Advertisement
০৪ মে ২০২৪
ধারাবাহিক উপন্যাস: পর্ব ১৭

নুড়ি পাথরের দিনগুলি

বিতান ডোরবেল বাজাতে ঊর্বী দরজা খুলে দিল। এখানে তার বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী মালবিকাকে নিয়ে থাকেন। আর থাকে ঊর্বী, যে সম্পর্কে তার বোন হয়। বিতান থাকে তার বন্ধু অনুভবের ফ্ল্যাটে।

প্রচেত গুপ্ত
শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৮ ১৯:২০
Share: Save:

পূর্বানুবৃত্তি: বিতান পরে আহিরীকে জানিয়েছিল, আহিরীর কাছে সে এসেছিল টাকা ফেরত দিতে নয়, দিনের আলোয় এক বার তার মুখটা দেখতে। বিতান ডোরবেল বাজাতে ঊর্বী দরজা খুলে দিল। এখানে তার বাবা তার দ্বিতীয় স্ত্রী মালবিকাকে নিয়ে থাকেন। আর থাকে ঊর্বী, যে সম্পর্কে তার বোন হয়। বিতান থাকে তার বন্ধু অনুভবের ফ্ল্যাটে।

বিতানের আশঙ্কার কারণ ছিল। তত দিনে বিতান তার বাবা পরিমল মুখোপাধ্যায় সম্পর্কে কিছু কিছু খবর কানাঘু্্ষোয় শুনতে পাচ্ছে। এক মহিলা নাকি তাদের কাঁকুড়গাছির সরকারি ফ্ল্যাটে নিয়মিত আসাযাওয়া করে। সঙ্গে একটি ছোট মেয়েও আসে। কখনও শোনা যাচ্ছে, মহিলার স্বামী মারা গিয়েছে, কখনও শোনা যাচ্ছে, ডিভোর্সের মামলা চলছে। বিতান এই সব তথ্যের সত্যমিথ্যে নিয়ে চিন্তিত ছিল না। তার জানার ইচ্ছেও ছিল না। সে শুধু বুঝতে পারছিল, তার নিজের বাড়িতে যাওয়ার দিন শেষ। এই মহিলা যে কোনও দিন বলে বসবে, ‘‘বাসে অটোয় যাতায়াত আর পোষাচ্ছে না। এখানেই পাকাপাকি থাকব।’’

তা-ই ঘটল। বাবা এক দিন ছেলের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানাল, ‘‘বিয়ে করেছি। ফ্ল্যাটটা তো ছোট, বুঝতেই পারছিস। ওর আবার একটা স্কুলে-পড়া মেয়ে আছে.‌.‌.‌ একটা বড় ফ্ল্যাট খুঁজছি.‌.‌.‌ তত দিন.‌.‌.‌’’

বিতান বলেছিল, ‘‘তুমি চিন্তা কোরো না বাবা। আমি ঠিক থাকার জায়গা পেয়ে যাব।’’

কলেজ শেষ হল, হস্টেলে থাকাও চুকল। এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে থাকার প্রক্রিয়া চলতে লাগল। এরই মাঝখানে এক দিন অনুভবের ফোন। এখুনি তার সেক্টর ফাইভের অফিসে দেখা করতে হবে। বিতান গেলে অনুভব বলল, ‘‘নতুন কাজ নিয়ে পুণেতে চললাম। শোন, আমি কসবার ফ্ল্যাট বেচে বাইপাসের ওপর একটা ফ্ল্যাট নিয়েছি। আটতলায় চমৎকার ফ্ল্যাট। খরচ করে সাজিয়েছি। তুই তো এখন হোমলেস। ফ্যা-ফ্যা করে ঘুরে বেড়াস। আমি ঠিক করেছি, তুই আমার ওই ফ্ল্যাটের পাহারাদার হবি। অন্য কারও হাতে ছাড়ব না, নষ্ট করে দেবে।’’

‘‘তালা বন্ধ করে রাখ।’’

অনুভব বলল, ‘‘পোড়ো বাড়ির মতো পোড়ো ফ্ল্যাট হয়ে যাবে।’’

‘‘আত্মীয় কাউকে এসে থাকতে বল।’’

‘‘দখল হয়ে যাবে। বাজে না বকে বল, কত স্যালারি নিবি?’’

বিতান বলল, ‘‘যদি রাজি না হই?’’

অনুভব বলল, ‘‘তোর ঘাড় রাজি হবে।’’

তার পর থেকে বিতানের ঠিকানা বাইপাসের আট ‌তলায়। সত্যিই দারুণ ফ্ল্যাট। শুধু ফ্ল্যাট নয়, ফ্ল্যাটের সঙ্গে ফ্রিজ, টিভি, এসি, গিজার এমনকী নিজের ক্যামেরাটাও রেখে গিয়েছে অনুভব। বলে গিয়েছে, ‘‘প্রতিটা জিনিস ব্যবহার করবি শালা। এসে যদি দেখি কোনও কিছুতে জং ধরেছে, তোমার কপালে দুঃখ আছে।’’

বিতান বলল, ‘‘খেপেছিস? অত ইলেকট্রিক বিল দেওয়ার ক্ষমতা আমার আছে না কি?’’

অনুভব বলেছে, ‘‘তোমাকে কে বিল দিতে বলেছে হারামজাদা? ইলেকট্রিসিটি, মেনটেনেন্স, কেব্‌ল, সব ইসিএস-এ পে করব। তুই বেটা ভিখিরি, ভিখিরির মতো সব ফ্রিতে ভোগ করবি।’’

ঊর্বী সরে দঁাড়াতে বিতান ভিতরে ঢুকল। যতই এই বাড়িতে বড় হোক, বছরের পর বছর কাটাক, যতই বাল্য আর কৈশোরের অজস্র স্মৃতি থাক, এখানে বিতানের আসতে ইচ্ছে করে না। অনেক বছর তো আসেওনি। পরিমল মুখোপাধ্যায় অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে মালবিকা ‌খাতা ঘেঁটে নম্বর জোগাড় করে খবর দিলেন।

‘‘তোমাকে তোমার বাবা দেখতে চাইছেন। পারলে এক বার হাসপাতালে এস। যে কোনও সময় একটা অঘটন কিছু ঘটে যেতে পারে।’’

‘অঘটন’ ঘটল না। তবে প্যারালিসিসে ভদ্রলোকের ডান দিকটা পড়ে গেল। এ বার ছেলেকে বাড়িতে ডেকে পাঠালেন। বিতান গিয়ে দেখল, মানু্্যটা কেমন যেন মিইয়ে গিয়েছে। সেই দাপট নেই, অসহায়। বিতানকে কেমন যেন আঁকড়ে ধরছেন। এখন তিন-চার মাস অন্তর মাঝে মাঝেই মোবাইলে ফোন করেন, ‘‘এক বার আসিস।’’

বিতান বলে, ‘‘কোনও দরকার আছে? ফোনে বললে হয় না?’’

পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হয়তো হয়, তার পরেও ‌আসিস এক বার সময় পেলে। শরীরটা ভাল ঠেকছে না। এলে সকাল এগারোটার পর আসবি। ওই সময়টা ঊর্বীর মা অফিসে যায়। ঊর্বীও কলেজে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে থাকে না।’’

প্রথম দিকে বিছানায় শোয়া অবস্থাতেই ছেলের সঙ্গে কথা বলতেন। এখন ফিজিয়োথেরাপি করে অবস্থার খানিকটা‌ উন্নতি হয়েছে। লাঠি নিয়ে পা টেনে টেনে বসার জায়গায় আসেন। কথা কিছুই বলেন না। চুপ করে থাকেন। ‌বিতান অধৈর্য হয়ে বলে, ‘‘বাবা, কিছু বলবে?’’

‘‘না তেমন কিছু নয়। চাকরিবাকরি পেলি?’’

বিতান বলে, ‘‘ছোটখাটো কাজ করি।’’

এত বড় ছেলে ছোটখাটো কাজ করছে শুনে কোনও বাবারই খুশি হওয়ার কথা নয়, তার পরেও পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘গুড। ছোট থেকে বড় হওয়াই ভাল। তোর মা’ও এক সময় আমাকে এই কথা বলত। কাজের জায়গায় বেশি লাফালাফি কোরো না।’’

আবার কিছু ক্ষণের জন্য মানু্ষটা চুপ করে যায়। এক সময়ে বিতান বলে, ‘‘উঠলাম।’’

পরিমল মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অবশ্যই উঠবি। ইয়ং ছেলে ঘরে বসে থাকা মানে সময় নষ্ট। তারা যত বাইরে থাকবে দুটো পয়সা উপার্জন করতে পারবে। তোর মা বলত, ঘরে বসা পুরুষমানুষের ভাগ্যও ঘরে বসা হয়। অ্যাই শোন, তোর কাছে শ’তিনেক টাকা হবে? আপাতত দুশো হলেও চলবে।‌ অসুখের পর থেকে ঊর্বীর মায়ের কাছে এখন টাকাপয়সা, এটিএম কার্ড, সব থাকে। সব সময়ে চাইতে পারি না। চিন্তা করিস না, নেক্সট দিন যখন আসবি ফেরত পাবি।’’

বিতান কখনও দু্শো, কখনও তিনশো টাকা দিয়ে উঠে আসে। টাকা ফেরতের কোনও প্রশ্ন ওঠে না। বিতান তার বাবাকে এই টাকা কেন দেয় সে নিজেও ঠিক জানে না। আবার হয়তো জানেও। মানুষটার চাওয়ার ভঙ্গি কিছু একটা দাবির মতো। যেন তার অধিকার আছে। ভাবটা এমন, যেন তিনি তার একমাত্র সন্তানের সঙ্গে এমন কোনও অন্যায় কখনও করেননি যা করা যায় না। যদি ‘বাবা–বাছা’ বা ‘সেই সময় ওইটুকু বয়েসে তোকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে বড় অন্যায় করে ফেলেছিলাম’ ধরনের কোনও আচরণ দেখাতেন, তা হলে হয়তো এক-‌দু’বারের পর অনায়াসে সরে আসতে পারত বিতান। তা হয়নি।

তবে আজ বাবা নয়, ঊর্বির মা তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মালবিকা মুখোপাধ্যায়। বিতান ভেবেছিল আসবে না। তার পরেও এসেছে। মহিলা বলেছিলেন, ‘‘অবশ্যই আসবে। তোমার বাবার ব্যাপারে আমি একটা ফাইনাল সেটলমেন্টে যেতে চাই।’’ বাবার সঙ্গে এই মহিলার ফাইনাল সেটলমেন্ট কী হবে, বিতানের জানার আগ্রহ নেই। সে কাঁকুড়গাছির এই ফ্ল্যাটে আসা একেবারের মতো শেষ করতে চায়।

ঘরে ঢুকে বিতান বলল, ‘‘তোমার মা কোথায়?’’

ঊর্বী বলল, ‘‘ডাক্তারের কাছে গেছে। আপনি এলে বসতে বলেছে। চা খাবেন?’’

‌বিতান বলল, ‘‘না।’’

ঊর্বী ঘাড় কাত করে বলল, ‘‘না বলে ভাল করলেন। ‌হ্যাঁ বললে বিরক্ত হতাম। আমার চা করতে একদম ভাল লাগে না। ‌আপনার বাবাকে ডেকে দিতে হবে?’’

বিতান বলল, ‘‘না। আমি ওর কাছে আসিনি।’’

ঊর্বী বলল, ‘‘এ বারও না বলায় খুশি হলাম।’’ তার পর মুচকি হেসে বলল, ‘‘আপনার পিতা এখন নিদ্রায় মগ্ন। দিনের বেশির ভাগ সময়টাতেই উনি আজকাল নিদ্রার মধ্যে থাকেন। কেউ ঘুম ভাঙালে বিশ্রী ভাষায় গালমন্দ করেন। আমাকে সবচেয়ে বেশি করেন। এক দিন আমাকে বললেন, অ্যাই নচ্ছার মেয়ে, আমাকে ঘুম থেকে তুললি কেন? থাবড়া দিয়ে তোর দঁাত ফেলে দেব। আমি বললাম, আপনার দঁাতের অবস্থাই তো খুব খারাপ। আপনি কী করে অন্যের দঁাত ফেলবেন? উনি তেড়েমেড়ে বললেন, চুপ কর নষ্ট মেয়ে। তোর মা নষ্ট, তুইও নষ্ট। আমি হেসে বললাম, আপনি নষ্ট মেয়েকে বিয়ে করতে গেলেন কেন? তখন আর এক চোট গাল দিলেন। অতএব আমি তাঁকে নিদ্রা থেকে তুলে গালাগালি শুনতে রাজি নই। আপনি যদি চান ভিতরে গিয়ে কথা বলতে পারেন।’’

বিতানের এ সব শুনতে খুব খারাপ লাগল। বাবার কি মাথাটাও খারাপ হয়ে যাচ্ছে? সে বিড়বিড় করে বলল, ‘‘না, কথা বলতে চাই না।’’

ঊর্বী হেসে বলল, ‘‘গুড। তা হলে বসে পড়ুন।’’

সোফায় বসল বিতান। বেতের এই সোফা তার ছেলেবেলার। একটু মেরামত হয়েছে, গদি, কভার বদলেছে। এক সময়ে এখানে সে কত বসেছে! কত দাপাদাপি করেছে!‌ তার জন্য বকাবকিও শুনতে হয়েছে।‌ তার পরেও এখন এ বাড়ির সবই বিতানের অচেনা ঠেকে। চেনা–অচেনা লাগাটা আসলে মনের উপর নির্ভর করে। মস্তিস্ক অনেক সময় চেনা অংশগুলোকে মুছে অচেনা করে দেওয়ার খেলা খেলতে ভালবাসে।

ঊর্বী বই হাতে উল্টো দিকের সোফায় ধপ করে বসে পড়ল। সে আজ কথা বলার মুডে আছে।

বিতান বলল, ‘‘তুমি পড়তে যাও।’’

ঊর্বী পায়ের উপর পা তুলে গুছিয়ে বসল। তার পর মুখ ভেটকে বলল, ‘‘সে তো যেতেই হবে। জানেন, আমার লেখাপড়া করতে একদম ভাল লাগে না। কিন্তু পড়তে হবে। একটাই বাঁচোয়া, কলেজের এগজাম দু’দিন পিছিয়েছে। নইলে ডাঁহা ফেল করতাম। আমাদের কলেজে সে দিন রাত পর্যন্ত ঘেরাও হয়েছিল। টিচার-ইন-চার্জ, টিচার সবাই। কাউকে ছাড়া হয়নি। ভাগ্যিস হয়েছিল! আমিও ঘেরাওয়ে ছিলাম। সেই কারণে এগজাম পিছিয়েছে।’’

কলেজ ঘেরাও শুনে বিতান ভুরু কোঁচকাল। কলেজের নাম জিজ্ঞেস করবে? থাক, কী হবে জেনে? ঊর্বী হাসছে। বলল, ‘‘আপনাকে একটা কথা বললে মজা পাবেন।’’

বিতান বলল, ‘‘কী কথা?’’

ঊর্বী ‌ঝঁুকে পড়ে গলা নামিয়ে বলল, ‘‘জানেন, আমি নানান রকম কায়দায় টুকতে পারি। কেউ ধরতে পারবে না। ধরা পড়ার সময় পট করে এমন সমস্ত জায়গায় কাগজ লুকিয়ে ফেলি যে কেউ বার করতে পারবে না। বার করতে গেলেই কেস খেয়ে যাবে।’’ কথাটা বলে হিহি আওয়াজ করে হাসল। তার পর বলল, ‘‘এখন অবশ্য টেকনোলজির হেল্প নিই। হোয়াটসঅ্যাপে মেটিরিয়াল লিখে নিয়ে যাই। ওড়নার তলায় মোবাইল রেখে টুকি। টেকনিকটা ভাল না?’’

একটা অন্যায় কাজের কথা যে কেউ এমন গর্বের সঙ্গে বলতে পারে বিতানের জানা ছিল না। সে চুপ করে রইল। ঊর্বী পা নামিয়ে ঠোঁট উল্টে বলল, ‘‘লাস্ট দিন ধরা পড়ে গেলাম। আহিরী রায় বলে আমাদের এক জন সুন্দরী ম্যাডাম আছেন। শুধু দেখতে সুন্দর নয়, খুব বুদ্ধি। পাশে এসে আমাকে বললেন, ওড়নার নীচ থেকে মোবাইলটা বার করে দিয়ে দাও। আমি তো পুরো বোমকে গেছি। যাহ্‌ শালা, বুঝল কী করে!‌’’

বিতান চমকে উঠল। ঊর্বী আহিরীদের কলেজে পড়ে? কই, সে তো জানত না!‌ অবশ্য জানার কথাও নয়। ঊর্বীর সঙ্গে লেখাপড়া নিয়ে কোনও দিন আলোচনা হয়নি।

বিতানের মুখ থেকে বেরিয়ে এল, ‘‘তার পর?’’

ঊর্বী চোখ বড় বড় করে বলল, ‘‘কী আর হবে? আমি তো ভাবলাম খাতা ক্যানসেল করে দেবেন, নইলে বলবেন, গেট আউট। বাইরে কান ধরে দঁাড়িয়ে থাকো। ম্যাডাম যেমন বন্ধুর মতো ব্যবহার করেন, তেমনই আবার খুব রাগীও। আমি তো ভেবলে গেছি। আজ কেলো হল।’’

বিতান স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, ‘‘উনি কী করলেন?’’

ক্রমশ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Series Novel
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE