Indian origin engineer became Chinese spy, supplied B-2 Spirit US stealth strategic bomber technology to Beijing dgtl
Chinese Espionage in US
মার্কিন বোমারু বিমান ‘বি-২’র গোপন প্রযুক্তি ফাঁস! ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের বিশ্বাসঘাতকতায় ‘উড়ন্ত ইগল’ বানায় বেজিং
মার্কিন কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’-এর আদলে যুদ্ধবিমান তৈরি করে ফেলেছে চিন। সেই প্রযুক্তি বেজিঙের হাতে তুলে দেওয়ার অভিযোগে ভারতীয় বংশোদ্ভূত ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে যুক্তরাষ্ট্র। কী ভাবে বেজিঙের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তি করতেন তিনি?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০২৫ ১০:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
ইরানের তিন পরমাণুকেন্দ্রে হামলা চালিয়ে ফের খবরের শিরোনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গর্বের কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’। আমেরিকার এই ‘শিকারি ইগল’-এর গায়ে সেঁটে আছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমানের তকমা। আটলান্টিকের পারের ‘সুপার পাওয়ার’-এর এই ‘গুমোর’ অচিরেই ভেঙে দেবে চিন? বেজিঙের স্বপ্নপূরণে আবার জড়িয়ে গিয়েছে এক ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারের নাম। তাঁকে জেলে পুরেও শান্তিতে নেই ওয়াশিংটন।
০২২০
প্রতিরক্ষা সংক্রান্ত গণমাধ্যম ‘দ্য ওয়ার জ়োন’-এর দাবি, অত্যন্ত সন্তর্পণে ‘বি-২ স্পিরিট’-এর সমকক্ষ বোমারু বিমান নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে চিন। ‘গুপ্তচর’ কৃত্রিম উপগ্রহে ধরা পড়েছে সেই ছবি। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন যুদ্ধবিমানটির নকশা বেজিঙের গবেষকদের হাতে তুলে দেওয়ার নেপথ্যে নাম জড়িয়েছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত নোশির গোয়াদিয়ার নাম। কুকীর্তি ফাঁস হতেই তাঁকে গ্রেফতার করে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা এফবিআই (ফেডারেল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশন)।
০৩২০
‘দ্য ওয়ার জ়োন’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের ১৪ মে চিনের জিনজিয়াং প্রদেশের মালান এলাকার গুপ্তঘাঁটিতে দাঁড়িয়ে থাকা ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির একটি বোমারু বিমানকে ক্যামেরাবন্দি করে মার্কিন ‘গুপ্তচর’ উপগ্রহ। সেই ছবি পেন্টাগনের কর্তাব্যক্তিদের নজরে পড়তেই চোখ কপালে ওঠে তাঁদের। ‘বি-২ স্পিরিট’-এর হুবহু ড্রাগনভূমির বোমারু বিমানটি পরীক্ষামূলক উড়ানের প্রস্তুতি নিচ্ছিল বলে জানা গিয়েছে।
০৪২০
বেজিঙের ‘পিপল্স লিবারেশন আর্মি’ বা পিএলএ বায়ুসেনার বহরে যুক্ত হতে চলা ওই বোমারু বিমানের ছবি হাতে পেতেই নড়েচড়ে বসে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর। প্রযুক্তি চুরি করে ড্রাগনভূমির গবেষকেরা যে ওই যুদ্ধবিমান তৈরি করেছেন, তা আমেরিকার গোয়েন্দাদের কাছে অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে যায়। চিনের হয়ে সেই গুপ্তচরবৃত্তির কাজটি করেন নোশির। ‘বি-২ স্পিরিট’-এর নির্মাণকারী সংস্থা ‘নর্থ্রপ গ্রুমম্যান’-এর সাবেক ইঞ্জিনিয়ার ছিলেন তিনি।
০৫২০
মহারাষ্ট্রের মুম্বইয়ে জন্ম হওয়া গোদারিয়া গত শতাব্দীর ’৬০-এর দশকে মার্কিন প্রতিরক্ষা সংস্থা নর্থ্রপে যোগ দেন। আমেরিকার অত্যাধুনিক বোমারু বিমানটির ‘স্টেল্থ’ প্রযুক্তি তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল তাঁর। ১৯৮৬ সালে ওই সংস্থার চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের একটি সংস্থা খোলেন নোশির। যুক্তরাষ্ট্রের বায়ুসেনা কিন্তু তখনও ‘বি-২ স্পিরিট’কে তাঁদের বহরে শামিল করতে পারেনি। ১৯৮৯ সালের ১৭ জুলাই প্রথম বার আকাশে ওড়ে ১৬টি পরমাণু বোমা বহনে সক্ষম ওয়াশিংটনের ‘শিকারি ইগল’। অর্থাৎ, মোট ২,৪০০ পাউন্ডের (পড়ুন ১,১০০ কেজি) আণবিক হাতিয়ার নিয়ে উড়তে পারে এই বোমারু বিমান।
০৬২০
মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘পপুলার মেকানিক্স’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৩ থেকে ২০০৪ সালের মধ্যে বেশ কয়েক বার চিন সফরে যান নোশির। ওই সময়েই ‘বি-২ স্পিরিট’-এর নকশা ও প্রযুক্তি বেজিঙের প্রতিরক্ষা গবেষকদের কাছে সরবরাহ করেন তিনি। এর জন্য ড্রাগন সরকারের থেকে তিন বছরে মোট ১ লক্ষ ১০ হাজার ডলার পেয়েছিলেন এই ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রতিরক্ষা ইঞ্জিনিয়ার।
০৭২০
২০০৪ সালে একটি আসবাবের মধ্যে যুদ্ধবিমানের ‘ইনফ্রারেড’ প্রযুক্তি বাজেয়াপ্ত করেন এফবিআইয়ের গোয়েন্দারা। তদন্তে জানা যায়, ওই আসবাব নোশিরের বাড়িতে যাওয়ার কথা রয়েছে। এর পরেই তাঁর গতিবিধির উপর নজর রাখতে শুরু করে আমেরিকার সরকার। তবে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারকে গ্রেফতার করতে এফবিআইকে অপেক্ষা করতে হয়েছে আরও একটা বছর।
০৮২০
২০০৫ সালের অক্টোবর মাসে হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জের মাউইর হাইকুতে নোশিরের বিলাসবহুল বাংলোয় তল্লাশি চালায় এফবিআই। সেখান থেকে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথি, বোমারু বিমানের জটিল প্রযুক্তি সংক্রান্ত নোট্স এবং চিনা সরকারি আধিকারিকদের সঙ্গে কথোপকথনের ইমেল বাজেয়াপ্ত করেন গোয়েন্দারা। সঙ্গে সঙ্গে গ্রেফতার করা হয় ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ারকে।
০৯২০
এফবিআই সূত্রে খবর, বেজিঙের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করে বিপুল অর্থ রোজগার করেন নোশির। ৩৫ লক্ষ ডলারের বিলাসবহুল ভিলায় থাকছিলেন তিনি। ‘নর্থ্রপ’-এ অন্দরে ‘ব্লুবেরি মিল্কশেক’ হিসাবে পরিচিতি ছিল তাঁর। বোমারু বিমানের ‘স্টেল্থ প্রপালসাল সিস্টেম’-এর আবিষ্কারে বড় ভূমিকা নেন তিনি। সেই কারণে এই সংক্রান্ত যে কোনও তথ্য যখন-তখন হাতে পাওয়ার যাবতীয় নিরাপত্তা ছাড়পত্র নোশিরকে দেওয়া হয়েছিল।
১০২০
তদন্তকারীদের দাবি, যুদ্ধবিমান নির্মাণের ব্যাপারে নোশিরের মধ্যে ছিল এক অদ্ভুত ‘পাগলামি’। এই নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ ক্লাস নিতেন তিনি। বোমারু বিমানের প্রযুক্তিকে সহজ করে পড়ুয়াদের বোঝানোর ক্ষমতা ছিল তাঁর। চিন সফরের সময় বহু বার চেংডু এবং শেনজ়েনে গিয়েছেন নোশির। ড্রাগনভূমির এই দুই শহরেই রয়েছে যাবতীয় যুদ্ধবিমান নির্মাণকারী সংস্থার সদর দফতর ও কারখানা।
১১২০
গ্রেফতারির পর অবশ্য প্রথমে গুপ্তচরবৃত্তির কথা অস্বীকার করেন মুম্বইয়ের ভূমিপুত্র নোশির। এফবিআইয়ের লাগাতার জেরার ফলে একটা সময় ভেঙে পড়েন তিনি। শুধু তা-ই নয়, তদন্তকারীদের কাছে লিখিত ভাবে সমস্ত দোষ স্বীকার করে নেন নোশির। তখনই জানা যায়, শুধু বোমারু বিমান নয়, চিনকে ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে প্রযুক্তিগত সাহায্যও করেছেন অভিযুক্ত।
১২২০
‘গুপ্তচর’ উপগ্রহের পাওয়া ছবি দেখে মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতরের শীর্ষকর্তাদের অনুমান, নোশিরের পাচার করা প্রযুক্তির সম্পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছে চিনা প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। কিছুটা ড্রোনের মতো দেখতে বেজিং যে বোমারু বিমানটি তৈরি করেছে তা ভূমি থেকে অনেকটা উঁচুতে দীর্ঘ সময় ধরে ভেসে থাকতে সক্ষম। বোমারু বিমানটির ডানার দৈর্ঘ্য আনুমানিক ৫২ মিটার (১৭০ ফুট)। এ দিক থেকে ‘বি-২ স্পিরিট’-এর সঙ্গে এর খুব মিল রয়েছে।
১৩২০
২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে ‘এইচ-২০’ নামের একটি ‘স্টেল্থ’ শ্রেণির বোমারু বিমান তৈরির কথা ঘোষণা করেন চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং। ন’বছর পেরিয়ে সেই প্রকল্পে এখনও সাফল্য পায়নি বেজিং। তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, কৃত্রিম উপগ্রহের পাঠানো ছবিতে ‘বি-২ স্পিরিট’-এর মতো দেখতে বিমানটির ঠিক পাশে একটি ‘এইচ-২০’র প্রোটোটাইপকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গিয়েছে। ফলে দু’টি ক্ষেত্রেই ড্রাগন সরকার খুব দ্রুত সাফল্য পেতে চলেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
১৪২০
মার্কিন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, বোমারু বিমানের নকশা ও প্রযুক্তি এমন একজনের থেকে চিনা গবেষকেরা পেয়েছেন, ‘বি-২ স্পিরিট’কে যিনি হাতের তালুর মতো চেনেন। এ-হেন নোশিরকে অবশ্য ক্ষমা করেনি আমেরিকা। ২০১০ সালে অস্ত্র রফতানি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের আদালত। ২০১১ সালে ৩২ বছরের জেল হয় তাঁর। এর পর থেকে কলোরাডোর ফ্লোরেন্স এলাকার সুপারম্যাক্স কারাগারের অন্ধকার কুঠুরিতে বন্দি রয়েছেন নোশির।
১৫২০
নোশির-পুত্র অ্যাশটনের অবশ্য দাবি, তাঁর বাবা নির্দোষ। আসল অপরাধীকে আড়াল করতে নোশিরকে ফাঁসানো হয়েছে। আদালতে অবশ্য সেই যুক্তি ধোপে টেকেনি। কারণ এফবিআইকে দেওয়া শেষ জবানবন্দিতে ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার বলেন, ‘‘আমি যা করেছি, সেটা গুপ্তচরবৃত্তি এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতা। সামরিক গোপন তথ্য আমার হাত দিয়েই চিনে পাচার হয়েছে।’’
১৬২০
ড্রাগনের বিরুদ্ধে প্রতিরক্ষা-সহ অন্যান্য প্রযুক্তি চুরির অভিযোগ নতুন নয়। বর্তমানে পিএলএ বায়ুসেনার বহরে রয়েছে ‘জে-৩৫’ এবং ‘জে-৩৫এ’ নামের পঞ্চম প্রজন্মের দু’টি ফাইটার জেট। বিশেষজ্ঞদের দাবি, যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত সংস্থা লকহিড মার্টিনের তৈরি ‘এফ-৩৫ লাইটনিং টু’ যুদ্ধবিমানটির নকল করে ‘জে-৩৫’ জেট নির্মাণ করেছে বেজিং। সেই কারণে ড্রাগন নির্মিত বিমানের ক্ষমতা এবং কার্যকারিতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন তাঁরা।
১৭২০
চলতি বছরের ২২ জুন ইজ়রায়েলের পক্ষে দাঁড়িয়ে ইরানের ফোরডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান— এই তিন পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনা। এর জন্য কৌশলগত ‘স্টেল্থ’ বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’ ব্যবহার করে তারা। তেহরানের তিন আণবিক কেন্দ্রকে ধ্বংস করতে টানা ৩৬-৩৭ ঘণ্টা আকাশে ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ওই বোমারু বিমান। সেই কারণে মাঝ-আকাশে জ্বালানি ভরার সুবিধাও রয়েছে ‘বি-২ স্পিরিট’-এ।
১৮২০
আমেরিকার এই বোমারু বিমান ওড়াতে প্রয়োজন হয় দু’জন যোদ্ধা পাইলটের। পরমাণু হাতিয়ারে পাশাপাশি অন্যান্য শক্তিশালী বোমা বহন এবং নিখুঁত নিশানায় শত্রু ব্যূহে আক্রমণ শানাতে সিদ্ধহস্ত এই ‘বি-২ স্পিরিট’। ইরানের পরমাণুকেন্দ্রগুলি ধ্বংস করতে এর সাহায্যে ‘জিবিইউ-৫৭’ সিরিজের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা ফেলে মার্কিন বায়ুসেনা। মোট ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমা সেখানে নিক্ষেপ করা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৯২০
দীর্ঘ ক্ষণ আকাশে ওড়ার ক্ষমতা থাকায় ‘বি-২ স্পিরিট’-এ রয়েছে যোদ্ধা পাইলটের বিশ্রাম করার জায়গা। এ ছাড়া বিমানটির ভিতরে ছোট রেফ্রিজ়ারেটর এবং মাইক্রোঅয়েভ রাখা হয়েছে। যুদ্ধের সময়ে চালক যাতে গরম খাবার খেতে পারেন তাই এই ব্যবস্থা। এই বোমারু বিমান এতটাই দামি যে এখনও পর্যন্ত মাত্র ২১টি ‘বি-২ স্পিরিট’ তৈরি করেছে আমেরিকা। কোনও ‘বন্ধু’ রাষ্ট্রকেই এটি বিক্রি করেনি যুক্তরাষ্ট্র।
২০২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, প্রযুক্তি চুরি করে চিন যতই ‘বি-২ স্পিরিট’-এর ধাঁচে বোমারু বিমান তৈরি করুক না কেন, যুদ্ধের ময়দানে তা কতটা কাজ করবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। কারণ, ১৯৭৯ সালের পর আর কোনও লড়াইয়ে অংশ নেয়নি বেজিঙের লালফৌজ। অন্য দিকে, গত বছর ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের গুপ্তঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিতেও ‘বি-২ স্পিরিট’কে উড়িয়েছিল আমেরিকা। সে দিক থেকে সব সময়েই এগিয়ে থাকবে যুক্তরাষ্ট্রের ‘শিকারি ইগল’।