Israel executed Iran’s elite army commanders and nuclear scientists in Game of Thrones Red Wedding style dgtl
Israel Iran War
ইরানি কমান্ডার ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের ‘লাল বিয়ে’! শত্রু খতমে ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর ঝলক দেখাল ইহুদি গুপ্তচরেরা
১২ দিনের যুদ্ধে এক এক করে ইরানের বেশ কয়েক জন শীর্ষ সেনা অফিসার ও পরমাণু বিজ্ঞানীকে খতম করেছে ইজ়রায়েলি বায়ুসেনা। ইহুদিদের গুপ্তচরবাহিনী মোসাদের তৈরি করা সেই অপারেশনে দেখা গিয়েছে জনপ্রিয় মার্কিন টিভি সিরিজ ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর ঝলক, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৮ জুন ২০২৫ ১২:৩১
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২১
ফণা তোলার আগেই কালসাপের মাথায় বাড়ি! ১২ দিনের ইরান-ইজ়রায়েল যুদ্ধ থামার পর ইহুদি ফৌজের আক্রমণের ধরন কাঁটাছেড়া করতে বসে এ কথাই বার বার বলছেন দুনিয়ার তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। অনেকে আবার সাবেক পারস্য দেশে তাঁদের অপারেশনের সঙ্গে ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর তুলনা টেনেছেন। বলছেন, শিয়া মুলুককে জনপ্রিয় মার্কিন টিভি সিরিয়ালের চিত্রনাট্যে থাকা কুখ্যাত ‘লাল বিয়ে’র (পড়ুন রেড ওয়েডিং) স্বাদ চাখাতে পেরেছে তেল আভিভ।
০২২১
ইরানের পরমাণু বোমা তৈরির স্বপ্নকে চিরতরে শেষ করতে সেখানে ‘অপারেশন রাইজ়িং লায়ন’ চালায় ইহুদি বিমানবাহিনী। তাঁদের মুহুর্মুহু হামলায় মৃত্যু হয় শিয়া ফৌজের একগুচ্ছ শীর্ষ সেনা অফিসার এবং আণবিক বিজ্ঞানীর। যুদ্ধের মধ্যে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনীর মোসাদের এ-হেন ‘টার্গেট কিলিং’য়ের সঙ্গে ‘গেম অফ থ্রোন্স’-এর পরতে পরতে মিল খুঁজে পেয়েছেন প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। সংঘাত থামায় ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে তাঁদের আক্রমণের নীলনকশা।
০৩২১
এই যুদ্ধের মধ্যে সাবেক পারস্য দেশের রাজধানী তেহরানে ইজ়রায়েলি হামলায় বাড়িতে প্রাণ হারান অন্তত ন’জন পরমাণু বিজ্ঞানী। মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, লড়াই চলাকালীন ‘অপারেশন নার্নিয়া’ নামে একটি পৃথক অভিযান চালাচ্ছিল মোসাদ। এর মাধ্যমে বেছে বেছে আণবিক গবেষকদের নিকেশ করে ইহুদিরা। ফলে শিয়া মুলুকটির পরমাণু কর্মসূচিতে যে বড় ধাক্কা লেগেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
০৪২১
‘অপারেশন নার্নিয়া’র বিষয় নিয়ে ইতিমধ্যেই ‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’-এর কাছে মুখ খুলেছেন ‘ইজ়রায়েল ডিফেন্স ফোর্স’ বা আইডিএফের ডিজিএমও (ডিরেক্টর জেনারেল অফ মিলিটারি অপারেশন্স) মেজর জেনারেল ওদেদ বাসিয়ুক। এই অভিযান পরিচালনার দায়িত্ব তাঁর কাঁধে তুলে দেন ইহুদি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু। বাসিয়ুকের বলেছেন, ‘‘আমরা যখন অভিযানের বিস্তারিত পরিকল্পনা করছিলাম, তখন সফলতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ ছিল।’’
০৫২১
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘অপারেশন নার্নিয়া’র ভিত রাতারাতি তৈরি হয়নি। ১৯৯০-এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে গোপনে চলা ইরানের পরমাণু কর্মসূচির হাঁড়ির খবর জোগাড়ে কোমর বেঁধে লেগে পড়ে ইহুদি গুপ্তচরবাহিনী মোসাদ। ধীরে ধীরে তেহরানের গভীরে নিজস্ব নেটওয়ার্কের জাল বিস্তার করতে সক্ষম হয় তারা। এর উপরে ভিত্তি করেই সংশ্লিষ্ট অভিযান চালিয়েছে তেল আভিভ।
০৬২১
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজ়রায়েলের উপর মারাত্মক হামলা চালায় ইরান মদতপুষ্ট প্যালেস্টাইনপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাস। ইহুদিভূমিতে ঢুকে নির্বিচারে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে তাঁরা। পাশাপাশি অপহরণ করে পণবন্দি বানায় আরও কয়েক জনকে। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দেন নেতানিয়াহু। তত দিনে সেখানে শিকড় মজবুত করে ফেলেছেন মোসাদের এজেন্টরা।
০৭২১
সূত্রের খবর, হামাসের আক্রমণের পর ‘অপারেশন নার্নিয়া’র বাস্তবায়নে মরিয়া হয়ে ওঠে ইজ়রায়েলি গুপ্তচরবাহিনী। কারণ, এজেন্টদের থেকে তাঁরা নিয়মিত ইরানি ফৌজের শীর্ষ কমান্ডার এবং পরমাণু বিজ্ঞানীদের একাংশের ‘রিয়্যাল টাইম’ তথ্য পাচ্ছিলেন। অর্থাৎ, কোন সেনা অফিসার কখন কোথায় থাকছেন, কী করছেন বা কোথায় যাচ্ছেন— সেই সংক্রান্ত সমস্ত খবর আসছিল মোসাদের দফতরে।
০৮২১
২০২৩ সালের নভেম্বরে ‘অপারেশন নার্নিয়া’ নিয়ে ইজ়রায়েলি বিমানবাহিনীর সঙ্গে চূড়ান্ত আলোচনা সারে মোসাদ। সেই বৈঠকে হাজির ছিলেন ১২০ জন। ইরানের মধ্যে মোট ২৫০টি লক্ষ্যবস্তুকে নিশানা করতে একটি ‘হিটলিস্ট’ তৈরি করে ফেলেন তাঁরা। তালিকায় তেহরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র, সামরিক ঘাঁটির পাশাপাশি ছিলেন ফৌজি কমান্ডার এবং আণবিক বিজ্ঞানীরা।
০৯২১
চলতি বছরের ৯ জুন মোসাদের এই পরিকল্পনায় সবুজ সঙ্কেত দেন প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু। প্ল্যানমাফিক, বড় ছেলের বিয়ের জন্য ছুটি নিচ্ছেন বলে জনসমক্ষে ঘোষণা করেন তিনি। ফলে আক্রমণের কোনও সম্ভাবনাই নেই বলে মনে করেছিল ইরান। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে অতর্কিতে তেহরানে হানা দেয় ইহুদি বিমানবাহিনী।
১০২১
সাবেক পারস্য দেশের গোয়েন্দাদের চোখে ধুলো দিতে আরও একটা চাল দিয়েছিল মোসাদ। প্রাথমিক ভাবে ইরানের উপর ইজ়রায়েল আক্রমণ শানাক তা কখনওই চাননি মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এই নিয়ে নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেন তিনি। সূত্রের খবর, সেখানে দু’জনেরই সুর ছিল চড়া। ট্রাম্প-নেতানিয়াহুর কথোপকথনের সেই টেপ ফাঁস করে ইহুদি গুপ্তচরেরা। ফলে হামলা হবে না বলে একরকম নিশ্চিত ছিল তেহরান।
১১২১
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশের দাবি, মোসাদের পাতা ফাঁদে পা দেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পও। ইহুদি লড়াকু জেট ইরানের আকাশে ঢোকার কয়েক ঘণ্টা আগে নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লেখেন, ‘‘আমরা তেহরানের পরমাণু সমস্যার কূটনৈতিক সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’’ ফলে নেতানিয়াহুর ‘আগ্রাসী’ মনোভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সায় নেই বলে ইরানের মনে বদ্ধমূল ধারণা তৈরি হয়েছিল।
১২২১
অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের জেরে পরমাণু বিজ্ঞানীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির দিকে নজরই দেয়নি তেহরান। ফলে ‘অপারেশন নার্নিয়া’য় সাফল্যের রাস্তা খুলে যায় ইজ়রায়েলের সামনে। এই অভিযানে নামার সময় ইরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা বা এয়ার ডিফেন্সও গুঁড়িয়ে দেয় মোসাদ। এর জন্য সাবেক পারস্য দেশের ভিতরে ঢুকে ড্রোন হামলা চালায় তাঁরা।
১৩২১
এই সংক্রান্ত তদন্তমূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে বর্তমান এবং প্রাক্তন মিলিয়ে অন্তত ১০ জন ইজ়রায়েলি গোয়েন্দা এবং উচ্চপদস্থ সেনাকর্তার সঙ্গে কথা বলেন মার্কিন সংবাদ সংস্থা ‘অ্যাসোসিয়েট প্রেস’ বা এপি। তাদের দাবি, শিয়া শত্রু দেশে নিযুক্ত এজেন্টদের কাঁধে তেহরানের ‘আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ ধ্বংসের গুরুদায়িত্ব দেয় মোসাদ।
১৪২১
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইহুদি গোয়েন্দা এবং ফৌজের পদস্থ কর্তাদের উদ্ধৃত করে এপি লিখেছে, রাজধানী তেহরানের ভিতরে একটি ড্রোন ঘাঁটি তৈরি করে ‘মোসাদ’। সেখান থেকেই সংশ্লিষ্ট এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমগুলিতে হামলা চালানো হয়। এর জন্য অন্তত তিন বছর ধরে পরিকল্পনা করেন ইজ়রায়েলি গুপ্তচর সংস্থার শীর্ষকর্তারা।
১৫২১
‘ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল’ আবার জানিয়েছে, এই অভিযানে ‘কোয়াডকপ্টার’ নামের একটি বিশেষ ধরনের ড্রোন ব্যবহার করেন তাঁরা। স্যুটকেস, ট্রাক এবং মালবাহী জাহাজের কন্টেনারে করে সেগুলিকে তেহরানের ভিতরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া ড্রোন উৎক্ষেপণের লঞ্চার এবং বিস্ফোরকও সাবেক পারস্য দেশে পাচার করে ইজ়রায়েল।
১৬২১
সূত্রের খবর, মানববিহীন উড়ুক্কু যানগুলিকে আরও বেশি ঘাতক করে তুলতে কৃত্রিম মেধা বা এআই (আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্স) প্রযুক্তিকে কাজে লাগান ইহুদি প্রতিরক্ষা গবেষকেরা। এর জেরে স্বতন্ত্র ভাবে নিজেদের লক্ষ্য খুঁজে নিতে পেরেছিল হামলাকারী ‘কোয়াডকপ্টার’ ড্রোনের ঝাঁক। উক্ত অপারেশনে গুপ্তচর কৃত্রিম উপগ্রহের সাহায্যও মোসাদ নিয়েছিল বলে জানা গিয়েছে।
১৭২১
গত ১৩ জুন ইরানের একাধিক পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিতে হামলা চালায় ইহুদি বায়ুসেনা। মোসাদের তৈরি তালিকা অনুযায়ী চলা ওই অতর্কিত আক্রমণে ওই দিনই প্রাণ হারান তেহরানের আধা সেনা আইআরজিসির (ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর) প্রধান তথা চিফ অফ স্টাফ মহম্মদ হোসেন বাগেরি এবং কমান্ডার-ইন-চিফ হোসেন সালামি। দু’জনেই ছিলেন মেজর জেনারেল পদমর্যাদার অফিসার।
১৮২১
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, শিয়া ধর্মগুরু তথা ইরানের সর্বোচ্চ নেতা (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ রয়েছে এই আইআরজিসি। ইজ়রায়েল সেখানে আক্রমণ করায় কিছুটা দিশেহারা হয়ে পড়ে তেহরান। দুই শীর্ষ অফিসারের মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই জানা যায় আইআরজিসির ডেপুটি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল গোলাম আলি রশিদ ও রেভলিউশনারি গার্ড অ্যারোস্পেস ফোর্সের প্রধান মেজর জেনারেল আমির আলি হাজিজ়াকে নিকেশ করেছে ইহুদিরা।
১৯২১
বাগেরির মৃত্যুর পর গত ১৪ জুন তাঁর জায়গায় আলি শাদমানিকে নিয়োগ করেন আলি খামেনেই। ব্রিগেডিয়ার জেনারেল থেকে মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন তিনি। আইআরজিসির মূল সদর দফতর ‘খতম আল-আম্বিয়া’র দায়িত্ব দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু, ঠিক তিন দিনের মাথায় (পড়ুন ১৭ জুন) রাতের অন্ধকারে ওই ভবনেই আক্রমণ শানায় ইহুদি বায়ু সেনা। আর তাতে প্রাণ হারান নবনিযুক্ত সেনাপ্রধান শাদমানির। যদিও তাঁর মৃত্যু নিয়ে কোনও বিবৃতি দেয়নি তেহরান।
২০২১
এ ছাড়াও প্রাণ হারিয়েছেন শিয়া ফৌজের গুপ্তচর বাহিনীর উপপ্রধান গোলাম রাজা মেহরবি এবং ডেপুটি অফ অপারেশন্স মেহেদি রব্বানির। ১৫ জুন ইরানি সশস্ত্র বাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান মহম্মদ কাজ়েমিকে উড়িয়ে দেয় ইজ়রায়েল। ফলে বাধ্য হয়ে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মাজিদ খাদেমিকে নতুন গোয়েন্দাপ্রধান নিযুক্ত করে তেহরান।
২১২১
২১ জুন খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণে থাকা বাহিনীর আরও দুই কমান্ডারের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করে ইজ়রায়েল। তাঁদের নাম সইদ ইজ়াদি এবং বেনহ্যাম শরিয়ারি। এ ছাড়া ইহুদি বিমান হামলায় নিহত পরমাণু বিজ্ঞানীদের মধ্যে রয়েছে ইরানের আণবিক শক্তি সংস্থার প্রাক্তন প্রধান ফেরেউদুন আব্বাসি। পরমাণু গবেষক সইদ ইসার তাবাতাবায়েইর বাড়িতেও বোমাবর্ষণ করে তারা। সঙ্গে সঙ্গে গোটা বাড়িটি গুঁড়িয়ে যাওয়ায় মৃত্যু হয় তাঁর। হামলায় প্রাণ হারান তাঁর স্ত্রীও।