Advertisement
E-Paper

ওই টিটিই আসছে!

ট্রেনের টিকিট চেকিং যাঁরা করেন, আর যাঁরা টিকিট ফাঁকি দেন, সবারই থাকে নানা অস্ত্র, আর নানা রকম হার-জিত।পৌঁ ছলাম খড়্গপুরে। ট্রেন কয়েক সেকেন্ড থেমে ছেড়ে দিল। আমি প্ল্যাটফর্ম বরাবর হাঁটছি, পরনে কালো কোট এক টিটিই ডাকলেন। ভদ্রলোক বয়সে অনেক বড়। বললেন, ভাই টিকিট?

সুদর্শন নন্দী

শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
ছবি: সুমিত্র বসাক

ছবি: সুমিত্র বসাক

পৌঁ ছলাম খড়্গপুরে। ট্রেন কয়েক সেকেন্ড থেমে ছেড়ে দিল। আমি প্ল্যাটফর্ম বরাবর হাঁটছি, পরনে কালো কোট এক টিটিই ডাকলেন। ভদ্রলোক বয়সে অনেক বড়। বললেন, ভাই টিকিট?

হাওড়া পর্যন্ত টিকিট। নেমেছি তার আগে খড়্গপুরে, তাই স্মার্টলি টিকিট বের করি।

মৃদু হাসেন টিটিই। বললেন, ৩৬১ টাকা দিন।

আমি হতভম্ব। বললাম টিকিট কেটেছি, ফাইন কেন?

— এ ট্রেনের এখানে স্টপেজ নেই। তোমার টিকিট ইনভ্যালিড।

— মামদোবাজি নাকি? ট্রেন দাঁড়াল, আমি নামলাম আর স্টপেজ নেই মানে?

— এ ট্রেন ভুবনেশ্বরের পর একেবারে হাওড়ায় স্টপেজ। (তখন খড়্গপুরে করমণ্ডলের অফিশিয়াল স্টপেজ না থাকলেও কয়েক সেকেন্ড দাঁড়াত।)

— তা হোক, ফাইন কেন?

— তুমি রানিং ট্রেন থেকে নেমেছ।

— মিথ্যা কথা। আমি ট্রেন দাঁড়ানোর পর নেমেছি।

— যে ট্রেনের স্টপেজই নেই সেই ট্রেন থেকে লাফিয়ে ছাড়া নামবে কী করে ভাই। আড়াইশো দাও দিকি। না হলে কেস খাবে।

ফান্দে পড়েছি দেখে এ বার জানাই, অত টাকা নেই আমার কাছে। তা ছাড়া বিষ্ণুপুর যাওয়ার বাসভাড়াও প্রয়োজন।

টিটিই অনেক ভেবে আমার পকেট হাতড়ে মানিব্যাগ থেকে ২৫ টাকা পেলেন।

অভিভাবকের মতো জিজ্ঞাসা করলেন— বিষ্ণুপুর যেতে কত লাগে বাসে?

বললাম, আট টাকা।

উনি দশ টাকা ফেরত দিয়ে পনেরো টাকা নিলেন। তার পর বললেন, অন্য কেউ হলে পুরোটাই নিয়ে নিতেন। এ বার তিনি ওভারব্রিজের সিঁড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন, যাতে আর কোনও টিটিই-র খপ্পরে না পড়ি।

আমার এক বন্ধু এক বার আসানসোল গিয়েছিল হাওড়া থেকে। খুব তাড়াতাড়ি থাকায় টিকিট কাটেনি। শক্তিপুঞ্জে বসেছিল, কামরার পাশে প্ল্যাটফর্মে দাঁড়ানো টিটিই-কে বলে। উনি বলেছিলেন, টিকিট কেটে দেবেন। এ ভাবে অনেক যাত্রীই টিটিই-কে বলে উঠেছেন।

ট্রেন ছাড়ল। কিছু ক্ষণ পর টিটিই এলেন। একের পর এক টিকিটের টাকা নিচ্ছেন, আর একটা সাদা কাগজে লিখে রাখছেন। বন্ধুটি টিকিট চাইলে টিটিই বললেন— প্রচুর ডব্লিউ টি (উইদাউট টিকিট)। অনেক সময় লাগবে। সব লিখে নিয়ে আমার সিটে বসে, পর পর টিকিট কাটব। এতে সময় বাঁচবে। এ বার উনি পরের কামরায় চলে গেলেন।

ঘণ্টা দুই কেটে গেল। আসানসোল ঢুকব ঢুকব। এ বার অন্য এক টিটিই কামরায় ঢুকেছেন। আমার বন্ধু তাঁর কাছে টিকিট চাইল। তিনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। সব শুনে তিনি বললেন— আজ আবার সে শালা টাকা মেরে বর্ধমানে নেমে গেছে! ব্যাটার কিছুতেই নাগাল পাচ্ছি না।

অর্থাৎ আগেরটি ছিল নকল টিটিই, ইনি আসল।

অন্য দিকে, টিটিইকে ধোকা দিতেও অনেক যাত্রী কম যায় না। আমার পিয়ন বনগাঁর ছেলে। তাকে ‘ঘোষ’ বলেই ডাকি। বাঙাল শব্দ ঝরঝর করে জিভ থেকে খসত। কথায় কথায় এক দিন জানাল, স্যর, বিশ্বাস করেন, জীবনে কখনও আমি টেরেনের টিকিট কাটি নাই।

— ধরা পড়লে? আমি জিজ্ঞাসা করি।

— হাজারো টেকনিক, একটা না একটা কাজে লাইগা যায়।

এর পর সে দুটো টেকনিক আমাকে বলেছিল। এক বার ম্যাজিস্ট্রেট চেকিং বনগাঁ স্টেশনে। বেরোবার কোনও পথ নেই। ধরা পড়া নিশ্চিত। ঘোষ নিরুপায় হয়ে, যে-ট্রেনে শিয়ালদহ এসেছিল আবার ওই ট্রেনেই উঠে গেল শিয়ালদহ মুখে। কপাল খারাপ। পরের স্টেশনে চেকার উঠল কামরায়। ঘোষ বলল— শেষ অস্ত্র কাজে লাগালাম। মুখ দিয়ে গেঁজলা বার কইরা অজ্ঞান হইয়া গেলাম। সবাই আমার চোখেমুখে জল দিয়া পরের স্টেশনে নামাইয়া দিল।

আর এক বার সে পুরনো একটা টিকিট জলে ভিজিয়ে বাঁ হাতে নিয়ে চেকারকে বলেছিল— টিকিটটা পেচ্ছাব করতে গিয়া ড্রেনে পড়ে গেছে। টিটিই আর টিকিট দেখেনি।

সব টিটিই তো আর সমান নন। আমাদের পাড়ার এক টিটিইকে চিনতাম, যিনি সারা জীবন সততার সঙ্গে ডিউটি করেছেন, প্রকৃত বিপদে পড়া যাত্রীর উপকার করেছেন, কখনও ব্ল্যাকমেল করেননি। আবার কঠোরও ছিলেন। ফাঁকিবাজ যাত্রীদের ছেড়ে কথা বলতেন না। তাঁর নামে প্রচলিত ছিল যে নিজের ছেলের ফাইনও তিনি নিয়েছেন!

অনেক টিটিই আছেন যাঁরা ফাইনের টাকাটা রেলের কোষাগারে পড়ুক চান না। চান নিজের পকেটেই ঢুকুক। সে বার গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে হাওড়া থেকে খড়্গপুর যাচ্ছি। সুপারফাস্ট টিকিটেও ওই কম দূরত্ব গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেসে যাওয়া যায় না। ট্রেন খড়্গপুর ঢুকলেই, যারা এ ধরনের মেল বা এক্সপ্রেস ট্রেনে খড়্গপুর নামে, তাদের কাছ থেকে টিটিই-রা এক-দেড়শো টাকা আদায় করেন।

সে বার আমিও ধরা পড়লাম। এক টিটিই বললেন, ফাইন লাগবে। আমি বললাম, রসিদ দিন, দিয়ে দেব। উনি এ রকম আশা করেননি। বললেন, রসিদ দিলে অনেক টাকা লাগবে। বললাম, নিয়ম মতো যতটা লাগবে ততটাই দেব এবং রসিদ নেব। আমি অনেক ক্ষণ দাঁড়িয়ে রয়েছি। জিজ্ঞাসা করি, দেরি করছেন কেন?

টিটিই এ বার আমাকে টিটিই অফিসে নিয়ে গেলেন। পরোক্ষ ভাবে বললেন— এত বোকামি আর ঝামেলা কেন বাপু? ৫০ বা ১০০ দিয়ে চলে যাও না। সে বার রসিদ নিয়েই ছাড়ি আমি।

টিটিই ঠকানোর বেশ কিছু গল্প শুনেছিলাম। একটা এ রকম। এক যাত্রী তাঁর ভাগনেকে নিয়ে রাঁচিতে আত্মীয়-বাড়ি যাচ্ছেন। যাওয়ার কথা ছিল তাঁর ছেলের। সেই মতো ছেলের নামে টিকিট কাটা ছিল। ভাগনের পদবি আলাদা। কিন্তু উনি ঠিক করেছেন, ছেলের টিকিটেই ভাগনেকে নিয়ে যাবেন। ভাগনেকেও বলেছেন, চেকার এলে চুপ করে থাকবি। এ বার চেকার টিকিট চাইলে, যাত্রীটি বললেন, আমার আর ছেলের টিকিট। টিকিট চেক করে টিটিই কিছুটা এগিয়েছেন, ভাগনে চিৎকার করলে— মামা! দারুণ দিলে!

চেকার শুনতে পেলেন। ফিরে এসে বললেন— ছেলের টিকিট বললেন, আর যাচ্ছে অন্য আর এক জন?

একটুও ভয় না পেয়ে যাত্রীটি বললেন— ও আমার ছেলেই তো।

— তবে মামা বলে ডাকল যে!

— আরে, মাথার একটু সমস্যা দেখা গিয়েছে ওর। মাঝে মাঝেই বাবাকে মামা বলছে। এ জন্যই তো রাঁচি নিয়ে যাচ্ছি চিকিৎসা করাব বলে!

sudarsan_nandi@yahoo.com

train rail sudarshan nandi howrah asansol MostReadStories
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy