Navy Ship of Turkey TCG BUYUKADA arrives at Karachi Port amid tensions Between India and Pakistan dgtl
Turkish naval ship
ভারতের সঙ্গে এঁটে উঠতে ভরসা ‘ভাই’য়ের রণতরী! রুগ্ন পাক নৌবহরকে চাঙ্গা করতে আসরে ‘রুগ্ন মানুষ’
পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে তুরস্কের নৌবাহিনীর রণতরী এমন এক সময়ে এসেছে যখন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলার পর সেই উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৬ মে ২০২৫ ১৩:১৯
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২৪
পহেলগাঁও কাণ্ডের আবহে তীব্র হচ্ছে ভারত-পাক সংঘাত। এ-ও স্পষ্ট যে, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে খানিকটা হলেও আতঙ্কে রয়েছে পাকিস্তান। তবে পাকিস্তানের সেই আতঙ্ক কাটিয়ে মনে সাহস জোগাতে ‘ভাই’ হয়ে পাশে দাঁড়াল তুরস্ক।
০২২৪
চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল দক্ষিণ পাকিস্তানের করাচি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে তুরস্কের সি-১৩০ই হারকিউলিস মালবাহী বিমান অবতরণ করতেই দুনিয়া জুড়ে হইচই শুরু হয়। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, ওই বিমানে বিপুল পরিমাণ হাতিয়ার, গোলাবারুদ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠিয়েছে আঙ্কারা। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে ছিল ইসলামাবাদ।
০৩২৪
তবে তুরস্কের শক্তিতে পাকিস্তান যে ভর করছে তার প্রমাণ এ বার মিলল। রবিবার পাকিস্তানের করাচি বন্দরে পৌঁছোনোর পর তুর্কি নৌবাহিনীর যুদ্ধজাহাজ ‘টিসিজি বুয়ুকাদা’কে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়েছেন পাক নৌবাহিনীর কর্তারা।
০৪২৪
যদিও পাকিস্তানের যুক্তি অন্য। রবিবার পাক জনসংযোগ অধিদফতরের তরফে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, রণতরীটি শুভেচ্ছা সফরে এসেছে মাত্র। জাহাজটি পাকিস্তানে থাকার সময় তুর্কি জাহাজের সদস্যেরা পাকিস্তান নৌবাহিনীর কর্মীদের সঙ্গে ‘পেশাদারি আলাপচারিতা’য় যোগ দেবে।
০৫২৪
সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়েছে, এই সফরের লক্ষ্য হল পারস্পরিক বোঝাপড়া বৃদ্ধি করা এবং দুই নৌবাহিনীর মধ্যে সামুদ্রিক সহযোগিতা জোরদার করা। এটি পাকিস্তান ও তুরস্কের মধ্যে ক্রমবর্ধমান সামুদ্রিক সহযোগিতার প্রমাণ বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। সরকারি বিবৃতিতে এ-ও বলা হয়েছে, ‘টিসিজি বুয়ুকাদা’র করাচি বন্দরে আসা দুই ‘ভ্রাতৃপ্রতিম’ দেশের মধ্যে গভীর পারস্পরিক বিশ্বাস এবং কৌশলগত অংশীদারির প্রতিফলন ঘটায়, যা শতাব্দীপ্রাচীন ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত।
০৬২৪
তবে পাকিস্তানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বন্দরে তুরস্কের নৌবাহিনীর রণতরী এমন একসময়ে এসেছে যখন ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে জঙ্গিদের গুলিতে ২৬ জনের মৃত্যুর পর সেই উত্তেজনা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
০৭২৪
পহেলগাঁওয়ে হামলার ঘটনায় আঙুল উঠেছে পাকিস্তানের দিকে। হামলার প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সিন্ধু জলচুক্তি স্থগিত করা থেকে শুরু করে অটারী সীমান্ত বন্ধ করা-সহ বেশ কয়েকটি কড়া পদক্ষেপ করেছে ভারত। হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছে।
০৮২৪
সেই পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব বাঁচাতে এ বার ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের’ তাস খেলছে ইসলামাবাদ। এবং তাতে অবশ্য সাফল্যও পেয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। অন্তত তেমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। যুদ্ধের জিগির তোলা রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা তুরস্কের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়েছে।
০৯২৪
২৮ এপ্রিল করাচিতে অবতরণ করে তুরস্কের মালবাহী বিমান। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ছড়িয়ে পড়া খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানে মোট ছ’টি সি-১৩০ই হারকিউলিস বিমান নামিয়েছিল তুর্কি বায়ুসেনা। আরব সাগরের উপর দিয়ে সেগুলিকে উড়িয়ে আনা হয়। তা ছাড়া করাচি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নাকি সেগুলি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েছিল। এর পর আবার তুর্কি রণতরী করাচি বন্দরে এসে নোঙর করার পর চিন্তা বেড়েছে নয়াদিল্লির।
১০২৪
ঐতিহাসিক ভাবে অবশ্য ইসলামাবাদ এবং আঙ্কারার সম্পর্ক বেশ মধুর। বিশ্লেষকদের একাংশ তাই মনে করেন, যুদ্ধ বাধলে তুরস্কের ‘অন্ধ’ সমর্থন পাবে পাকিস্তান। ফলে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আগাম সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। উঠেছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’টির উপর কূটনৈতিক বাণ চালানোর দাবিও।
১১২৪
বিষয়টি নিয়ে আগেই মুখ খুলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক তথা অবজ়ারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সারিন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সাপকে খাওয়াই, তার পর ভাবি কেন সেটা আমাদের কামড়াল। আমরা শত্রুদের পুরস্কার দিই আর বন্ধুদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলি। তুরস্ক ‘বন্ধু’ হবে বলে মিথ্যা স্বপ্ন দেখছে মোদী সরকার। উল্টে আমাদের পিঠে ছুরি বসানোর জন্য তাতে শান দিচ্ছে ওরা।’’
১২২৪
সারিনের যুক্তি যে একেবারই ফেলে দেওয়ার নয়, তা মানছেন দেশের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। আর তাই অবিলম্বে তুরস্কের ইস্তানবুল হয়ে ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত অসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করার দাবি তুলেছেন তাঁরা। বর্তমানে উড়ান সংস্থা ইন্ডিগোকে এই অনুমতি দিয়েছে নয়াদিল্লি। ফলে টার্কিশ এয়ারলাইন্স অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে।
১৩২৪
বছর কয়েক আগে পাক ফৌজকে অতিশক্তিশালী বের্যাক্টার টিবি২ এবং আকিনসি নামের দু’টি ড্রোন সরবরাহ করে তুরস্ক। এর মধ্যে প্রথমটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল নয়াদিল্লি। পাশাপাশি, ইসলামাবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘কান’ নামের পঞ্চম প্রজন্মের একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করছে তুরস্ক। গত বছর দুই দেশের মধ্যে এই সংক্রান্ত একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। আগামী বছরের মধ্যে ‘কান’ লড়াকু জেটকে বিমানবাহিনীর বহরে শামিল করার পরিকল্পনা রয়েছে আঙ্কারার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি হাতে পাবে পাক বায়ুসেনা।
১৪২৪
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক। চোখের নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই সময় বিবাদ ভুলে আঙ্কারার পাশে দাঁড়িয়েছিল নয়াদিল্লি। এশিয়া মাইনরের দেশটিতে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী পাঠায় নয়াদিল্লি। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকাজে নামে ভারতীয় সেনা, বিমানবাহিনী এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা এনডিআরএফ।
১৫২৪
কিন্তু বিশ্লেষকদের দাবি, বিপদের সময়ে করা এই সাহায্যের প্রতিদান যে তুরস্ক পরবর্তী সময়ে দিয়েছে, তা নয়। গত দু’বছরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যুতে সামান্য নরম বিবৃতি বা চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করেনি এর্ডোগান প্রশাসন। উল্টে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার দিকেও এগিয়েছে আঙ্কারা। হামলাকারী ড্রোন সরবরাহ বা ‘কান’ যুদ্ধবিমান প্রকল্পে ইসলামাবাদের অন্তর্ভুক্তি তার প্রমাণ।
১৬২৪
তবে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের আবহে পাকিস্তান যে সমস্ত ইসলামীয় দেশগুলির সমর্থন পেয়েছে, এমনটা নয়। কারণ, ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় সংহতির বার্তা দেওয়ার চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে গোটা আরব মুলুক। পহেলগাঁও হামলার জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে নারাজ সমস্ত উপসাগরীয় দেশ।
১৭২৪
ইসলামীয় দেশগুলির মধ্যে আজ়ারবাইজানের সমর্থন অবশ্য পাবে ইসলামাবাদ। একটা সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল মধ্য এশিয়ার এই দেশ। প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজ়ারবাইজানের সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। গত কয়েক বছরে ভারতের থেকে বেশ কয়েকটি হাতিয়ার কিনেছে আর্মেনিয়া। তার পর থেকে পাকিস্তানকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করছে আজ়ারবাইজান।
১৮২৪
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় পর্যটক-সহ প্রাণ হারান ২৬ জন। সেই ঘটনার বদলা নিতে স্থল-জল এবং বিমানবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার পর থেকেই সুর চড়াতে থাকে ইসলামাবাদ। ভারতে পরমাণু হামলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন পাকিস্তানের নেতা-মন্ত্রীরা।
১৯২৪
এ-হেন পরিস্থিতিতে করাচিতে তুরস্কের মালবাহী বিমানের অবতরণ এবং ‘টিসিজি বুয়ুকাদা’ রণতরী নোঙর করা নিয়ে তীব্র হয়েছে নতুন জল্পনা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আঙ্কারা এবং আজ়ারবাইজানকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিশক্তি জোট গড়ে তোলার চেষ্টায় রয়েছে ইসলামাবাদ। অন্য দিকে পাকিস্তানে কোনও হাতিয়ার বা গোলাবারুদ পাঠানো হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
২০২৪
নয়াদিল্লির সঙ্গে তারা যে একা এঁটে উঠতে পারবে না, তা ভাল করেই জানে ইসলামাবাদ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে সৈন্যশক্তির দিক থেকে কোন দেশ কতটা শক্তিশালী, সেই সংক্রান্ত একটি তালিকা প্রকাশ করে ‘গ্লোবাল ফায়ারপাওয়ার ইনডেক্স’। মোট ১৪৫টি দেশের মধ্যে সেখানে ভারতকে চতুর্থ স্থানে রেখেছে এই সমীক্ষক সংস্থা। গত বছরের নিরিখে নয়াদিল্লি নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারলেও অবনমন হয়েছে পাকিস্তানের। তালিকায় ১২ নম্বর স্থানে জায়গা পেয়েছে ইসলামাবাদ।
২১২৪
‘গ্লোবার ফায়ারপাওয়ার’ জানিয়েছে, ভারতীয় নৌসেনার রয়েছে মোট ২৯৩টি রণতরী। এর মধ্যে বিমানবাহী যুদ্ধপোতের সংখ্যা দুই। এই ধরনের আরও একটি রণতরী তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে নয়াদিল্লির। ১৩টি ডেস্ট্রয়ার, ১৪টি ফ্রিগেট এবং ১৮টি করভেট ব্যবহার করেন এ দেশের জলযোদ্ধারা।
২২২৪
ভারতীয় নৌসেনায় মোট ডুবোজাহাজের সংখ্যা ১৮। এর মধ্যে তিনটি পরমাণু শক্তিচালিত এবং পরমাণু হাতিয়ারে সজ্জিত ডুবোজাহাজ। পাক নৌবাহিনীর হাতে থাকা মোট রণতরীর সংখ্যা ১২১। ইসলামাবাদের কোনও বিমানবাহী রণতরী ও ডেস্ট্রয়ার নেই। মাত্র ৮টি ডুবোজাহাজ এবং ৯টি করে ফ্রিগেট ও করভেট ব্যবহার করে তারা। এর মধ্যে একটি ডুবোজাহাজও পরমাণু অস্ত্রে সজ্জিত নয়।
২৩২৪
বর্তমানে ‘নিউক্লিয়ার ট্রায়েড’ভুক্ত দেশগুলির মধ্যে স্থান পেয়েছে ভারত। অর্থাৎ, জল, স্থল এবং আকাশ— তিন জায়গা থেকে পরমাণু হামলার ক্ষমতা রয়েছে নয়াদিল্লির। এমনকি সমুদ্রের গভীরে থেকেও আইএনএস অরিহান্ত এবং আইএনএস অরিঘাটের মতো ডুবোজাহাজ থেকে আণবিক আক্রমণ চালাতে পারে ভারতের নৌসেনা। এই ক্ষমতা পাকিস্তানের নেই।
২৪২৪
পহেলগাঁও ঘটনার পর থেকেই বদলার আগুনে ফুঁসছে গোটা দেশ। এ ব্যাপারে প্রত্যাঘাত শানাতে ফৌজের তিন শাখাকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদী। বাহিনী সবুজ সঙ্কেত পেতেই যুদ্ধের আতঙ্কে কাঁপছে পাকিস্তান। সাহায্যের হাত পাতছে ভাইদের কাছে।