর আগে ২০১৮ সালে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনের জন্য আর্জেন্টিনায় গিয়েছিলেন তিনি। সে বার শুধুমাত্র সেখানে বসবাসকারী ভারতীয়দের সঙ্গে দেখা করে দেশে ফিরেছিলেন নমো।
১৩২১
জুলাইয়ে মোদী-মিলেইয়ে বৈঠকের পর বিবৃতি দেয় বিদেশ মন্ত্রক। সেখানে বলা হয়, প্রতিরক্ষা, কৃষি, খনিজ, তেল ও গ্যাস, বাণিজ্য এবং বিনিয়োগের মতো গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ভারত এবং আর্জেন্টিনার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করার বিষয়ে জোর দেওয়া হয়েছে। নয়াদিল্লি সেই লক্ষ্যে ধীরে ধীরে পা ফেলতে শুরু করে দিয়েছে বলেই মনে করছেন আর্থিক বিশ্লেষকেরা।
১৪২১
২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ইউক্রেনে ‘বিশেষ সেনা অভিযান’ (স্পেশ্যাল মিলিটারি অপারেশন) চালাচ্ছে রাশিয়া। পূর্ব ইউরোপের ওই যুদ্ধ শুরু হওয়া ইস্তক মস্কোর উপর ১৬ হাজার নিষেধাজ্ঞা চাপিয়ে দেয় যুক্তরাষ্ট্র-সহ পশ্চিমি বিশ্ব। এর পরই দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে ভারতকে সস্তা দরে খনিজ তেল বিক্রির মেগা অফার দেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। এই টোপ গিলতে বিন্দুমাত্র দেরি করেনি নয়াদিল্লি।
১৫২১
গত তিন বছর ধরে রাশিয়ার থেকে কেনা সস্তা দরের ‘তরল সোনা’ পরিশোধন করে পেট্রোপণ্যের রফতানি বাড়িয়েছে ভারত। অগস্টে এই নিয়ে প্রবল আপত্তি তোলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তাঁর যুক্তি, নয়াদিল্লির এই পদক্ষেপের জেরে ইউক্রেন যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার মতো টাকা হাতে পেয়ে যাচ্ছে মস্কো। আর তাই ‘শাস্তি’ হিসাবে এ দেশের পণ্যে ৫০ শতাংশ চাপিয়েছেন তিনি।
১৬২১
ট্রাম্পের ওই সিদ্ধান্তের পরও রুশ তেল আমদানি বন্ধ করার কোনও প্রশ্ন নেই বলে ঘোষণা করে দেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। সেপ্টেম্বরে জানা যায়, শেষ দু’মাসে মস্কোর থেকে ‘তরল সোনা’ আমদানি বৃদ্ধি করেছে নয়াদিল্লি। এ বছরের জুলাইয়ে ক্রেমলিনের থেকে ভারতে এসেছে দিনে ১৫ লক্ষ ৯০ হাজার ব্যারেল অপরিশোধিত তেল। অগস্টে যা বেড়ে ১৫ লক্ষ ৬০ হাজার ব্যারেল ছুঁয়ে ফেলে।
১৭২১
দক্ষিণ আমেরিকার দেশ আর্জেন্টিনার অর্থনীতি একটা সময় খুবই শক্তিশালী ছিল। ১৯২০ সাল নাগাদ এ ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রকে ছুঁয়ে ফেলেছিল তারা। কিন্তু পরবর্তী কালে সম্পূর্ণ বদলে যায় পরিস্থিতি। ৩০-এর দশকে বিশ্ব মন্দার কবলে পড়ে মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয় বুয়েনস আইরেস। মেসি-মারাদোনার দেশের আর্থিক দুরবস্থার নেপথ্যে দ্বিতীয় কারণ হিসাবে শিল্পের অনগ্রসরকে দায়ী করেছেন অনেকে।
১৮২১
আর্জেন্টিনার বর্তমান দুর্বল অর্থনীতির নেপথ্যে রাজনৈতিক অস্থিরতার ভূমিকাও নেহাত কম নয়। ১৯৩০ সালের ৬ সেপ্টেম্বর সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন জেনারেল হোসে ফেলিক্স উরিবুরু। কিছু দিন চলার পর সেখানে গণতন্ত্র ফিরেছিল। কিন্তু ১৯৪৩ সালে ফের ক্ষমতা দখল করে সেনাবাহিনী।
১৯২১
বার বার সেনা অভ্যুত্থানের ফলে আর্জেন্টিনার অর্থনীতির সূচক হু হু করে নামতে থাকে। গত শতাব্দীর ৫০-এর দশকে দেশকে স্বনির্ভর করে তোলার নামে রফতানি বাণিজ্যের উপর নানা বিধিনিষেধ আরোপ করতে থাকেন সেখানকার সেনাশাসকেরা। আর্জেন্টিনার দরজা অন্যান্য দেশের জন্য একরকম বন্ধই করে দেন তাঁরা।
২০২১
১৯৯০-এর দশকে মুদ্রাস্ফীতির জেরে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম আমজনতার নাগালের বাইরে চলে যায়। ফলে আর্জেন্টিনা জুড়ে শুরু হয় গণবিক্ষোভ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ওই সময়ে দেখামাত্রই গুলির মতো কড়া নির্দেশিকা জারি করেন সেনাশাসকেরা। পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক অর্থভান্ডার (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) থেকে ফের মোটা অঙ্কের ঋণ নেন তাঁরা।
২১২১
আইএমএফের থেকে নেওয়া ঋণে গত শতাব্দীর শেষের দিকে পরিস্থিতি কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছিল। কিন্তু প্রতি পাঁচ থেকে ছ’বছর পর ওই টাকা ফেরত দেওয়ার সময় এলেই দেউলিয়া হয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার এই দেশ। গত ১০০ বছরে অন্তত ন’বার একেবারে সিন্দুক খালি অবস্থার মুখোমুখি হয়েছে বুয়েনস আইরেস। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তাঁদের ভাগ্য ফেরায় কি না, সেটাই এখন দেখার।