ভারত-পাক সংঘাতের আবহে করাচিতে তুরস্ক বায়ুসেনার মালবাহী বিমানের অবতরণকে কেন্দ্র করে তুঙ্গে উঠেছে জল্পনা। ইসলামাবাদকে বিপুল পরিমাণে হাতিয়ার ও গোলা-বারুদ সরবরাহ করছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’, উঠছে প্রশ্ন।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ০৫ মে ২০২৫ ০৭:৫৭
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১২০
ভারতের সঙ্গে সংঘাত তীব্র হতেই আতঙ্কিত পাকিস্তান। অস্তিত্ব বাঁচাতে এ বার ‘ইসলামিক ভ্রাতৃত্বের’ তাস খেলল ইসলামাবাদ। তাতে অবশ্য অনেকটাই সাফল্য পেয়েছেন পাক প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ় শরিফ। যুদ্ধের জিগির তোলা রাওয়ালপিন্ডির ফৌজি জেনারেলরা তুরস্কের পূর্ণ সমর্থন পাচ্ছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর ছড়িয়ে পড়েছে।
০২২০
চলতি বছরের ২৮ এপ্রিল দক্ষিণ পাকিস্তানের করাচি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে তুরস্কের সি-১৩০ই হারকিউলিস মালবাহী বিমান অবতরণ করতেই দুনিয়া জুড়ে শুরু হয় হইচই। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলির দাবি, ওই বিমানে বিপুল পরিমাণ হাতিয়ার, গোল-বারুদ এবং যুদ্ধের সরঞ্জাম পাঠিয়েছে আঙ্কারা। বিষয়টি নিয়ে অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে ইসলামাবাদ।
০৩২০
করাচিতে অবতরণ করা তুরস্কের মালবাহী বিমানের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি থাকায় সংঘাতের আবহে নয়াদিল্লির উদ্বেগ আরও বেড়েছে। এক্স হ্যান্ডলে (সাবেক টুইটার) ছড়িয়ে পড়া খবর অনুযায়ী, পাকিস্তানে মোট ছ’টি সি-১৩০ই হারকিউলিস বিমান নামিয়েছে তুর্কি বায়ুসেনা। আরব সাগরের উপর দিয়ে সেগুলিকে উড়িয়ে আনা হয়। তা ছাড়া করাচি বায়ুসেনা ঘাঁটিতে নাকি সেগুলি দীর্ঘ সময় দাঁড়িয়েছিল।
০৪২০
ঐতিহাসিক ভাবে অবশ্য ইসলামাবাদ ও আঙ্কারার সম্পর্ক বেশ মধুর। বিশ্লেষকদের একাংশ তাই মনে করেন, যুদ্ধ বাধলে তুরস্কের ‘অন্ধ’ সমর্থন পাবে পাকিস্তান। ফলে এ ব্যাপারে কেন্দ্রের নরেন্দ্র মোদী সরকারকে আগাম সতর্ক হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তাঁরা। উঠেছে ‘ইউরোপের রুগ্ন মানুষ’টির উপর কূটনীতিক বাণ চালানোর দাবিও।
০৫২০
বিষয়টি নিয়ে মুখ খুলেছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের গবেষক তথা অবজ়ারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো সুশান্ত সারিন। তাঁর কথায়, ‘‘আমরা সাপকে খাওয়াই, তার পর ভাবি কেন সেটা আমাদের কামড়াল। আমরা শত্রুদের পুরস্কার দিই আর বন্ধুদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে ফেলি। তুরস্ক ‘বন্ধু’ হবে বলে মিথ্যা স্বপ্ন দেখছে মোদী সরকার। উল্টে আমাদের পিঠে ছুরি বসানোর জন্য তাতে শান দিচ্ছে ওরা।’’
০৬২০
একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি স্পষ্ট করেছেন সারিন। তিনি বলেন, ‘‘তুরস্কের থেকে হামলাকারী ড্রোন কেনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল ভারত। কিন্তু, আঙ্কারা তাকে পত্রপাঠ না বলে দেয়। শুধু তা-ই নয়, এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে ইসলামাবাদ সফর করেন তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিচেপ তায়িপ এর্ডোগান। ওই সময় কাশ্মীর ইস্যুতে আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন তিনি।’’
০৭২০
সারিনের এই সমস্ত যুক্তি যে একেবারই ফেলে দেওয়ার নয়, তা মানছেন দেশের তাবড় প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকেরা। আর তাই অবিলম্বে তুরস্কের ইস্তানবুল হয়ে ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত অসামরিক বিমান চলাচল বন্ধ করার দাবি তুলেছেন তাঁরা। বর্তমানে উড়ান সংস্থা ইন্ডিগোকে এই অনুমতি দিয়েছে নয়াদিল্লি। ফলে টার্কিশ এয়ারলাইন্স অতিরিক্ত আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে বলে ইতিমধ্যেই অভিযোগ উঠেছে।
০৮২০
বছর কয়েক আগে পাক ফৌজকে অতিশক্তিশালী বের্যাক্টার টিবি২ এবং আকিনসি নামের দু’টি ড্রোন সরবরাহ করে তুরস্ক। এর মধ্যে প্রথমটি কেনার ব্যাপারে আগ্রহী ছিল নয়াদিল্লি। সূত্রের খবর, এই ড্রোন বাংলাদেশের বাহিনীর হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে আঙ্কারার। আর তাই জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁও জঙ্গি হামলার নিন্দা করায় প্রেসিডেন্ট এর্ডোগানের মতিগতি নিয়ে সন্দেহ দানা বাঁধছে।
০৯২০
পাশাপাশি, ইসলামাবাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘কান’ নামের পঞ্চম প্রজন্মের একটি যুদ্ধবিমান তৈরি করছে তুরস্ক। গত বছর দুই দেশের মধ্যে এই সংক্রান্ত একটি চুক্তিও স্বাক্ষরিত হয়। আগামী বছরের মধ্যে ‘কান’ লড়াকু জেটকে বিমানবাহিনীর বহরে শামিল করার পরিকল্পনা রয়েছে আঙ্কারার। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি হাতে পাবে পাক বায়ুসেনাও।
১০২০
২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভয়াবহ ভূমিকম্পে কেঁপে ওঠে তুরস্ক। চোখের নিমেষে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় বিস্তীর্ণ এলাকা। ওই সময় বিবাদ ভুলে আঙ্কারার পাশে দাঁড়িয়েছিল নয়াদিল্লি। এশিয়া মাইনরের দেশটিতে বিপুল পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী পাঠান প্রধানমন্ত্রী মোদী। ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধারকাজে নামে ভারতীয় সেনা, বিমানবাহিনী এবং জাতীয় বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী বা এনডিআরএফ।
১১২০
কিন্তু বিশ্লেষকদের দাবি, বিপদের সময়ে করা এই সাহায্যের প্রতিদান যে তুরস্ক পরবর্তী সময়ে দিয়েছে, তা নয়। গত দু’বছরে আন্তর্জাতিক মঞ্চে কাশ্মীর ইস্যুতে সামান্য নরম বিবৃতি বা চুপ করে থাকা ছাড়া আর কিছুই করেনি এর্ডোগান প্রশাসন। উল্টে ইসলামাবাদের সঙ্গে সম্পর্ক আরও মজবুত করার দিকেও এগিয়েছে আঙ্কারা। হামলাকারী ড্রোন সরবরাহ বা ‘কান’ যুদ্ধবিমান প্রকল্পে ইসলামাবাদের অন্তর্ভুক্তি তার প্রমাণ।
১২২০
তবে ভারতের সঙ্গে সংঘাতের আবহে পাকিস্তান যে সমস্ত ইসলামীয় দেশগুলির সমর্থন পেয়েছে, এমনটা নয়। কারণ, ইসলামাবাদের পাশে দাঁড়িয়ে ধর্মীয় সংহতির বার্তা দেওয়ার চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক, আর্থিক এবং বাণিজ্যিক সম্পর্ককে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে গোটা আরব মুলুক। পহেলগাঁও হামলার জন্য নয়াদিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করতে নারাজ সমস্ত উপসাগরীয় দেশ।
১৩২০
উদাহরণ হিসাবে প্রথমেই সৌদি আরবের কথা বলা যেতে পারে। পহেলগাঁও হামলার পর রিয়াদ কোনও জোরালো বিবৃতি দেয়নি। মক্কা-মদিনার দেশটি কাশ্মীর ইস্যুকে ভারত ও পাকিস্তানের দ্বিপাক্ষিক সমস্যা বলে মনে করে। বর্তমানে এই আরব মুলুকটি ‘ভিশন ২০৩০’ নামের প্রকল্পের উপর জোর দিয়েছে।
১৪২০
সৌদি যুবরাজ তথা প্রধানমন্ত্রী মহম্মদ বিন সলমন আরব মুলুকটিকে বিশ্বের অন্যতম সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করতে বদ্ধপরিকর। সেই লক্ষ্যে একের পর এক পরিকাঠামোগত উন্নয়নমূলক প্রকল্পের কাজ দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এতে ভারতের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সৌদির ওই সমস্ত প্রকল্পে কাজ করছে এ দেশের বিপুল সংখ্যক শ্রমিক এবং ইঞ্জিনিয়ার।
১৫২০
এ ছাড়া নয়াদিল্লির সঙ্গে সৌদির বাণিজ্যিক সম্পর্কও বেশ ভাল। ভারতকে বিপুল পরিমাণে জ্বালানি (পড়ুন পেট্রোলিয়াম) সরবরাহ করে থাকে রিয়াধ। এর উপর আরব মুলুকটির অর্থনীতি পুরোপুরি নির্ভরশীল। একই কথা কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরশাহির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। আর তাই পরমাণু শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর সংঘাতে নিরপেক্ষ অবস্থান নিয়েছে দুই উপসাগরীয় দেশ।
১৬২০
পাকিস্তানের পশ্চিমের প্রতিবেশী দেশ ইরান আবার বিবাদ মেটাতে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছে। পারস্য উপসাগরের কোলের দেশটিতে চাবাহার বন্দর তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে ভারতের। ওই বন্দরটির মাধ্যমে আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, এমনকি রাশিয়া পর্যন্ত পণ্য পরিবহণ করতে থাকে ভারত। এতে শিয়া মুলুকটির অর্থনীতিও উপকৃত হচ্ছে। আর তাই শান্তি বার্তার কথা শোনা গিয়েছে তেহরানের গলায়।
১৭২০
ইসলামীয় দেশগুলির মধ্যে আজ়ারবাইজানের সমর্থন অবশ্য পাবে ইসলামাবাদ। একটা সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়ানের (অধুনা রাশিয়া) অংশ ছিল মধ্য এশিয়ার এই দেশ। প্রতিবেশী আর্মেনিয়ার সঙ্গে আজ়ারবাইজানের সীমান্ত বিবাদ রয়েছে। গত কয়েক বছরে ভারতের থেকে বেশ কয়েকটি হাতিয়ার কিনেছে আর্মেনিয়া। তার পর থেকে পাকিস্তানকে খোলাখুলি ভাবে সমর্থন করছে আজ়ারবাইজান।
১৮২০
গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পহেলগাঁওতে পাক মদতপুষ্ট জঙ্গিদের হামলায় পর্যটক-সহ প্রাণ হারান ২৬ জন। সেই ঘটনার বদলা নিতে স্থল-জল এবং বিমানবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। তার পর থেকেই সুর চড়াতে থাকে ইসলামাবাদ। ভারতে পরমাণু হামলার হুমকি পর্যন্ত দিয়েছেন পাকিস্তানের নেতা-মন্ত্রীরা।
১৯২০
এ হেন পরিস্থিতিতে করাচিতে তুরস্কের মালবাহী বিমানের অবতরণে তীব্র হয়েছে নতুন জল্পনা। প্রতিরক্ষা বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করেন, আঙ্কারা এবং আজ়ারবাইজানকে সঙ্গে নিয়ে ত্রিশক্তি জোট গড়ে তোলার চেষ্টায় রয়েছে ইসলামাবাদ। অন্য দিকে পাকিস্তানে কোনও হাতিয়ার বা গোলা-বারুদ পাঠানো হয়নি বলে বিবৃতি দিয়েছে তুরস্কের প্রতিরক্ষা মন্ত্রক।
২০২০
এর্ডোগান প্রশাসন অবশ্য করাচিতে মালবাহী বিমানের অবতরণের কথা স্বীকার করে নিয়েছে। তাঁদের দাবি, জ্বালানি ভরার জন্য একটি সি-১৩০ই হারকিউলিস বিমানকে সেখানে নামানো হয়। কিন্তু তার পরেও এ ব্যাপারে সন্দেহ দূর হচ্ছে না। আগামী দিনে তুরস্কের উপর নয়াদিল্লি কোনও কূটনীতিক আঘাত হানে কি না, সেটাই এখন দেখার।