এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৮
জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলায় ২৬ জনের মৃত্যুতে বদলার আগুনে ফুঁসছে ভারত। প্রত্যাঘাত শানাতে এ বার পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের (পাকিস্তান অকুপায়েড কাশ্মীর বা পিওকে) হাজি পির গিরিপথ ছিনিয়ে নেবে নয়াদিল্লি? রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ক্রাইমিয়া প্রসঙ্গ টেনে এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই সুর চড়াতে শুরু করেছেন সাবেক সেনা অফিসারেরা। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্ত নিলে উপত্যকায় সন্ত্রাসী কার্যকলাপে অনেকটাই হ্রাস টানা যাবে বলে স্পষ্ট করেছেন তাঁরা।
০২১৮
চলতি বছরের ১৪ জানুয়ারি, জম্মুর আখনুরে একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় হঠাৎ করেই হাজি পির গিরিপথের প্রসঙ্গ তোলেন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিংহ। তিনি বলেন, ‘‘৬০ বছর আগে পিওকের ওই পাহাড়ে তেরঙা পতাকা উড়িয়েছিল ভারতীয় সেনা। আমরা যদি সেটা ইসলামাবাদকে না দিতাম, তা হলে জঙ্গি অনুপ্রবেশের ক্ষত এত দিনে বুজিয়ে ফেলত কাশ্মীর।’’ তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে তিন মাসের মাথায় পহেলগাঁও হত্যাকাণ্ডের পর রাজনাথের ওই মন্তব্যকে নিয়ে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা।
০৩১৮
পাক অধিকৃত কাশ্মীরের হাজি পির গিরিপথের কৌশলগত অবস্থান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর উচ্চতা ২,৬৩৭ মিটার। গোয়েন্দা সূত্রে খবর, দীর্ঘ দিন ধরেই এই গিরিপথটির মাধ্যমে উপত্যকায় জঙ্গি অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে যাচ্ছে পাক ফৌজ। কারণ হাজি পির কাশ্মীরের পুঞ্চকে পিওকের রাওয়ালকোটের সঙ্গে সংযুক্ত করে। এ ছাড়া পুঞ্চ ও উরির মধ্যে ২৮২ কিলোমিটার রাস্তাকে ৫৬ কিলোমিটারে নামিয়ে আনে এই গিরিপথ।
০৪১৮
১৯৪৭ সালে পাক হানাদার বাহিনী আক্রমণ করার আগে পর্যন্ত জম্মু এবং কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হত হাজি পির গিরিপথ। লড়াইয়ের গোড়াতেই তাই কৌশলগত দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ওই জায়গাটি দখল করে ইসলামাবাদ। ওই সময়ে তীব্র প্রত্যাঘাত শানিয়েও হাজি পির গিরিপথকে পুনর্দখল করতে পারেনি ভারতীয় সেনা। ১৯৪৮ সালে সংঘর্ষবিরতি হলে ওই পাহাড়ি রাস্তার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় রাওয়ালপিন্ডির সেনা অফিসারদের হাতে।
০৫১৮
১৯৬৫ সালের যুদ্ধে পাক ফৌজের থেকে হাজি পির গিরিপথ পুর্নদখল করে ভারতীয় সেনা। এর ১৬ আনা কৃতিত্ব ছিল মেজর পদমর্যাদার অফিসার রঞ্জিৎ সিংহ দয়ালের। ওই বছরের অগস্টে ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এর অনুমোদন দেন পাকিস্তানের তৎকালীন সেনাশাসক তথা প্রেসিডেন্ট জেনারেল আয়ুব খান। লক্ষ্য ছিল গেরিলা বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণে গোটা জম্মু-কাশ্মীর দখল করা। কিন্তু, বাস্তবে আয়ুবের সেই স্বপ্ন পূরণ হয়নি।
০৬১৮
‘অপারেশন জিব্রাল্টার’-এ পাক ফৌজ আক্রমণের ঝাঁজ বাড়াতেই প্রত্যাঘাতের রাস্তা ধরে ভারত। ১৯৬৫ সালের ১৫ অগস্ট যুদ্ধবিরতিরেখা অতিক্রম করে পিওকের তিনটি পাহাড় কব্জা করে এ দেশের বাহিনী। তার মধ্যে অন্যতম ছিল হাজি পির গিরিপথ। ভারতীয় সেনার এই দুঃসাহসিক অভিযানের নাম ছিল ‘অপারেশন বক্সী’।
০৭১৮
পূর্বে বেদোরি (৩,৭৬০ মিটার), পশ্চিমে সাংক (২,৮৯৫ মিটার) এবং দক্ষিণ-পশ্চিমে লেদওয়ালি গলির (৩,১৪০ মিটার) পাহাড়ি এলাকার মধ্যে হাজি পির গিরিপথের অবস্থান। ‘অপারেশন বক্সী’তে এই গোটা এলাকা পুনর্দখলের দায়িত্ব ছিল মেজর জেনারেল এসএস কালানের নেতৃত্বাধীন ১৯ পদাতিক ডিভিশন এবং ব্রিগেডিয়ার জেডসি বক্সীর নেতৃত্বাধীন ৬৮ পদাতিক ডিভিশনের রিজ়ার্ভ কোরের উপর।
০৮১৮
১৯৬৫ সালের ২৬ অগস্ট সাংকে দখল করে ভারতীয় সেনার এক নম্বর প্যারাশুট রেজিমেন্ট। এর জন্য প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই সৈনিকদের খাড়াই পাহাড়ে চড়তে হয়েছিল। সাংকে দখলের পর লেদওয়ালি গলির উপর প্রবল চাপ তৈরি করে ভারতীয় ফৌজ। পাক সেনার সেটা সহ্য করার ক্ষমতা ছিল না। ফলে এক দিনের মাথায় লেদওয়ালি গলি হাতছাড়া হয় তৎকালীন সেনাশাসক আয়ুব খানের।
০৯১৮
পরিকল্পনা অনুযায়ী, পরবর্তী পর্যায়ে বেদোরি দখলে ভারতীয় সেনার ঝাঁপিয়ে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে আক্রমণের ছক বদলান ব্রিগেডিয়ার বক্সী। মেজর রঞ্জিৎ সিংহ দয়ালকে হাজি পির গিরিপথ দখলের নির্দেশ দেন তিনি। তাঁকে ব্রিগেডিয়ার বক্সী বলেন, ‘‘যদি তুমি জয়ী হও, তা হলে বীরের সম্মান পাবে। আর যদি ব্যর্থ হও তা হলে একতরফা উল্টো সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য গ্রেফতার হব আমি।’’
১০১৮
ব্রিগেডিয়ার বক্সীর এই কথায় অপারেশনের গুরুত্ব বুঝতে মেজর রঞ্জিতের দেরি হয়নি। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে সারা রাত হেঁটে বাহিনী নিয়ে হাজি পির গিরিপথে পৌঁছোন তিনি। ১৯৬৫ সালের ২৮ অগস্ট গোটা এলাকা নিয়ন্ত্রণে চলে আসে তাঁর। রঞ্জিত জানতেন হাজি পির পুনর্দখলের জন্য প্রবল প্রত্যাঘাত শানাবে পাক সেনা। সেইমতো যাবতীয় প্রস্তুতি নেন তিনি। গেরিলা যুদ্ধের জন্য তৈরি রাখেন বাহিনীকে।
১১১৮
মেজর রঞ্জিতের অনুমান মিথ্যা হয়নি। ২৯ অগস্ট হাজি পির গিরিপথ পুনর্দখলে ঝাঁপিয়ে পড়ে পাক ফৌজ। কিন্তু, ভারতীয় সেনার থেকে মুখের মতো জবাব পেয়ে পিছু হটতে হয় তাঁদের। ওই লড়াইয়ে ইসলামাবাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল যথেষ্ট বেশি। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, হাজি পির গিরিপথ জয়ের পরই ঘুরে যায় যুদ্ধের মোড়। ‘অপারেশন জিব্রাল্টার’ যে ব্যর্থ হতে চলেছে, তা হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারেন আয়ুব খান।
১২১৮
১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় ভারত-পাক যুদ্ধে দাঁড়ি পড়েছিল। সংঘর্ষবিরতির শর্ত অনুযায়ী, ইসলামাবাদকে হাজি পির গিরিপথ ফিরিয়ে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। সরকারের এই সিদ্ধান্তে যথেষ্ট ক্ষিপ্ত ছিলেন লড়াইয়ের নায়ক রঞ্জিত সিংহ দয়াল। পরবর্তী কালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল পদে উত্তীর্ণ হন তিনি।
১৩১৮
ওই ঘটনার পাঁচ বছরের মাথায় ফের একবার হাজি পির গিরিখাত পুনর্দখলের সুবর্ণসুযোগ পেয়েছিল নয়াদিল্লি। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ যুদ্ধে ইসলামাবাদকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে ভারতীয় ফৌজ। ঢাকায় ৯৩ হাজার পাক সেনার আত্মসমর্পণের মাধ্যমে ওই লড়াইয়ে ইতি টানা হয়েছিল। পরের বছর, অর্থাৎ ১৯৭২ সালের শিমলা চুক্তিতে আত্মসমর্পণকারী সৈনিকদের ফিরিয়ে দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী।
১৪১৮
’৭১ সালের যুদ্ধে পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম দেয় ভারত। লড়াইয়ে ইসলামাবাদের নৌবাহিনী একরকম ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। ফলে শিমলা সমঝোতায় পাক অধিকৃত কাশ্মীর বা হাজি পির গিরিপথের প্রসঙ্গ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তুলবেন বলে মনে করা হয়েছিল। কিন্তু, বাস্তবে তা হয়নি। ফলে গত শতাব্দীর ৯০-এর দশকে ওই পাহাড়ি রাস্তা ব্যবহার করে জঙ্গিদের সীমান্ত পার করানো শুরু করে পাক সেনা ও গুপ্তচর বাহিনী।
১৫১৮
অবসরের পর এই ইস্যুতে মুখ খোলেন হাজি পির পাস জয়ের নায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল রঞ্জিত সিংহ দয়াল। ২০০২ সালে দেওয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘‘ওই এলাকা হাতে থাকলে সব সময়ের জন্য পাকিস্তানকে চাপে রাখা যেত। এটি ফিরিয়ে দেওয়া বড় ভুল ছিল। মুশকিল হল আমাদের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা মানচিত্রের গুরুত্ব বোঝেন না।’’
১৬১৮
১৯৫৪ সালে পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের হাতে ক্রাইমিয়া তুলে দেয় তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। কিন্তু ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ভেঙে যাওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। ২১ শতকের প্রথমার্ধে কিভে আমেরিকার নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট নেটোর দিকে ঝুঁকতে শুরু করায় প্রমাদ গোনেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। ফলে ২০১৪ সালে সেনা অভিযান চালিয়ে ক্রাইমিয়া পুনর্দখল করেন তিনি।
১৭১৮
হাজি পির গিরিপথের মতো ক্রাইমিয়ার কৌশলগত অবস্থানও খুবই গুরুত্বপূর্ণ। উপকূলীয় এলাকাটিকে ঘিরে রয়েছে আজ়ভ সাগর ও কৃষ্ণ সাগর। এটি পুনর্দখল করার ফলে ইউক্রেনের সামুদ্রিক রাস্তা একরকম বন্ধই করে দিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন। ফলে কিভের পক্ষে মস্কোর নৌঘাঁটি বা বন্দরগুলিতে হামলা করা একরকম অসম্ভব হয়ে গিয়েছে।
১৮১৮
পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার পর সাবেক সেনাকর্তাদের বড় অংশই তাই চাইছেন, এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ফের হাজি পির গিরিপথ পুনর্দখল করুক ভারত। কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নিলে সীমান্ত পার সন্ত্রাস প্রায় শূন্যে নেমে আসবে। তবে দিল্লি শেষ পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত নেয় কি না, সেটাই এখন দেখার।