‘অপারেশন সিঁদুর’ ও তাকে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধ’ স্থগিত হওয়ার পর মার্কিন সফরে গিয়েছে পাকিস্তানের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল। ওয়াশিংটনে পৌঁছে আমেরিকার কাছে অত্যাধুনিক ‘আকাশ প্রতিরক্ষা’ ব্যবস্থা কেনার জন্য আর্জি জানিয়েছেন ইসলামাবাদের এক মন্ত্রী।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৯ জুন ২০২৫ ০৭:৫৫
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৯
ভারতের হাতে মার খেয়ে ফের আমেরিকার দ্বারস্থ ক্ষতবিক্ষত পাকিস্তান। চিনা হাতিয়ারের উপর আর ভরসা রাখতে পারছে না ইসলামাবাদ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের কাছে খোলাখুলি ভাবে আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা (পড়ুন এয়ার ডিফেন্স) চেয়েছেন পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশটির এক মন্ত্রী। তাঁর ওই প্রস্তাব মেনে অত্যাধুনিক অস্ত্র রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের হাতে তুলে দেবে মার্কিন সরকার, না কি ওয়াশিংটন থেকে খালি হাতেই ফিরতে হবে পাকিস্তানকে? এই প্রশ্নে এখন সরগরম গোটা দুনিয়া।
০২১৯
‘অপারেশন সিঁদুর’ এবং তাকে কেন্দ্র করে চলা ‘যুদ্ধ’ স্থগিত হতেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। উদ্দেশ্য, ভারতের গায়ে ‘আগ্রাসী’ তকমা সেঁটে দেওয়া। ইসলামাবাদের সাবেক বিদেশমন্ত্রী বিলাবল ভুট্টো জারদারির নেতৃত্বের ১৩ সদস্যের তেমনই একটি দল বর্তমানে রয়েছে আমেরিকা সফরে। তাঁদের মাধ্যমে এ বার যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অত্যাধুনিক হাতিয়ারের আর্জি জানাল শরিফ প্রশাসন। এই ইস্যুতে অবশ্য কোনও প্রতিক্রিয়া দেয়নি ওয়াশিংটন।
০৩১৯
আমেরিকা থেকে অস্ত্র প্রাপ্তির আশায় নয়াদিল্লিকে নিশানা করেন মার্কিন সফররত পাক প্রতিনিধি দলের সদস্য তথা ফেডারেলমন্ত্রী মুসাদিক মালিক। ‘পাকিস্তান পিপল্স পার্টি’ বা পিপিপি-র এই নেতার দাবি, ‘‘৮০টা লড়াকু জেট এবং ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে এসেছিল ভারতীয় বায়ুসেনা। এতে গোটা দেশ ধুলোয় মিশে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।’’ ওয়াশিংটনে করা তাঁর ওই মন্তব্য ইতিমধ্যেই সমাজমাধ্যমে ভাইরাল হয়ে গিয়েছে।
০৪১৯
পাক মন্ত্রী মালিকের কথায়, ‘‘আমাদের কাছে কোনও আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নেই। আমাদের এই ধরনের হাতিয়ার দেওয়া না হলে, বুঝতেই পারছেন কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি হতে যাচ্ছিল। আমরা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতাম। ৬০ হাজার শিশুকে স্কুল থেকে বার করতে হয়েছে। পাঁচটা করে ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে ভারতের ৮০টা লড়াকু জেট আমাদের দিকে ছুটে আসে। মানে ৪০০ ক্ষেপণাস্ত্র! সেগুলির কয়েকটা তো পরমাণু হাতিয়ার বহণেও সক্ষম। নয়াদিল্লির লক্ষ্য ছিল আমাদের ঘনবসতিপূর্ণ আবাসিক এলাকা।’’
০৫১৯
এর পরই ভারতীয় অস্ত্রের ঢালাও প্রশংসা করেন পিপিপি নেতা মালিক। তিনি বলেন, ‘‘বিভিন্ন দেশের থেকে নয়াদিল্লি যে হাতিয়ার কিনেছে, সেগুলি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি উন্নত। সেই কারণেই আমাদের আর্জি যুক্তরাষ্ট্র অত্যাধুনিক অস্ত্র-প্রযুক্তি আমাদের বিক্রি করুক। সেগুলো আমরা কিনে নেব। অস্তিত্ব রক্ষার জন্য এটা আমাদের খুবই প্রয়োজন।’’
০৬১৯
মার্কিন সেনার হাতে থাকা দু’টি অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে বিক্রি করেছে আমেরিকা। সেই তালিকায় প্রথমেই আসবে থাড বা ‘টার্মিনাল হাই অল্টিটিউড এরিয়া ডিফেন্স’-এর নাম। এর নির্মাণকারী সংস্থা হল যুক্তরাষ্ট্রের জনপ্রিয় প্রতিরক্ষা সংস্থা লকহিড মার্টিন। ‘হিট-টু-কিল’ প্রযুক্তিতে এটি তৈরি করেছে তারা।
০৭১৯
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি, বিভিন্ন মহড়ার সময়ে চলা পরীক্ষায় ১০০ শতাংশ সাফল্য পেয়েছে থাড। ২০০ কিলোমিটার পরিসরে এবং ১৫০ কিলোমিটার উচ্চতায় দিব্যি কাজ করতে পারে আমেরিকার এই আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এতে যে রেডার ব্যবহার করা হয়েছে, তার পাল্লা হাজার কিলোমিটার। বর্তমানে ইজ়রায়েল, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় একে মোতায়েন রেখেছে ওয়াশিংটন। ইরান, চিন এবং উত্তর কোরিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ ঠেকাতে এই সিদ্ধান্ত বলে জানা গিয়েছে।
০৮১৯
থাড ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরও একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম রয়েছে। তার নাম, ‘এমআইএম-১০৪ প্যাট্রিয়ট’। ১৯৮১ সাল থেকে এটি ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা। যুদ্ধবিমান, ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র এবং স্বল্প পাল্লার ব্যালেস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রকে অনায়াসেই ঠেকাতে পারে এই ‘প্যাট্রিয়ট’। এতে রয়েছে পিএসি-৩ ক্ষেপণাস্ত্র, যার পাল্লা ১৬০ কিলোমিটার। চার ম্যাক (পড়ুন শব্দের চেয়ে চার গুণ) গতিতে উড়ে গিয়ে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্রে আঘাত হানে সেটি।
০৯১৯
জার্মানি, জাপান এবং সৌদি আরবকে এই ‘প্যাট্রিয়ট আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা’ বিক্রি করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে, এই এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কিভের হাতে তুলে দেয় আমেরিকা। কিন্তু, তাতে যে লড়াইয়ে ইউক্রেনীয় ফৌজ বিরাট সুবিধা করতে পেরেছে, এমনটা নয়। মস্কোর পাঠানো রকেট এবং ক্রুজ় ক্ষেপণাস্ত্র আটকাতে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে মার্কিন ‘প্যাট্রিয়ট’।
১০১৯
প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের দাবি, এই দুই ব্যবস্থার মধ্যে যে কোনও একটি পাক সরকারকে বিক্রি করতে পারে মার্কিন প্রশাসন। কারণ, হাতিয়ারের ব্যাপারে এখনও রাশিয়ার উপর অনেকাংশেই নির্ভরশীল নয়াদিল্লি। ভারতের এই অবস্থান একেবারেই পছন্দ নয় ওয়াশিংটনের। সম্প্রতি তাঁর ইঙ্গিতও দেন যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য সচিব হাওয়ার্ড লুটনিক। রুশ-ভারত প্রতিরক্ষা চুক্তিগুলি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন তিনি।
১১১৯
মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হিসাবে পরিচিত লুটনিক মনে করেন, কৌশলগত সঙ্গী হিসাবে নয়াদিল্লির বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। তাঁর কথায়, ‘‘ওদের (পড়ুন ভারতের) বেশ কিছু সিদ্ধান্ত আমাদের চামড়ার নীচে জ্বলুনি তৈরি করছে। বর্তমান সময়ে নয়াদিল্লির আমাদের থেকে হাতিয়ার কেনা উচিত। কিন্তু, ওরা মস্কোর সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি করতে বেশি আগ্রহী।’’ ভারতের ‘ব্রিকস’-এর সদস্যপদ থাকা নিয়েও আপত্তি রয়েছে মার্কিন বাণিজ্য সচিবের। কারণ, এই গোষ্ঠীতে রয়েছে রাশিয়া ও চিন।
১২১৯
দ্বিতীয়ত, সব সময়েই আর্থিক ভাবে লাভবান হওয়ার স্বপ্ন দেখেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। চলতি এশিয়ার মে মাসে পশ্চিম এশিয়ার আরব মুলুকের তিনটি দেশে সফর করেন তিনি। সেগুলি হল, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরশাহি এবং কাতার। প্রত্যেকের সঙ্গেই বিপুল অঙ্কের প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। এ ক্ষেত্রে ‘বন্ধু’ ইজ়রায়েলের নিরাপত্তার কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করেননি এই বর্ষীয়ান রিপাবলিকান নেতা।
১৩১৯
তৃতীয়ত, ইতিহাসগত ভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছে আমেরিকা। ইসলামাবাদকে যখন-তখন আফগানিস্তান বা ইরানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার প্রয়োজন হতে পারে তাঁদের। ফলে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের হাতে রাখতে তাঁদের হাতে অত্যাধুনিক এয়ার ডিফেন্স তুলে দিতেই পারে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার। এর আগেও ১৯৬৫ এবং ১৯৭১ সালের যুদ্ধে হাতিয়ার ও গোলাবারুদ দিয়ে তাঁদের সাহায্য করেছিল ওয়াশিংটন। এর মধ্যে অন্যতম ছিল প্যাটন ট্যাঙ্ক। যদিও তা সত্ত্বেও ভারতের হাতে পুরোপুরি পর্যুদস্ত হয় ইসলামাবাদ।
১৪১৯
তবে এর উল্টো যুক্তিও রয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এখনকার সময়ে পাক ফৌজকে অস্ত্র বিক্রির ভুল করবে না আমেরিকা। কারণ, চিনের সঙ্গে দিন দিন যুক্তরাষ্ট্রের তিক্ততা বাড়ছে। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় এলাকায় মার্কিন নৌসেনার প্রবেশ বন্ধ করতে চায় বেজিং। এ ছাড়া তাইওয়ান দখলের স্বপ্ন রয়েছে ড্রাগনের। জাপান এবং ফিলিপিন্সের মতো আমেরিকার ‘বন্ধু’ দেশগুলিকেও আক্রমণ করতে পারে তারা।
১৫১৯
বিশ্লেষকদের দাবি, এশিয়ার বুকে চিনকে টক্কর দেওয়ার শক্তি যে একমাত্র ভারতের আছে, তা ভালই জানে যুক্তরাষ্ট্র। সেই কারণে নয়াদিল্লিকে সঙ্গে নিয়ে চতুঃশক্তি জোট বা কোয়াড (কোয়াড্রিল্যাটারাল সিকিউরিটি ডায়লগ) তৈরি করেছে ওয়াশিংটন। সেখানে রয়েছে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশও। এই পরিস্থিতি মার্কিন সরকার ইসলামাবাদের সঙ্গে মাখামাখি করলে জোট ভেঙে বেরিয়ে যেতে পারে ভারত, যা কখনওই চাইবে না আমেরিকা।
১৬১৯
এ ছাড়া বর্তমানে দেউলিয়ার দরজায় দাঁড়িয়ে রয়েছে পাকিস্তান। ফলে বিপুল অর্থ খরচ করে ‘থাড’ বা ‘প্যাট্রিয়ট’-এর মতো এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম কেনা ইসলামাবাদের পক্ষে মোটেই সহজ নয়। বিশ্লেষকেরা মনে করেন, আর্থিক সঙ্গতি না থাকার কারণেই হাতিয়ারের ব্যাপারে রাওয়ালপিন্ডির সেনাকর্তাদের চিন নির্ভরশীলতা কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে। এতে বেজায় চটেছে আমেরিকা।
১৭১৯
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওয়ের বৈসরন উপত্যকায় পাক মদতপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলায় প্রাণ হারান পর্যটক-সহ ২৬ জন। এর প্রতিশোধ নিতে ৭ মে মাঝরাতে পাকিস্তান এবং পাক অধিকৃত জম্মু-কাশ্মীর বা পিওজেকের (পাক অকুপায়েড জম্মু-কাশ্মীর) ন’টি জঙ্গিঘাঁটিকে গুঁড়িয়ে দেয় ভারতীয় সেনা। এর পরই পাল্টা আক্রমণের রাস্তায় হাঁটে ইসলামাবাদের বাহিনী।
১৮১৯
গত ৮ থেকে ১০ মের মধ্যে উত্তর এবং পশ্চিম ভারতের একাধিক সেনাছাউনি লক্ষ্য করে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় পাক সেনা। আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে সেগুলিকে শূন্যেই ধ্বংস করে নয়াদিল্লি। এর পর পাল্টা প্রত্যাঘাত হেনে ইসলামাবাদের ১১টি বিমানঘাঁটি ধ্বংস করে দেয় এ দেশের ফৌজ। এই ‘যুদ্ধে’ ভারতীয় ড্রোন হামলায় উড়ে যায় পাকিস্তানের এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম।
১৯১৯
সূত্রের খবর, চিনের তৈরি ‘এইচকিউ-৯পি’ নামের একটি আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে মোতায়েন রেখেছিল ইসলামাবাদ। পাক ফৌজের দাবি, ইজ়রায়েলি ‘হারোপ’ আত্মঘাতী ড্রোন ব্যবহার করে সেটিকে ধ্বংস করেছে ভারতীয় সেনা। উল্লেখ্য, ‘যুদ্ধে’র সময়ে নয়াদিল্লির ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোনকে চিহ্নিতই করতে পারেনি বেজিঙের ওই হাতিয়ার। এ ছাড়া ড্রাগনের থেকে কেনা অন্য পাক অস্ত্রগুলির পারফরম্যান্সও ছিল খুবই খারাপ। সেই কারণেই এ বার মার্কিন হাতিয়ার কেনার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করলেন শাহবাজ় মন্ত্রিসভার সদস্য।