Advertisement
০৪ মে ২০২৪
Netaji Subhas Chandra Bose

ঐক্য এনেছিলেন উত্তর-পূর্ব ভারতে

তিনি নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। চার মাস মণিপুর ছিল নেতাজি-র প্রভিনশিয়াল গভর্নমেন্ট অব ফ্রি ইন্ডিয়া-র অধীনে। সেই গৌরবের আশি বছর পূর্ণ হল গত ১৪ এপ্রিল।

গৌরবময়: মৈরাংয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদর দফতর

গৌরবময়: মৈরাংয়ে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদর দফতর

রাজীবাক্ষ রক্ষিত
শেষ আপডেট: ২১ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:৫৪
Share: Save:

অতিথির আসল পরিচয় জানতেন না কুকি রাজা কোলাবেলা। কিন্তু ওই পুরুষসিংহ যে যেমন-তেমন লোক নন, তা আঁচ করেছিলেন। তাই বাকি সেনাদের যখন গ্রামের মানুষ চা দিচ্ছে, তখনই গাছের তলায়, খাকি পোশাক-পরা ওই ব্যক্তির হাতে তিনি তুলে দেন দুধের পাত্র। অবাক অতিথি জানতে চান, “দুধ কেন!”

রাজা বলেন, “বিশেষ অতিথিদের সম্মানে দুধ দেওয়াই দস্তুর।”

আপত্তি করেননি, তবে বলে দিয়েছিলেন, “সাধারণত আমার সৈন্যরা যা খায়, আমিও তা-ই খাই।”

বিদায়কালে হাতে লেখা একটা কাগজ রাজাকে দিয়ে অতিথি বলে গিয়েছিলেন, “ভারত স্বাধীন করার লড়াইয়ে আপনার সাহায্য কখনও ভুলব না। কাগজটা লুকিয়ে রাখবেন।”

বাক্সবন্দি করে সেই কাগজ মাটিতে পুঁতে রেখেছিলেন রাজা। যখন ইম্ফলে তুমুল যুদ্ধ শুরু হল, বিষ্ণুপুর-পূর্ব ইম্ফলে পাহাড়ের পর পাহাড় লাল হতে থাকল লক্ষাধিক সেনার রক্তে, তত দিনে কুকি রাজা জেনে গিয়েছেন, তাঁর সেই অতিথির নাম নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু।

নেতাজির হাতে লেখা কাগজটা নষ্ট হয়ে গিয়েছে জল লেগে, যে ভাবে এখন রক্ত লেগে নষ্ট হয়ে গিয়েছে মণিপুরি-কুকি-নাগা-তামিল-মুসলিমকে এক সুতোয় বেঁধে ফেলা মানুষটার সমস্ত প্রয়াস। সম্ভবত সেই প্রথম ও শেষ বার বর্মা থেকে ইম্ফল ও কোহিমা পর্যন্ত সব জনগোষ্ঠী পা মিলিয়েছিল সুভাষচন্দ্রের ডাকে।

সাম্প্রতিক সংঘর্ষের এক বছর হতে চলল। মৈরাং যাওয়ার আগেই জাপানি সেনাদের শহিদ স্মারকস্থল। আরও এগিয়ে একটা রাস্তা চলে যায় লোকটাক সরোবর ও মৈরাংয়ের দিকে ও অন্য রাস্তা কুকি এলাকা চূড়াচাঁদপুরের দিকে, এই বিভাজন এখন কার্যত দুর্লঙ্ঘ্য।

যত বার ওই লাল পাহাড়ের পাশ দিয়ে যাই, গায়ে কাঁটা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইম্ফল ক্যাম্পেনে ব্যাটেল অব রেড হিল ছিল সবচেয়ে রক্তক্ষয়ী অধ্যায়। জাপান সেনার হিসাব বলছে, চারটি ডিভিশনে মোট ১,১৫,০০০ সৈন্য নিয়ে মিত্রবাহিনীকে আক্রমণ করেছিল তারা। মারা গিয়েছিলেন ৬৫ হাজার। মিত্রবাহিনীতে নিহতের সংখ্যা ১২,৬০৩। তার বাইরেও অজস্র আজাদ হিন্দ সেনা ও নেতাজির ডাকে সাড়া দেওয়া স্থানীয় কুকি ও মেইতেই যুবকের প্রাণ গিয়েছিল যুদ্ধে।

আমজনতার ধারণা, মৈরাংয়ে ভারতীয় ভূখণ্ডের প্রথম তেরঙা তুলেছিলেন নেতাজি। আজাদ হিন্দের সদর দফতর ২০২০ সালে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংহ। পতাকা উত্তোলনের স্থানে হয়েছে আজাদ হিন্দ সংগ্রহশালা।

সাম্প্রতিক বিভাজনের পরে, কুকিরা ইতিহাস তুলে ধরে দাবি করছেন, নেতাজি ইম্ফল বা মেইতেই এলাকায় পা রাখেননি। তিনি আতিথ্য নেন কুকিদের। তাঁর হয়ে যুদ্ধে প্রাণও বেশি গিয়েছে কুকিদের। কুকিরা পাহাড়-জঙ্গলে পথ না দেখালে জাপানি সেনা ভারতে ঢুকত না।

কথাটা সত্যি। ১৪ এপ্রিল, ১৯৪৪ সাল। মণিপুরিদের নববর্ষ। ওই দিন সকালে মৈরাংয়ে তেরঙা উত্তোলন করলেন আজাদ হিন্দ বাহিনীর কর্নেল শওকত আলি খান। তাঁর হিন্দি ভাষণ মেইতেই ভাষায় অনুবাদ করছিলেন এম কৈরেং সিংহ। পরে যিনি হন মণিপুরের প্রথম নির্বাচিত মুখ্যমন্ত্রী। এখন ১৪ এপ্রিলকে নববর্ষের পাশাপাশি মৈরাংয়ের পতাকা দিবস হিসাবেও পালন করা হয়। গত বছর পর্যন্তও যে পালনের শরিক হতেন মৈরাং কলেজের অধ্যাপক ও ইংরেজ-কুকি সংগ্রামের গবেষক সোনথাং হাওকিপ। কিন্তু সংঘর্ষের জেরে মেইতেই এলাকার কলেজ থেকে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে আপাতত চূড়াচাঁদপুর কলেজে পড়াচ্ছেন। সোনথাং বলছিলেন, ইংরেজ সেনা ও গোয়েন্দা অফিসারদের নথি ও অন্যান্য প্রমাণ থেকেই স্পষ্ট, বর্মা দখল করার পরে জাপান বাহিনী আর এগোতে চায়নি। কিন্তু নেতাজি জোর দেন, ভারতের মূল ভূখণ্ডে লড়াই পৌঁছে দিতে হলে ইম্ফল দখল করা ভিন্ন উপায় নেই। কিন্তু বর্মা থেকে দুর্গম পাহাড়-জঙ্গল পার করে বাহিনীকে মণিপুরে নিয়ে আসবে কে! কুকিদের ৪০ জনের একটা দল হাজির হয় সেখানে। বলে, পথ দেখাবে তাঁরা। নেতাজির বাহিনীকে সম্পূর্ণ সমর্থন জানাতে তৈরি স্থানীয় জনতা। কুকিদের দেওয়া সাহস ও দেখানো পথ ধরেই ১৯৪৪ সালের ১৮ মার্চ আইএনএ-র ফার্স্ট ডিভিশন বা গান্ধী ব্রিগেড কর্নেল ইনায়েত জন কিয়ানির নেতৃত্বে তামু-মোরে সীমান্তে হাজির হয়। টেংনাওপলের যুদ্ধ জিতে পাল্লেল পর্যন্ত দখল করে তারা।

এ দিকে শাহনওয়াজ খানের নেতৃত্বে সুভাষ ব্রিগেড উখরুলে ইম্ফল-কোহিমা সড়ক বিচ্ছিন্ন করে দেয়। কর্নেল শওকতের নেতৃত্বে স্পেশ্যাল ফোর্স বাহাদুর গ্রুপ দখল করে নেয় ইম্ফল উপত্যকার মৈরাং। পুরো অভিযানের তদারক করেন কমান্ডার মহম্মদ জামান কিয়ানি। তিনি বর্মা সীমান্তের চামোলে ফার্স্ট ডিভিশনের সদর দফতর তৈরি করেছিলেন। কুকি গবেষক ও ইতিহাসবিদদের দাবি, ভারতের শেষ স্বাধীনতা যুদ্ধে একটি দিন পতাকা তোলা বাদে মৈরাংয়ের গুরুত্ব নেই। হাওকিপ দাবি করেন, মৈরাংয়ের আগেই, ভারতে প্রথম ডিভিশনের সদর স্থাপন করা চামোলেই সম্ভবত প্রথম তেরঙা ওড়ানো হয়েছিল।

১৯৭২ সালে শিশিরকুমার বসু ও কৃষ্ণা বসু মৈরাংয়ে এসে দেখা করেন কৈরেং সিংহ ও নীলমণি সিংহদের সঙ্গে। কৈরেং-নীলমণিদের সতেরো জনের দল আজাদ হিন্দ বাহিনীর সঙ্গেই বর্মা পালিয়েছিলেন। মেইতেই মুসলিম নাকি মহম্মদও সিঙ্গাপুরে আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দেন। তাঁর সঙ্গেও দেখা করেন শরৎ-কৃষ্ণা। সেখান থেকে তাঁরা চূড়াচাঁদপুরে সেই রাজার বাড়িতেও গিয়েছিলেন।

হাওকিপ জানাচ্ছেন, ১৯৪৪ সালের ২ জুলাই পাহাড়ের উপরে থাকার আজাদ হিন্দের শিবির থেকে নেতাজি স্থানীয় রাজার সঙ্গে দেখা করে তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে এসেছিলেন। কিন্তু সাইকোট পার করে আর এগোননি নেতাজি। কারণ তিনি উখরুল হয়ে নাগাল্যান্ডের চেসেজ়ুতে ইতিমধ্যেই তাঁর শেষ শিবির তৈরি করে ফেলেছিলেন। তাই ইম্ফল কখনও যাওয়া হয়নি নেতাজির। নাগা জাতীয়তাবাদের জনক আঙ্গামি জ়াপু ফিজ়ো ১৯৪৪ সালে নেতাজির সঙ্গে যোগ দেন।

নাগা-কুকি-পাঙ্গাল ছাড়াও মণিপুরে তামিলরাও নেতাজিকে মাথায় করে রেখেছে। মোরেতে তামিল সঙ্ঘমের সাধারণ সম্পাদক মানিয়ান বালা জানাচ্ছিলেন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর স্মৃতিতে ১৯৬৯ সালে এখানে গড়ে ওঠে নেতাজি মেমোরিয়াল স্কুল। বালা জানান, ১৯৬২ সালে বর্মা সরকার মার্শাল আইন লাগু করে বহিরাগতদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে নেয়। জওহরলাল নেহরুর ব্যবস্থাপনায় ১৯৬৪ সালে বর্মাবাসী তামিল, পঞ্জাবি, গুজরাতিরা জাহাজে করে ভারতে ফিরে আসেন। কিন্তু মাদ্রাজে মানাতে পারছিলেন না তাঁরা। যুদ্ধের দু’টি করিডর দিয়ে তামিলরা মায়ানমার ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু ধরা পড়েন ও তাঁদের পাঠানো হয় ইম্ফলে। সেখানেই এক আই বি অফিসারের উদ্যোগে মোরের গ্রামসভার সঙ্গে কথা বলে তামিলদের সেখানে থাকার ব্যবস্থা হয়। ১৯৬৭ সালে তৈরি হয় আঙ্গলা পরমেশ্বরী শ্রীমুনেশ্বরা মন্দির ও তামিল সঙ্ঘম। ৪৩টি নির্দোষ তামিল পরিবারের বাড়ি পুড়েছে সংঘর্ষে। বালা দুঃখ করছিলেন, এই দিন দেখতে হবে, তা আজাদ হিন্দের সদস্য, তাঁর পূর্বপুরুষরা ভাবতে পারেননি।

আজকের সংঘর্ষ-বিভাজিত মণিপুরে সব পক্ষ একটি বিষয়ে একমত— মেলালে তিনিই মেলাতেন। যেমন মিলিয়েছিলেন ১৯৪৪-এ। যে চারটি মাস মণিপুরের প্রায় ১২ হাজার বর্গকিলোমিটারে ছিল নেতাজির প্রভিনশিয়াল গভর্নমেন্ট অব ফ্রি ইন্ডিয়া-র অধীনে।

আজাদ হিন্দ সংগ্রহশালার কিউরেটর লইশরাম সাধনা দেবী জানান, আজাদ হিন্দ বাহিনীর মোরের সদর দফতর বাদে, অন্য কোনও দফতর ও ঘাঁটি সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। পতাকা উত্তোলন হয়েছে অন্যান্য বছরের মতোই, কিন্তু সেই উত্তোলনে মিশে ছিল মানবিকতার উত্তরণ নয়, অবরোহণের সাক্ষ্য।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Azad Hind Fauz Imphal Manipur
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE