সাত বোনের মধ্যে নেহা পঞ্চম, জ্যোতি ষষ্ঠ। বনওয়ারিটোলায় ছোট্ট একটা সেলুন ছিল তাঁদের বাবার। সে বছর পাঁচেক আগের কথা। চার বোনের তখন বিয়ে হয়ে গিয়েছে। নেহা তখন স্থানীয় ছত্রপতি শিবাজি হাইস্কুলের নবম শ্রেণিতে, জ্যোতি অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সবচেয়ে ছোট বোন গুঞ্জা পড়ছে প্রাথমিকে। গুরুনারায়ণ শর্মা কঠিন অসুখে পড়লেন। দুই হাত অচল হল পক্ষাঘাতে। ক্ষৌরকারের দুই হাতই যদি না চলে তা হলে কী হয় সহজেই অনুমেয়। বাড়ির আয়ের একমাত্র উৎস সেলুনটি বন্ধ হল, সংসারটারই তখন পথে বসার উপক্রম।
গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তটা নিতে চব্বিশ ঘণ্টাও সময় নেননি জ্যোতি আর নেহা। স্রেফ নিজেদের উৎসাহে ছোটবেলা থেকেই বাবার কাছ থেকে সেলুনের কাজ শিখেছিলেন তাঁরা। সে দিন ওই বিপর্যয়ের মুহূর্তে অসুস্থ বাবার কাছে গিয়ে জানিয়েছিলেন, তাঁরা চালাবেন সেলুন। টেলিফোনে সে দিনের কথা বলতে গিয়ে আবেগে গলা বুজে আসছিল গুরুনারায়ণের, ‘‘ সেলুনটা তো পুরুষদের জন্য। আমার অল্পবয়সি মেয়েদুটো কী করে সেখানে ছেলেদের চুল-দাড়ি কাটবে, ভেবে কূল পাচ্ছিলাম না। চিন্তা হচ্ছিল, সমাজ কী বলবে, গ্রামের লোক কী বলবে? কে বিয়ে করবে ওদের? হয়তো চরিত্র নিয়ে কথা উঠবে। নিজের অসহায় অবস্থাকে ধিক্কার দিচ্ছিলাম। আবার সেলুন না চললে এতগুলো পেটে ভাতও জুটবে না। নিরুপায় হয়ে অনুমতি দিয়েছিলাম।’’
জ্যোতি-নেহার কাজ শুরু হল। কিন্তু শুরুতেই ধাক্কা। ‘মেয়ে নাপিত’-এর কাছে চুল-দাড়ি কাটতে চাইছিলেন না বহু পুরুষ। কেউ কেউ অশালীন মন্তব্যও করেছেন। কেউ সেলুনে এসে দুই মেয়েকে দেখে ভূত দেখার মতো তাকিয়ে থেকে সরে পড়েছেন গুটিগুটি। টেলিফোনে নেহা জানালেন, ‘‘তখন আমি আর জ্যোতি ভাবলাম, ছেলে না সাজলে সেলুন চালাতে পারব না। পর দিন চুল কেটে, প্যান্ট-শার্ট পরে কাজ শুরু করলাম। আমি নাম নিলাম দীপক, জ্যোতির নাম হল প্রদীপ। সকালে স্কুলে যেতাম, বাড়ি ফিরতাম বেলা তিনটেয়। সাড়ে তিনটে থেকে শুরু হত সেলুনের কাজ, চলত রাত ন’টা পর্যন্ত। দিনে তিন-চারশো টাকা রোজগার করতাম।’’
সেটা ২০১৪। পরের চারটে বছর এ ভাবেই নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে ছদ্মবেশে সেলুন চালিয়েছেন দুই বোন। জ্যোতি বললেন, ‘‘আমাদের এই পাড়ার ৯০-১০০টি ঘরের লোক শুধু জানত আমাদের কথা। কেউ কিন্তু বাধা দেননি।
বরং পেয়েছি সহায়তা। বাবা অসুস্থ। তাই আমরা বাধ্য হয়ে এই কাজ করছি দেখে ওঁরা সবাই আমাদের আপ্রাণ সাহায্য করেছিলেন। কোনও দিন কাজ নিয়ে কোনও খারাপ কথা শুনতে হয়নি আমাদের। এই সেলুনে বেশির ভাগ খদ্দেরই আশেপাশের এলাকা থেকে আসেন। ওঁরাও কোনও দিন টের পাননি যে আমরা আসলে ছেলে নই, মেয়ে।’’
২০১৮-তে সংবাদমাধ্যম মারফত স্থানীয় প্রশাসন প্রথম নেহা ও জ্যোতির কথা জানতে পারে। তাঁদের পুরস্কৃত করে। সম্প্রতি তাঁদের নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র তৈরি করেছে এক ব্লেড প্রস্তুতকারক সংস্থা।
সেখানে দেখা যাচ্ছে, প্রান্তিক এক শহরে এক ছোট্ট ছেলে আসা-যাওয়ার পথে মহিলা ও পুরুষদের কাজকর্ম দেখে। দেখে তার ধারণা হয়, মেয়েরা শুধু বাড়ির কাজই করতে পারে। কিন্তু এক দিন বাবার সঙ্গে স্থানীয় সেলুনে গিয়ে সে দেখে, চুল-দাড়ি কাটছেন মহিলা নাপিত। স্তম্ভিত ছেলেকে বাবা তখন হাসতে হাসতে বলেন, ‘‘আরে ক্ষুর তো জানে না যে, যিনি তাকে চালাচ্ছেন তিনি মহিলা না পুরুষ!’’ শিশুমনে তৈরি হওয়া নারী-পুরুষের আলাদা কাজের ধারণা ভেঙে যায়।
গলা পর্যন্ত ঘোমটা টানা, নেহা আর জ্যোতির মা ইলাবতী দেবীও আজ তাই বলতে পারেন, ‘‘আগে মেয়েদের নিয়ে ভয় করত। কিন্তু এখন বুঝেছি, নিজেরা ঠিক থাকলে কোনও ভয় নেই। মেয়েরা সব কাজ করতে পারে। আজ আমার কোনও দুঃখ নেই পুত্রসন্তান নেই বলে।’’ নেহা ও জ্যোতিকে এখন আর ছদ্মবেশে সেলুনে কাজ করতে হয় না। বরং এই দুই কন্যার জন্য সেলুনের ভিড় ক্রমবর্ধমান।
উত্তরপ্রদেশের এই দুই কন্যা আজ উদাহরণ। তবে নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য, স্বপ্নপূরণের পথে প্রতিকূল পরিস্থিতি সামলাতে পুরুষের ছদ্মবেশে মহিলাদের কথা আছে ইতিহাসেও। মিশরের সিসা আবা দাউ এল-নেমর ষোলো বছর বয়সে বিয়ে। ছ’মাসের অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় স্বামীর মৃত্যু। পুরুষের বেশে টানা ৪৩ বছর শহরে জুতো পালিশের কাজ করে নিজের মেয়েকে বড় করেছেন, বিয়ে দিয়েছেন, বাড়ি বানিয়েছেন। দেশের প্রেসিডেন্ট হাতে তুলে দিয়েছিলেন পুরস্কার।