চিনের মধ্যস্থতায় আফগানিস্তানের তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক মজবুত করার মরিয়া চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তান। ভারতের জন্য এটা কতটা উদ্বেগের? উঠছে প্রশ্ন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০১ জুন ২০২৫ ০৭:৩৩
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
হিন্দুকুশের কোলের দেশে চিন-পাকিস্তানের নয়া ষড়যন্ত্র! বেজিঙের হাত ধরে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াচ্ছে ইসলামাবাদ। গত দু’বছরে কূটনৈতিক চালে কাবুলকে কাছে টানতে অনেকটাই সক্ষম হয়েছে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকার। কিন্তু এ বার সেখানে দুই ‘সাপ’ একসঙ্গে ঢুকলে নয়াদিল্লির যাবতীয় পরিশ্রম জলে যাওয়ার আশঙ্কা প্রবল, বলছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশেষজ্ঞেরা।
০২১৯
গত ৩০ মে আফগান নীতিতে বড় বদলের কথা ঘোষণা করেন পাক বিদেশমন্ত্রী ইশাক দার। ‘কাবুলিওয়ালার দেশ’-এ শীঘ্রই রাষ্ট্রদূত পাঠানো হবে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই ঘোষণার ঠিক এক দিন আগে চিনা বিদেশমন্ত্রী ওয়াং ই এবং তালিবানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মৌলবি আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে বৈঠক করেন দার। ফলে ইসলামাবাদের এই সিদ্ধান্তকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে।
০৩১৯
২০২১ সালে দ্বিতীয় বারের জন্য আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে তালিবান নেতৃত্ব। কাবুলের কুর্সিতে থাকা গোষ্ঠীটি রাষ্ট্রপুঞ্জ স্বীকৃত জঙ্গি সংগঠন হওয়ায় এত দিন তাঁদের সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি পাকিস্তান। রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিয়ে ইসলামাবাদ এ বার ধীরে ধীরে সেই রাস্তা থেকে সরে আসছে বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে ভারতের উদ্বেগ বৃদ্ধির যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
০৪১৯
তালিবানের দ্বিতীয় শাসনকালের গোড়া থেকেই সীমান্ত সংঘাতকে কেন্দ্র করে আফগানিস্তান-পাকিস্তানের সম্পর্ক দাঁড়িয়েছে ‘আদায়-কাঁচকলা’য়। সূত্রের খবর, এই পরিস্থিতিতে ফাটল মেরামতিতে বড় ভূমিকা নিয়েছে চিন। মে মাসের শেষ সপ্তাহে দার বেজিং সফরে গেলে সেখানে তাঁর সঙ্গে মুত্তাকির বৈঠক করাতে সমর্থ হন ওয়াং ই। পরে তাঁদের তিন জনের পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে দাঁড়িয়ে থাকার ছবিও সমাজমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
০৫১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, বর্তমানে কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে যে সম্পর্ক রয়েছে তাকে কূটনীতির পরিভাষায় বলে ‘চার্জ ডি’অ্যাফেয়ার্স’। অর্থাৎ, আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি না থাকলেও দু’তরফে নিয়মিত কথাবার্তা হয়। এ বার সুর এক ধাপ চড়িয়ে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে রাষ্ট্রদূত পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিল শাহবাজ় শরিফের সরকার। ভারতকে বন্ধুত্বের বার্তা দেওয়া তালিবানকে দলে টানতেই এই পদক্ষেপ? উঠছে প্রশ্ন।
০৬১৯
আফগান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করতে গত এপ্রিলে কাবুলে যায় পাক প্রতিনিধি দল। সেখানে তালিবান নেতৃত্বের সঙ্গে একাধিক বৈঠক সারেন তাঁরা। এই ‘ইতিবাচক’ পদক্ষেপের প্রশংসা করে দার বলেছেন, ‘‘পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার সময় চলে এসেছে। আমাদের মধ্যে ইসলামীয় ভ্রাতৃত্ববোধ (মুসলিম ব্রাদারহুড) রয়েছে। দুই দেশের উন্নয়নে একে কাজে লাগানো যাবে।’’
০৭১৯
শাহবাজ় সরকার অবশ্য রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাকে ‘কাবুলিওয়ালার দেশে’ পাঠানো হবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি। অন্য দিকে, দারের ওই মন্তব্যের পর পাকিস্তান নিয়ে তালিবান নেতৃত্ব একটি শব্দও খরচ না করায় দানা বেঁধেছে সন্দেহ। তবে কি ইসলামাবাদের সিদ্ধান্তে আদৌ খুশি হননি তাঁরা, না কি চিনের নির্দেশে দু’তরফে গোপনে গোপনে চলছে অন্য কোনও চক্রান্ত?
০৮১৯
গত ১৫ মে তালিবানের ভারপ্রাপ্ত বিদেশমন্ত্রী মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন ভারতের বিদেশমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যনম জয়শঙ্কর। সশস্ত্র গোষ্ঠীটি দ্বিতীয় বারের জন্য কাবুলের কুর্সিতে বসার পর যা প্রথম। নয়াদিল্লির এই পদক্ষেপের পরই তড়িঘড়ি আসরে নামে চিন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের বিদেশমন্ত্রীকে বেজিঙে ডেকে এনে বৈঠকে শামিল হয় ড্রাগন সরকার।
০৯১৯
জয়শঙ্কর-মুত্তাকির ফোনালাপ শেষ হতেই এক্স হ্যান্ডলে (পূর্বতন টুইটার) পুশতু ভাষায় একের পর এক পোস্ট করেন তালিবানের ‘ডিরেক্টর অফ কমিউনিকেশন’ হাফিজ জ়িয়া আহমেদ। তাঁর দাবি, চিকিৎসার জন্য ভারতে যেতে চাওয়া আফগানদের আরও বেশি করে ভিসা দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন মুত্তাকি। পাশাপাশি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য, আফগান বন্দিদের মুক্তি ও প্রত্যাবর্তন এবং ইরানের চাবাহার বন্দরের উন্নয়ন ও ব্যবহারের বিষয়ে দু’পক্ষের মধ্যে কথা হয়েছে।
১০১৯
সাম্প্রতিক সময়ে নয়াদিল্লি, মুম্বই এবং হায়দরাবাদে আফগানিস্তানের তালিবান সরকারকে কনস্যুলার পরিষেবা প্রদানের অনুমতি দিয়েছে কেন্দ্রের মোদী সরকার। ফলে ব্যবসা, উচ্চশিক্ষা বা চিকিৎসার জন্য ভারতে আসা আফগান নাগরিকেরা বেশ কিছু প্রশাসনিক সুবিধা পাচ্ছেন। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, যে ভাবে দু’দেশের মধ্যে সম্পর্ক মজবুত হচ্ছে, তাতে অচিরেই দিল্লিতে দূতাবাস খোলার অনুমতি পাবে তালিবান প্রশাসন।
১১১৯
বিশ্লেষকদের অনুমান, আফগান মুলুকে ভারতের শিকড় মজবুত হতে দেখে কপালে ভাঁজ পড়েছে বেজিং ও ইসলামাবাদের। সেই কারণেই ‘চিন পাকিস্তান অর্থনৈতিক বারান্দা’ বা সিপিইসিকে (চায়না পাকিস্তান ইকোনমিক করিডর) হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে নিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছে ড্রাগন সরকার। এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পটিতে তালিবানকে জড়িয়ে নেওয়ার কাজ সেরে ফেলেছেন ওয়াং ই ও দার।
১২১৯
২০২১ সালে তালিবান ক্ষমতায় ফিরতেই কাবুলে ছুটে যান পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআইয়ের (ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স) তৎকালীন ডিরেক্টর জেনারেল লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়জ় হামিদ। সম্পূর্ণ আফগানিস্তান দখলে সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে সরাসরি সাহায্য করেন তিনি। ওই সময়ে হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে ঢুকে তালিবান-বিরোধীদের নিকেশ করতে বোমাবর্ষণও করেছিল ইসলামাবাদের বিমানবাহিনী।
১৩১৯
এর পর কাবুলে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা হলে আইএসআইয়ের মদতে সেখানে গুরুত্বপূর্ণ পদ পান হক্কানি গোষ্ঠীর নেতারা। বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, ইসলামাবাদ এ ভাবে নাক গলানোয় বেজায় চটে যায় তালিবান গোষ্ঠী। ফলে কিছু দিনের মধ্যেই আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত ‘ডুরান্ড লাইন’কে কেন্দ্র করে দু’পক্ষের মধ্যে তীব্র হয় সংঘাত। ১৮৯৩ সালে তৈরি ওই সীমান্তরেখাকে কিছুতেই মান্যতা দিতে রাজি নন তাঁরা।
১৪১৯
অন্য দিকে, তালিবানের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে ইসলামাবাদের অভিযোগ নেহাত কম নয়। আফগানিস্তান লাগোয়া পাকিস্তানের খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশে সক্রিয় রয়েছে তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান বা টিটিপি নামের একটি সশস্ত্র গোষ্ঠী। এই এলাকাকে নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে তাঁদের। আর তাই পাক সরকারের বিরুদ্ধে একরকম যুদ্ধ ঘোষণা করেছে এই টিটিপি। রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তারা মনে করেন তাঁদের পিছন থেকে মদত দিচ্ছে কাবুল।
১৫১৯
গত কয়েক বছরে বহু বার পাক ফৌজকে নিশানা করেছে এই টিটিপি। এর জেরে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়। খাইবার-পাখতুনখোয়ার সশস্ত্র গোষ্ঠীটির গুপ্ত ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে আফগানিস্তানের পাকতিকা প্রদেশে বোমাবর্ষণ করে ইসলামাবাদের বায়ুসেনা। ফলে বদলা নেওয়ার হুমকি দেয় কাবুলের তালিবান নেতৃত্ব। অন্য দিকে, এর জেরে তলানিতে গিয়ে ঠেকে দুই প্রতিবেশীর সম্পর্ক।
১৬১৯
আফগানিস্তানের অন্যতম বড় নদী হল কুনার। ৪৮০ কিলোমিটার লম্বা এই নদীটির জন্ম হয়েছে হিন্দুকুশের চিয়ানতার হিমবাহ থেকে। পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীরের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকে) গিলগিট-বালতিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে ওই হিমবাহ। লম্বা রাস্তা পাড়ি দিয়ে কুনার মিশেছে কাবুল নদীতে। এই কাবুল নদী আবার আফগানিস্তান পেরিয়ে পাকিস্তানে ঢুকে সিন্ধু নদীতে গিয়ে পড়েছে। পঞ্জাব প্রদেশের আটক শহর হল তাদের সঙ্গমস্থল। এ হেন কুনার নদীর উপর বাঁধ তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে আফগান তালিবানদের।
১৭১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, কুনারের উপর বাঁধ তৈরি হলে পাকিস্তানে কমবে নদীর জলের প্রবাহ। এমনিতেই পশ্চিমের দেশটির বিস্তীর্ণ এলাকায় রয়েছে মারাত্মক জলসঙ্কট। সিন্ধ ও বালোচিস্তানের মতো প্রদেশগুলিতে ঠিকমতো পানীয় জলই পাওয়া যায় না। এই অবস্থায় তালিবান সরকার কুনার নদীর উপর বাঁধ নির্মাণ করলে পাক পঞ্জাব প্রদেশের কৃষি পর্যন্ত মার খেতে পারে। ফলে ‘কাবুলিওয়ালার দেশ’-এর ওই সিদ্ধান্ত কখনওই মেনে নেবেন না রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা।
১৮১৯
কাবুলভিত্তিক সংবাদমাধ্যমগুলির প্রতিবেদন অনুযায়ী, কুনার নদীর উপর বাঁধ তৈরি করতে ভারতের সাহায্য নিতে পারে আফগানিস্তানের তালিবান সরকার। কারণ আগেও হিন্দুকুশের কোলের দেশটিতে উন্নয়নমূলক নানা প্রকল্পের কাজ করেছে নয়াদিল্লি। বেজিং ও ইসলামাবাদের আতঙ্ক, এতে সম্পর্ক মজবুত হলে আগামী দিনে কাবুলকে তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সুযোগ পেয়ে যাবে মোদী সরকার।
১৯১৯
আফগান মুলুকে বিপুল বিনিয়োগের লক্ষ্য রয়েছে চিনের। এর জন্য পাকিস্তানকে পাশে নিয়ে এগোতে চাইছে বেজিং। সিপিইসিকে কাবুল পর্যন্ত নিয়ে যেতে পারলে ড্রাগনের সামনে খুলে যাবে মধ্য এশিয়ার দরজা। অন্য দিকে, তালিবানকে ইরানের চা-বাহার বন্দর ব্যবহারের সুযোগ দিতে চাইছে ভারত। ফলে তিন প্রতিবেশীর ঘনিষ্ঠতা কত ক্ষণ স্থায়ী হয়, তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।