Iran Israel war may change oil price airspace and sea routes, how this conflict impact on India dgtl
Iran-Israel Conflict
আকাশ ছোঁবে তেলের দাম, আরব মুলুক-ইউরোপে ধাক্কা খাবে বাণিজ্য! ইহুদি- শিয়া যুদ্ধে ‘সিঁদুরে মেঘ’ দেখছে দিল্লি
ইরান এবং ইজ়রায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ তীব্র হওয়ায় নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ। এই ‘যুদ্ধে’র আঁচ সরাসরি ভারতীয় অর্থনীতির উপরে পড়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৫ জুন ২০২৫ ০৭:৫৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
পশ্চিম এশিয়ার বাতাসে ফের বারুদের গন্ধ। ধীরে ধীরে তীব্র হচ্ছে ইরান-ইজ়রায়েল ‘যুদ্ধ’। ইতিমধ্যেই বিশ্ব অর্থনীতিতে পড়েছে তার প্রভাব। লড়াইয়ের আঁচ ভালই টের পাচ্ছে ভারতও। বিশ্লেষকদের দাবি, দীর্ঘ সময় ধরে সংঘর্ষ চললে আকাশ ছোঁবে খনিজ তেলের দাম। পাশাপাশি বন্ধ হতে পারে উপসাগরীয় দেশ লাগোয়া সমুদ্র বাণিজ্যের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। সেই কারণেই শিয়া-ইহুদি দ্বন্দ্বে নয়াদিল্লির কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
০২১৯
চলতি বছরের ১৩ জুন ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায় ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফের বিমানবাহিনী। ইহুদি সেনার এই অতর্কিত আক্রমণে প্রাণ গিয়েছে শিয়া মুলুকটির একগুচ্ছ সেনা কমান্ডার এবং অন্তত ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীর। এর পরই পাল্টা প্রত্যাঘাত হানে সাবেক পারস্য দেশ। ফলে দু’পক্ষে বেঁধেছে তুমুল ‘যুদ্ধ’। বিশ্লেষকদের দাবি, প্রাথমিক ভাবে এই লড়াইয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে অপরিশোধিত তেলের দরে।
০৩১৯
অয়েল প্রাইস ডট কমের দেওয়া পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৩ তারিখ ভোরে শিয়া মুলুকে ইহুদি-আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গেই বিশ্ব বাজারে ‘তরল সোনা’র দর বৃদ্ধি পায় ন’শতাংশ। এক দিনের মধ্যে প্রায় পাঁচ ডলার বেড়ে ব্রেন্ট ক্রুড অয়েলের দাম বর্তমানে প্রতি ব্যারেলে ৭৪ থেকে ৭৫ টাকার মধ্যে ঘোরাফেরা করছে। ওপেক বাক্সেটে এর দাম ৭০ থেকে ৭২ টাকা। ‘যুদ্ধে’র ভয়াবহতা তীব্র হলে ব্যারেল প্রতি অশোধিত তেলের দর ৯০ থেকে ৯৫ ডলার ছাড়াতে পারে বলেও ইতিমধ্যেই ইঙ্গিত মিলেছে।
০৪১৯
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির দাবি, দিনে ৩৩ লক্ষ ব্যারেল অপরিশোধিত তেল উত্তোলন করে ইরান। বিশ্বব্যাপী ‘তরল সোনা’ উৎপাদনের যা প্রায় তিন শতাংশ। এর মধ্যে দৈনিক ১৫ লক্ষ ব্যারেল তেল রফতানি করে থাকে তেহরান। শিয়া দেশটির এই খনিজ সম্পদের মূল ক্রেতা চিন এবং তুরস্ক। সাবেক পারস্য দেশ থেকে ৮০ শতাংশ অশোধিত তেল আমদানি করে বেজিং। ‘যুদ্ধে’র কারণে হঠাৎ করে ইরান খনিজ তেলের সরবরাহ বন্ধ করলে দুনিয়া যে জ্বালানি সঙ্কটের মুখে পড়বে তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
০৫১৯
পারস্য উপসাগরের কোলের দেশ ইরানের গা ঘেঁষে রয়েছে হরমুজ় প্রণালী। সমুদ্র বাণিজ্যের ক্ষেত্রে এটি একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা হিসাবে স্বীকৃত। এখান থেকে দিনে দু’কোটি ডলারের বেশি মূল্যের তেল সরবরাহ করে পশ্চিম এশিয়ার একাধিক আরব মুলুক। সেই তালিকায় একেবারে সামনে সারিতে রয়েছে সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহী। অতীতে এই ধরনের পরিস্থিতিতে বেশ কয়েক বার হরমুজ় প্রণালীকে সাময়িক ভাবে বন্ধ করে আন্তর্জাতিক চাপ তৈরির কৌশল নিতে দেখা গিয়েছে তেহরানকে।
০৬১৯
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতের জেরে ইতিমধ্যেই বিশ্ব জুড়ে ব্যাহত হয়েছে উড়ান পরিষেবা। কারণ, ইহুদি আক্রমণের ভয়ে দেশের আকাশসীমা (এয়ারস্পেস) বন্ধ করেছে তেহরান। শিয়া মুলুকটির পাশাপাশি একই পথে হেঁটেছে পড়শি দেশ ইরাক এবং জর্ডন। পরবর্তী নির্দেশ না-দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে ইজ়রায়েলের রাজধানী তেল আভিভের বেন গুরিয়ন বিমানবন্দরও। এর ফলে বিপাকে পড়েছে এয়ার ইন্ডিয়া-সহ আন্তর্জাতিক উড়ান পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত অধিকাংশ সংস্থা।
০৭১৯
ইরানের সীমান্তবর্তী পূর্ব ইরাক বিশ্বের অন্যতম ব্যস্ত ‘আকাশ বারান্দা’ (পড়ুন এয়ার করিডর)। প্রতি মুহূর্তে এই আকাশপথ ধরে পশ্চিমের কোনও রাষ্ট্র কিংবা ইউরোপে যায় এশিয়ার কোনও দেশের বিমান। আবার ফিরতি পথেও এই করিডর ব্যবহার করে এই বিমানগুলি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ এই রাস্তা অবরুদ্ধ হয়ে যাওয়ায় বিকল্প পথে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে বিমানগুলিকে। এর ফলে বাড়ছে জ্বালানির খরচও।
০৮১৯
এত দিন পর্যন্ত এয়ার ইন্ডিয়ার ইউরোপগামী বিমানগুলি পশ্চিম এশিয়ার ওই বহুল প্রচলিত এবং জনপ্রিয় করিডর ধরেই যাতায়াত করত। কিন্তু উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বিকল্প পথ ধরে তাদের উড়োজাহাজগুলিকে গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এই নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে টাটা গোষ্ঠীর উড়ান সংস্থা। সেখানে বলা হয়েছে, হঠাৎ করে আকাশপথ বন্ধ হওয়ায় সমস্যা বেড়েছে। বেশ কিছু বিমানকে মাঝপথ থেকে ফিরিয়েও আনতে হয়েছে। এখনও পর্যন্ত মোট ১৬টি বিমানের যাত্রাপথ এয়ার ইন্ডিয়া কর্তৃপক্ষ বদল করেছে বলে জানা গিয়েছে।
০৯১৯
বিমান পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলি জানিয়েছে, বিকল্প পথ হিসাবে এশিয়া থেকে ইউরোপের দিকে যাওয়া উড়োজাহাজগুলি মিশর এবং সৌদি আরব হয়ে গন্তব্যে পৌঁছোতে পারে। অথবা অশান্ত পশ্চিম এশিয়ার আকাশসীমা এড়িয়ে তুরস্ক, আজ়ারবাইজান এবং তুর্কমেনিস্তান হয়ে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছোনোর সুযোগ রয়েছে তাদের। তবে দু’টি ক্ষেত্রেই উড়ানের সময় এবং জ্বালানি খরচ দুটোই বাড়বে। ফলে এয়ার ইন্ডিয়ার মতো সংস্থার উপর বেড়েছে আর্থিক লোকসানের চাপ।
১০১৯
আগামী ১৫ জুন সম্ভাব্য পরমাণু চুক্তি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইরানের বৈঠকে বসার কথা ছিল। কিন্তু, ইজ়রায়েলি হামলার পর সেই প্রক্রিয়া বিশ বাঁও জলে চলে গিয়েছে। বিদেশ দফতরের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাইকে উদ্ধৃত করে শিয়া মুলুকটির সংবাদ সংস্থা তানসিম জানিয়েছে, আমেরিকা একপাক্ষিক আচরণ করছে, তাই আলোচনা অর্থহীন। ইরানের আণবিক হাতিয়ার তৈরি করা নিয়ে প্রবল আপত্তি রয়েছে ওয়াশিংটন এবং তেল আভিভের। অন্য দিকে সেই প্রক্রিয়া বন্ধ হবে না বলে স্পষ্ট করে দিয়েছে তেহরান।
১১১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে এই সংঘাত পশ্চিম এশিয়ার আরও একাধিক জায়গায় ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন করে ইজ়রায়লকে নিশানা করতে পারে ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী গাজার হামাস, লেবাননের হিজ়বুল্লা এবং ইয়েমেনের হুথির নামের সশস্ত্র গোষ্ঠী। অন্য দিকে আরব দুনিয়ার একাধিক দেশে আমেরিকার সামরিক ঘাঁটি রয়েছে। সেগুলিকেও এ বার নিশানা করা হবে বলে স্পষ্ট করেছে সাবেক পারস্য দেশের সেনাকর্তারা।
১২১৯
বিশেষজ্ঞেরা মনে করেন, হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে চুপ করে বসে থাকবে না সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং কাতারের মতো আরব দেশ। কারণ তাদের তেলের বাণিজ্য এই রাস্তার উপরে পুরোপুরি নির্ভরশীল। ইহুদি ও শিয়াদের লড়াইয়ে উপসাগরীয় দেশগুলির অর্থনীতির উপর বিপুল প্রভাব পড়তে পারে। এর থেকে বাঁচতে তাদের পা রণাঙ্গনে পড়লে যুদ্ধের ভয়াবহতা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, তা বলাই বাহুল্য।
১৩১৯
বর্তমানে ইরান থেকে খনিজ তেল কিনছে না ভারত। নয়াদিল্লির আমদানি করা ‘তরল সোনা’র ৩৬ শতাংশ আসে রাশিয়া থেকে। কারণ, ২০২২ সালে ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু করা ইস্তক ভারতকে সস্তা দরে অপরিশোধিত তেল বিক্রি করে চলেছে মস্কো। দ্বিতীয় এবং তৃতীয় স্থানে রয়েছে ইরাক এবং সৌদি আরব। এই দুই আরব মুলুক থেকে যথাক্রমে ২১ এবং ১৩ শতাংশ ‘তরল সোনা’ কিনছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। এ ছাড়া আমদানি করা তেলের ন’শতাংশ সংযুক্ত আরব আমিরশাহী থেকে পায় নয়াদিল্লি।
১৪১৯
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, ইজ়রায়েল-ইরান সংঘাত তীব্র হলে ভারতের পক্ষে কঠিন হবে পশ্চিম এশিয়ার তেল আমদানি। তবে তাতে ঘরোয়া বাজারে পেট্রল-ডিজেলের দর বৃদ্ধির সম্ভাবনা কম। কারণ, রাশিয়া থেকে সস্তা দরে ‘তরল সোনা’ কেনা আপাতত চালিয়ে যাবে নয়াদিল্লি। সে ক্ষেত্রে মস্কোর উপর বাড়বে মোদী সরকারের নির্ভরশীলতা। কেউ কেউ মনে করেন, ক্রেমলিনের পাশাপাশি আগামী দিনে যুক্তরাষ্ট্রের থেকে তেল আমদানি বৃদ্ধি করবে ভারত, যা এখন রয়েছে মাত্র তিন শতাংশ।
১৫১৯
তবে এই ‘যুদ্ধে’ ভারতের আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। পারস্য উপসাগর এবং হরমুজ প্রণালী বন্ধ হলে পশ্চিম এবং মধ্য এশিয়ায় পণ্য পরিবহণ করতে পারবে না নয়াদিল্লি। দ্বিতীয়ত, ইরান মদতপুষ্ট হুথিরা লোহিত সাগরের রাস্তা আটকে দিলে আরও ভয়াবহ আকার নেবে পরিস্থিতি। সে ক্ষেত্রে সুয়েজ খাল ব্যবহার করে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছোতেই পারবে না ভারতীয় জাহাজ। এর জেরে ইউরোপের বাজার হারানোর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
১৬১৯
তৃতীয়ত, পাকিস্তানকে এড়িয়ে মধ্য এশিয়ায় বাণিজ্যের জন্য দক্ষিণ ইরানের চাবাহার বন্দরটি তৈরি করেছে ভারত। বর্তমানে শিয়া মুলুকের বিভিন্ন এলাকাকে রেলপথের মাধ্যমে যুক্ত করার কাজ চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যের জন্যেও ৭,২০০ কিলোমিটার লম্বা ‘আন্তর্জাতিক উত্তর-দক্ষিণ পরিবহণ করিডর’ ব্যবহার করে নয়াদিল্লি। এই রাস্তা চাবাহার বন্দরের উপর দিয়ে গিয়েছে। ‘যুদ্ধে’র সময় একে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা নিশানা করলে জলে যাবে কেন্দ্রের বিপুল অঙ্কের বিনিয়োগ।
১৭১৯
১৩ জুনের ইহুদি হামলায় মৃত্যু হয় ইরানি আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসির কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেন সালামি, আইআরজিসির চিফ অফ স্টাফ মহম্মদ হোসেন বাগেরি, ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম আলি রশিদ এবং রেভলিউশনারি গার্ড অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান আমির আলি হাজিজ়াদের। এ ছাড়াও প্রাণ হারিয়েছেন শিয়া ফৌজের গুপ্তচর বাহিনীর উপপ্রধান গোলাম রাজা মেহরবি এবং ডেপুটি অফ অপারেশনস মেহেদি রব্বানির।
১৮১৯
সেনা অফিসারদের পাশাপাশি আইডিএফের আক্রমণে প্রাণ হারানো পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেউদুন আব্বাসি। তবে ইহুদি ফৌজের হানায় পরমাণুকেন্দ্রের কোনও ক্ষতি হয়নি বলে জানিয়ে দিয়েছে তেহরান। এর পরই ইজ়রায়েলকে পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে নিশানা করে শিয়া ফৌজ। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করেও সেগুলিকে পুরোপুরি আটকাতে পারেনি ইহুদি সেনা। রাজধানী তেল আভিভে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র আছড়ে পড়েছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
১৯১৯
ইরান এবং ইজ়রায়েল— পশ্চিম এশিয়ার দু’টি দেশের সঙ্গেই কৌশলগত ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে ভারতের। বর্তমান পরিস্থিতিতে রাশিয়া এবং চিনের প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে তেহরানের দিকে। আর আমেরিকা পুরোপুরি ঝুঁকে ইহুদি রাষ্ট্রটির উপর। এই পরিস্থিতিতে নিজেদের স্বার্থ বজায় রাখতে হলে, নয়াদিল্লিকে মেপে পা ফেলতে হবে, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা।