ব্রিটেন এবং আমেরিকার বিভিন্ন আর্থিক সংস্থার সাহায্যে চিনের শেয়ার বাজারে লগ্নি করছে এ দেশের একাধিক মিউচুয়াল ফান্ড সংস্থা। সেখান থেকে বিপুল রিটার্ন মেলায় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বাড়ছে উৎসাহ। তবে ড্রাগন-গুহায় ঢোকার ঝুঁকি বিস্তর, বলছেন বিশ্লেষকেরা।
আনন্দবাজার ডট কম ডেস্ক
শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৫:২৮
Share:Save:
এই খবরটি সেভ করে রাখার জন্য পাশের আইকনটি ক্লিক করুন।
০১১৬
কৃত্রিম মেধা বা এআইয়ের (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) দুনিয়ায় চলছে সেয়ানে-সেয়ানে লড়াই! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলিকে কড়া টক্কর দিচ্ছে চিন। বেজিঙের নতুন নতুন প্রযুক্তির জন্য মাঝেমধ্যেই আমেরিকার শেয়ার বাজারে নামছে ধস। অন্য দিকে দুরন্ত গতিতে ছুটছে ড্রাগনের টেক সংস্থাগুলির সূচক। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় লগ্নিকারীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে সম্পূর্ণ অন্য ধরনের প্রবণতা। মান্দারিনভাষীদের শেয়ার বাজারে টাকা ঢালছেন এ দেশের বিনিয়োগকারীরা।
০২১৬
চিনা শেয়ার বাজারে ভারতীয়দের সরাসরি লগ্নি করার অনুমতি নেই। ফলে বেজিঙের কোনও টেক জায়ান্টের স্টক এ দেশের বিনিয়োগকারীরা কিনছেন, এমনটা নয়। তবে ঘুরপথে মিউচুয়াল ফান্ডের মাধ্যমে সেখানে টাকা ঢালছেন তাঁরা। এই প্রবণতা বৃদ্ধির নেপথ্যে রয়েছে একটাই কারণ। সেটা হল প্রায় ৪০ শতাংশ রিটার্ন। যদিও এই লগ্নিকে যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করছেন বিশ্লেষক থেকে ব্রোকারেজ ফার্ম।
০৩১৬
বেজিঙের শেয়ার বাজারে সিঁদ কাটতে ভারতীয় বিনিয়োগকারীরা যে পদ্ধতি অবলম্বন করছেন, তার পোশাকি নাম ‘ফান্ড অফ ফান্ডস’ বা এফওএফ। একটি উদাহরণের সাহায্যে বিষয়টি বুঝে নেওয়া যেতে পারে। চিনা আইনে হংকং, মূল চিনা ভূখণ্ড এবং তাইওয়ান বা আরওসির (রিপাবলিক অফ চায়না) স্টকের দুনিয়ায় লগ্নির অনুমতি রয়েছে আমেরিকা এবং ব্রিটেনের একগুচ্ছ সংস্থার। তাদের মিউচুয়াল ফান্ডের তহবিলে বিনিয়োগ করছে এখানকার মিউচুয়াল ফান্ড। রিটার্নও আসছে ওই সংস্থাগুলির মাধ্যমেই।
০৪১৬
ধরা যাক, চিনা বাজারে বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছে ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ড ‘এক্স’ (কাল্পনিক নাম)। সেই লক্ষ্যে বহুজাতিক ব্রিটিশ আর্থিক সংস্থা ‘শ্রোডার্স পিএলসি’র সঙ্গে যোগাযোগ করল তারা। সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির নিজস্ব মিউচুয়াল ফান্ড আছে এবং সেটা বেজিঙের স্টক বাজারে লগ্নি করতে পারে। এফওএফের নিয়ম মেনে ‘এক্স’ তার তহবিলের টাকা ‘শ্রোডার্স’-এর মিউচুয়াল ফান্ডে লগ্নি করলেই ড্রাগনের বাজারে ঢুকে পড়বেন এ দেশের বিনিয়োগকারীরা। বর্তমানে এই রাস্তাই ধরেছে এখানকার বেশ কয়েকটি তহবিল।
০৫১৬
ব্রিটিশ সংস্থা ‘শ্রোডার্স’-এর পাশাপাশি ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ডের টাকা বর্তমানে চিনের বাজারে লগ্নির কাজ করছে মার্কিন সংস্থা ‘জেপি মর্গ্যান’। বেজিঙের আবার বেশ কিছু সংস্থার পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিনিয়োগের অনুমতি রয়েছে। তাদের পারফরম্যান্স বোঝার সূচকের নাম ‘গোল্ডেন ড্রাগন ইনডেক্স’। এর মাধ্যমে মান্দারিনভাষীদের শেয়ার বাজার কতটা চাঙ্গা বা ঝিমিয়ে আছে, তা বুঝতে পারে আমজনতা।
০৬১৬
চিনা বাজারে লগ্নি করা ভারতীয় মিউচুয়াল ফান্ডগুলির দাবি, সেখান থেকে এক থেকে তিন বছরের ব্যবধানে ৪২ শতাংশ রিটার্ন পাচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সেই কারণে এর প্রতি সহজেই আকৃষ্ট হচ্ছেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের দাবি, বেজিঙের বাজারের এই ‘ষাঁড়ের দৌড়ের’ নেপথ্যে রয়েছে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির দুরন্ত পারফরম্যান্স।
০৭১৬
চলতি বছরের জানুয়ারিতে কম দামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) মডেল ‘ডিপসিক-আর১’ বাজারে এনে সারা বিশ্বে সাড়া ফেলে দেয় চিন। এর ফলে বছরের শুরুতেই বড় ধাক্কা খায় আমেরিকার শেয়ার বাজার। দুনিয়ার প্রথম সারির মার্কিন এআই চিপ প্রস্তুতকারী সংস্থা ‘এনভিডিয়া’র স্টকের দাম পড়ে যায় ১৭ শতাংশ। ফলে এক দিনে সংশ্লিষ্ট সংস্থাটির লোকসানের অঙ্ক দাঁড়ায় ৬০ হাজার কোটি ডলার। ভারতীয় মুদ্রায় সেটা প্রায় ৫০ লক্ষ কোটি টাকা।
০৮১৬
‘ডিপসিক’-এর জন্য হওয়া আর্থিক লোকসান সামলে ‘এনভিডিয়া’র ঘুরে দাঁড়াতে বেশি সময় লাগেনি। নভেম্বর আসতে আসতে সংশ্লিষ্ট টেক জায়ান্টটির বাজারমূল্যে যুক্ত হয় ৪৫ হাজার কোটি ডলার। চিনকে এআই চিপ সরবরাহ করা পুরোপুরি বন্ধ রেখেছে তারা। যদিও তাতে বেজিঙের টেক জায়ান্টগুলির ছোটার গতি কমেনি। জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে আরও কিছু কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি বাজারে আনে ড্রাগন। চিকিৎসা থেকে শুরু করে অন্যান্য নানা ক্ষেত্রে যার বিপুল ব্যবহার শুরু হয়ে গিয়েছে।
০৯১৬
বিশেষজ্ঞদের একাংশের দাবি, আগামী দিনে আরও ঊর্ধ্বমুখী হতে পারে চিনা টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির সূচক। সেই কারণেই স্টকের দুনিয়ায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে তাদের বাজারমূল্য। কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তিকে চালু রাখতে দেশের বাইরেও ‘তথ্যকেন্দ্র’ বা ডেটা সেন্টার চালাচ্ছে বেজিং। আগামী দিনে তা আরও বাড়ানোর পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। এর জন্য ৭০ হাজার কোটি ডলার বিনিয়োগের কথা ঘোষণা করেছে ড্রাগন সরকার।
১০১৬
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, এআই প্রযুক্তির উপর জোর দেওয়ার কারণে চিনের বিদ্যুতের খরচ বেড়ে গিয়েছে কয়েক গুণ। বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণ ৩০ শতাংশ এবং তার জন্য ব্যয় ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। সেই কারণে কৃত্রিম মেধাভিত্তিক সংস্থাগুলির উপর ভরসা করছেন বিদেশি বিনিয়োগকারীদের একাংশ। তার পরেও এই ধরনের লগ্নির ক্ষেত্রে বাড়তি সতর্কতা নেওয়ার কথা বলেছেন বিশ্লেষকেরা।
১১১৬
আর্থিক বিশেষজ্ঞ এবং ব্রোকারেজ ফার্মগুলির দাবি, বেজিঙের শেয়ার বাজারের ‘ষাঁড়ের দৌড়’ অনেকাংশেই মার্কিন-চিন দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণ হিসাবে ‘ডিপসিক-আর১’-এর কথাই বলা যেতে পারে। জানুয়ারিতে এটি বাজারে আসার পর প্রযুক্তি চুরির অভিযোগ তোলে যুক্তরাষ্ট্র। সেখানকার টেক সংস্থাগুলির দাবি, ওপেনএআইয়ের তৈরি ‘চ্যাটজিপিটি’র হুবহু নকল করে সংশ্লিষ্ট চ্যাটবটটিকে তৈরি করেছে ড্রাগন।
১২১৬
এ বছরের জানুয়ারিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট হিসাবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেওয়ার পর থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একাধিক বার সরাসরি বিবাদে জড়ায় চিন। এপ্রিলের পর বেজিঙের বিরুদ্ধে একরকম শুল্কযুদ্ধ শুরু করে দেয় ওয়াশিংটন। ফলে দু’পক্ষই নিলাম ডাকার মতো করে চড়াতে থাকে পণ্যের উপর কর। অক্টোবরে ড্রাগন প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের সঙ্গে দেখা করেন ট্রাম্প। তাতেও বরফ তেমন গলেনি।
১৩১৬
গত ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার যুদ্ধ দফতরের সদর কার্যালয় পেন্টাগনের একটি গোপন রিপোর্ট ফাঁস করে নিউ ইয়র্ক টাইম্স। জনপ্রিয় মার্কিন গণমাধ্যমটির দাবি, সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে চিনের সঙ্গে সম্ভাব্য সংঘাতের মোকাবিলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক শক্তি বর্তমানে কী অবস্থায় রয়েছে, তারই পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা দিয়েছেন বাহিনীর শীর্ষকর্তারা। সেখানে দু’তরফের তুলনা টানতে গিয়ে ‘ওভারম্যাচ’ (মিল খাচ্ছে না) শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন তাঁরা। এককথায় বেজিঙের অত্যাধুনিক ফৌজের কাছে মার্কিন সেনাকে হারতে হতে পারে বলেও রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে।
১৪১৬
ওই রিপোর্ট অনুযায়ী, যুদ্ধের সময়ে এআই প্রযুক্তিকে ব্যাপক ভাবে ব্যবহার করতে পারে চিন। আর তাই সাবেক সেনাকর্তাদের একাংশের ধারণা, আগাম সতর্কতা হিসাবে বেজিঙের কৃত্রিম মেধার উপর নানা ভাবে নিষেধাজ্ঞা চাপানোর চেষ্টা করবে ওয়াশিংটন। তখন ড্রাগনের শেয়ার বাজার কেমন পারফরম্যান্স করে, তা নিয়ে ধোঁয়াশা থাকছে।
১৫১৬
ব্রোকারেজ ফার্মগুলি জানিয়েছে, চিনা টেক জায়ান্ট সংস্থাগুলির উপর যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা চাপালে সেখানে লগ্নি করা অর্থ বার করে আনা কঠিন হতে পারে। তা ছাড়া যে সংস্থার মাধ্যমে এখানকার মিউচুয়াল ফান্ড বিনিয়োগ করছে, সেটা কোনও কারণে ‘কালো তালিকাভুক্ত’ হলেও তৈরি হবে জটিলতা।
১৬১৬
আমেরিকা এবং চিনের পাশাপাশি ব্রিটেন-ফ্রান্স-জার্মানি-রাশিয়ার মতো একাধিক ইউরোপীয় দেশ শক্তিশালী কৃত্রিম মেধা প্রযুক্তি তৈরি করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। দৌড়ে রয়েছে জাপান, রিপাবলিক অফ কোরিয়া বা আরওকে (পড়ুন দক্ষিণ কোরিয়া) এবং ভারতও। সংশ্লিষ্ট দেশগুলি থেকে নতুন প্রযুক্তি বাজারে এলে বেজিং-বাজারের এআই বুদবুদ ফাটতে পারে। তখন সূচক যে খাদে নামবে তা বলাই বাহুল্য।