ইরানে মার্কিন কৌশলগত বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’-এর বোমাবর্ষণের পর পাকিস্তানের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরের ভূমিকা ঘিরে উঠেছে প্রশ্ন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে তেহরানের পিঠে ছুরি বসিয়েছেন তিনি?
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ২৩ জুন ২০২৫ ১০:৪৬
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
পশ্চিম এশিয়ার রণাঙ্গনে মার্কিন বায়ুসেনার সিংহ গর্জন! ইজ়রায়েলের পক্ষ নিয়ে ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করেছে ‘বি-২ স্পিরিট’ নামের যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত বোমারু বিমান। কিন্তু সাবেক পারস্য দেশের সঙ্গে যুদ্ধে কি পাকিস্তানকেও জড়িয়ে নিলেন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প? ইসলামাবাদের সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল আসিম মুনিরকে ‘বোকা বানিয়ে’ দিব্যি ব্যবহার করেছেন তিনি? লড়াইয়ের গোড়াতেই এই সমস্ত প্রশ্নে সরগরম গোটা দুনিয়া।
০২২০
চলতি বছরের ১৮ জুন যুক্তরাষ্ট্রের রাজধানী ওয়াশিংটনের ঐতিহ্যশালী ‘শ্বেত প্রাসাদ’-এ (পড়ুন হোয়াইট হাউস) প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজ সারেন পাক সেনাপ্রধান মুনির। এর পর বেশ কিছুক্ষণ ধরে চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। এই প্রসঙ্গে বিবৃতি দিতে গিয়ে রাওয়ালপিন্ডির সেনা সদর দফতর জানিয়ে দেয় যে, আলোচনায় স্বাভাবিক ভাবেই উঠেছিল ইরান প্রসঙ্গ। সেখানে সংঘাত কম করার পক্ষে সওয়াল করেছেন মুনির।
০৩২০
ট্রাম্প-মুনির বৈঠকের আগেই তেহরানের সঙ্গে যুদ্ধের বিউগল বাজিয়ে দেয় ইজ়রায়েল। গত ১৩ জুন ইরানের পরমাণুকেন্দ্র এবং সামরিক ঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে ইহুদি বায়ুসেনা। তেল আভিভের ওই পদক্ষেপের কড়া সমালোচক ছিল পাকিস্তান। শুধু তা-ই নয়, প্রতিবেশী শিয়া মুলুকটির পাশে ইসলামাবাদ যে রয়েছে, তা-ও স্পষ্ট করে দেন মুনির। এ ক্ষেত্রে ‘ইসলামীয় ভ্রাতৃত্ববোধ’-এর কথা বলতে শোনা যায় রাওয়ালপিন্ডির ‘সিপাহসালার’-এর গলায়।
০৪২০
বৈঠক শেষে স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতেই তাৎপর্যপূর্ণ মন্তব্য করেন ট্রাম্প। বলেন, ‘‘ইরানে ইজ়রায়েলি হামলা নিয়ে পাকিস্তান মোটেই খুশি নয়।’’ অন্য দিকে, মধ্যাহ্নভোজের অনুষ্ঠানের পর মার্কিন প্রেসিডেন্টের নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করে ইসলামাবাদ। ওই ঘটনায় দু’দিনের মাথায় যুক্তরাষ্ট্রের বোমারু বিমান সাবেক পারস্য দেশের আকাশে দাপিয়ে বেড়ানোয় রাওয়ালপিন্ডির ফিল্ড মার্শালের ভূমিকা নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে।
০৫২০
পশ্চিমি গণমাধ্যমগুলির একাংশের দাবি, বোমাবর্ষণের আগে ইরান সীমান্তবর্তী দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তানের বালোচিস্তানের আকাশে মার্কিন কৌশলগত বোমারু বিমান ‘বি-২ স্পিরিট’কে উড়তে দেখা গিয়েছে। এই ‘রেকি অপারেশন’-এর মাধ্যমে লক্ষ্য নিশ্চিত করে নেয় তারা। যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবাহিনীর জন্য দেশের আকাশসীমা যে মুনিরই খুলে দিয়েছেন, তা বলাই বাহুল্য। যদিও এ ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।
০৬২০
ইরান-ইজ়রায়েল সংঘাতে আমেরিকার মেগা এন্ট্রিতে পাক ফৌজের ভূমিকা নিয়ে প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের মধ্যে দু’ধরনের মতামত রয়েছে। এক দলের দাবি, মুনিরকে পুরোপুরি বোকা বানিয়ে তাঁকে ব্যবহার করেছেন ট্রাম্প। তাঁর নাম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করায়, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কোনও অবস্থাতেই যুদ্ধে জড়াবেন না বলে নিশ্চিত ছিল ইসলামাবাদ। সেই কারণে বালোচিস্তানের আকাশে মার্কিন যুদ্ধবিমানের প্রবেশে কোনও বাধা দেননি রাওয়ালপিন্ডির ‘সিপাহসালার’।
০৭২০
কিন্তু, এই যুক্তি মানতে নারাজ বিশ্লেষকদের অপর অংশ। তাঁদের দাবি, ইরানে মার্কিন বিমানবাহিনী যে হামলা করতে চলেছে, মধ্যাহ্নভোজের অনুষ্ঠানেই তার ইঙ্গিত পেয়ে যান মুনির। ফলে জেনেই ‘ইসলামিক ভাই’ তেহরানের পিঠে ছুরি বসিয়েছেন তিনি। এই বিশ্বাসঘাতকতায় পাক রাজনৈতিক নেতৃত্বকে পাশে পেয়েছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজ জেনারেল। বিনিময়ে মোটা টাকায় মুনিরের পকেট অবশ্য ভরিয়ে দিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
০৮২০
সূত্রের খবর, আগামী দিনে পাকিস্তানে ক্রিপ্টো মুদ্রায় ব্যবসা শুরু করবেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। ইতিমধ্যেই কোমর বেঁধে সেই প্রস্তুতিতে লেগে পড়েছে তাঁর সংস্থা। ইসলামাবাদের ক্রিপ্টো ব্যবসায় ৩৪ হাজার কোটি ডলার লগ্নির পরিকল্পনা রয়েছে এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতার। সংশ্লিষ্ট ব্যবসা দেখভালের দায়িত্ব ট্রাম্প মুনিরের উপর দিতে চান বলে জানা গিয়েছে। ফলে বিশ্লেষকদের অনেকেই দু’য়ে দু’য়ে চার করেছেন।
০৯২০
সম্প্রতি এই ইস্যুতে মুখ খুলেছেন ভারতীয় বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসার অজয় অহলাওয়াত। সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) তিনি লেখেন, ‘‘ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পাকিস্তানের সামরিক ঘাঁটিগুলি আমেরিকার খুবই প্রয়োজন। সেই কারণে মুনিরকে মধ্যাহ্নভোজে আমন্ত্রণ করেন ট্রাম্প।’’ একে ওয়াশিংটনের পশ্চিম এশিয়া নীতির বৃহত্তর কৌশলের অংশ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
১০২০
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, ইরানে ইহুদি বায়ুসেনার আক্রমণ শুরু হলে জোরালো ভাষায় তার নিন্দা করে ইসলামাবাদ। এই নিয়ে পাক পার্লামেন্ট ‘ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি’তে ভাষণ দিতে গিয়ে বর্ষীয়ান সাংসদ আসাদ কায়সার বলেন, ‘‘তেহরানের মতো আগামী দিনে আমাদেরও নিশানা করতে পারে ইজ়রায়েল। আর তাই দেশের আমজনতা থেকে শুরু করে সরকার, যতটা সম্ভব সবটুকু নিয়ে ওদের পাশে দাঁড়াতে হবে।’’ একই সুর শোনা গিয়েছে পাক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খোয়াজা আসিফ এবং বিদেশমন্ত্রী ইশাক দারের গলাতেও।
১১২০
কিন্তু, বাস্তবে ইরানের পাশে দাঁড়ানোর বদলে উল্টো আচরণ করেছে ইসলামাবাদ। সাবেক পারস্য দেশটি যুদ্ধে জড়াতেই সীমান্ত বন্ধ করার নির্দেশ দেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। তেহরান অবশ্য তার পরেও পূর্বের প্রতিবেশী দেশটিকে ভরসা করে চলেছে। কারণ, মার্কিন বিমানবাহিনীর হামলার পর বিবৃতি দিয়ে তার নিন্দা করেছে পাকিস্তান।
১২২০
গত ২২ জুন ইরানের তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে বোমাবর্ষণ করে মার্কিন বায়ুসেনার ‘বি-২ স্পিরিট’। সূত্রের খবর, মোট ৩০ হাজার পাউন্ডের বোমায় ফোর্ডো, নাতান্জ় এবং ইসফাহান আণবিক কেন্দ্রগুলিকে নিশানা করে যুক্তরাষ্ট্র। এগুলিকে ওড়াতে ব্যবহার করা হয় ৩০টি ‘টোমাহক’ ক্ষেপণাস্ত্র। পরমাণুকেন্দ্রগুলি ভূগর্ভস্থ হওয়ায় ‘জিবিইউ-৫৭’ সিরিজ়ের ‘বাঙ্কার বাস্টার’ বোমা সেখানে ফেলা হয়েছে বলে জানা গিয়েছে।
১৩২০
ইরানে এই হামলাকে অত্যন্ত সফল বলে জানিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। নিজের সমাজমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম ‘ট্রুথ সোশ্যাল’-এ তিনি লিখেছেন, ‘‘তেহরানের কাছে আর কোনও বোমা নেই।’’ অন্য দিকে পাল্টা প্রত্যাঘাতের হুঁশিয়ারি দিয়েছে পারস্য উপসাগরের তীরের ওই শিয়া মুলুক। সেখানকার ধর্মগুরু তথা ‘সর্বোচ্চ নেতা’ (পড়ুন সুপ্রিম লিডার) আয়াতোল্লা আলি খামেনেইয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন আধা সেনা ‘ইসলামিক রেভলিউশনারি গার্ড কোর’ বা আইআরজিসি একটি বিবৃতিতে জানিয়েছে, আমেরিকার পালানোর পথ নেই।
১৪২০
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, প্রত্যাঘাতের নামে ইরানি সেনা যদি পশ্চিম এশিয়ার মার্কিন সেনাঘাঁটিগুলিকে নিশানা করে, তবে আরব দুনিয়ায় যুদ্ধ ছড়িয়ে যাওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। ২০২০ সালে ইরাকের রাজধানী বাগদাদে ড্রোন হামলা চালিয়ে আইআরজিসির শীর্ষ কমান্ডার কাসেম সুলেমানিকে নিকেশ করে আমেরিকা। ঠিক তার পরেই প্রতিশোধ নিতে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা ছাউনিতে ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছিল তেহরান।
১৫২০
দ্বিতীয়ত, তিনটি পরমাণুকেন্দ্রে মার্কিন হামলার পর পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী বন্ধ করার দিকে এগোচ্ছে ইরান। ইতিমধ্যেই সেই প্রস্তাবে সিলমোহর দিয়েছে তেহরানের পার্লামেন্ট। যদিও এ ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে সেখানকার সর্বোচ্চ জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ। সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, আইআরজিসির কমান্ডার ইসমাইল কোসারি বলেছেন, ‘‘ওই প্রণালী বন্ধ করা আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। নির্দেশ এলেই সেটা কার্যকর করা হবে।’’
১৬২০
পারস্য উপসাগরের হরমুজ় প্রণালী খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ জলপথ হিসাবে স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক বাজারে যত তেল আমদানি-রফতানি করা হয়, তার পাঁচ ভাগের এক ভাগই চলে এই সমুদ্রপথ দিয়ে। তেল রফতানিকারী দেশগুলির জোট ওপেকের সদস্য সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি, কুয়েত, কাতার এবং ইরাক এখান দিয়েই ‘তরল সোনা’ বিদেশে পাঠিয়ে থাকে। আবার বিশ্বের তরল প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানি-রফতানির প্রায় ২০ শতাংশ হয় হরমুজ় দিয়ে।
১৭২০
ইরানি নৌসেনা এ-হেন সরু সামুদ্রিক জলপথ বন্ধ করলে বিশ্ব বাজারে হু-হু করে বাড়তে শুরু করবে খনিজ তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম। এর উপর পশ্চিম এশিয়ার সামরিক ঘাঁটিতে আইআরজিসির ক্ষেপণাস্ত্র হামলা হলে চুপ করে বসে থাকবে না আমেরিকা। তখন তেহরানকে পুরোপুরি ধ্বংস করতে ফের পাকিস্তানের প্রয়োজন হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের। সেই কারণে মুনিরকে ডেকে এতটা ‘খাতির’ করেছেন ট্রাম্প, মত বিশ্লেষকদের।
১৮২০
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স অবশ্য জানিয়েছে, মার্কিন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠকে ইরান ইস্যুতে বেশ কিছু ঝুঁকির কথা স্পষ্ট করেন পাক সেনাপ্রধান। তেহরানে যুক্তরাষ্ট্র হামলা চালালে বালোচিস্তানের বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে পারে বলে উদ্বেগ রয়েছে তাঁর। দীর্ঘ দিন ধরেই দক্ষিণ-পশ্চিমের এই প্রদেশটি পাকিস্তানের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন দেশ হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে চাইছে। ইসলামাবাদের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’ ধরা পড়ে গেলে প্রতিবেশী পারস্য দেশ থেকে সাহায্য পেতে পারে সেখানকার বালোচ বিদ্রোহীরা।
১৯২০
বিশেষজ্ঞদের দাবি, ইরান ইস্যুতে আমেরিকার ‘তাঁবেদারি’ করতে গিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। তাই দু’নৌকায় পা দিয়ে চলার চেষ্টা করছে ইসলামাবাদ। জন্মলগ্ন থেকেই ধর্মীয় কারণে ইহুদিভূমিকে শত্রু বলে মেনে এসেছেন রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা। কিন্তু, আমেরিকার কথায় ইরানের পিঠে ছুরি মেরে বকলমে যুদ্ধরত ইজ়রায়েলেরই সুবিধা করে দিয়েছেন ফিল্ড মার্শাল মুনির।
২০২০
সেনাপ্রধানের এই ভূমিকায় পাক আমজনতা থেকে ইসলামিক দুনিয়ায় ধীরে ধীরে বাড়ছে ক্ষোভ। ইতিমধ্যেই তাঁকে ‘মীরজ়াফর’-এর তকমা দিয়েছে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। যদিও এ ব্যাপারে এখনও নিশ্চুপ রয়েছে ইরান। পরিস্থিতি সামলে গেলে এর শোধ কড়ায়-গন্ডায় নিতে পারে তেহরান, বলছেন প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞেরা।