Advertisement
১১ মে ২০২৪
Bengali Short Story

অবলোকন

কেমন একটা সম্মোহনের ভিতর হেঁটে চলছেন অন্তরা। বাঁ-পাশে পিচ-ওঠা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই কাজরীদের বাড়ি।

ছবি সৌমেন দাস।

ছবি সৌমেন দাস।

জয়ন্ত সরকার
শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০২৪ ০৮:০১
Share: Save:

রাত্রি তাঁর কাছে স্বপ্নের হাত ধরে পথ চলার মতো। স্বপ্ন না দুঃস্বপ্ন! পথ না বিপথ! অন্তরা জানেন না। শুধু অনুভব করেন, অদৃশ্য একটা টান তাড়া করছে তাকে। আর তারই প্রতিক্রিয়ায় বিছানার বদলে অন্তরা নিজেকে আজ আবিষ্কার করলেন চৌধুরীবাড়ির পাঁচিলের পাশে। মুগ্ধ হয়ে তিনি ফুলভর্তি শিউলি গাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন। পূর্ণিমার রুপোলি আলোয় চেনা পাড়াটাও অচেনা।

কেমন একটা সম্মোহনের ভিতর হেঁটে চলছেন অন্তরা। বাঁ-পাশে পিচ-ওঠা রাস্তা ধরে কিছুটা এগোতেই কাজরীদের বাড়ি। পেরিয়ে সুরঞ্জনের দোকান। আর একটু এগোতেই রাস্তার বাঁক। থমকে দাঁড়ালেন অন্তরা। আড়ষ্টতা গ্রাস করল তাঁকে। বাঁ-হাতে চিমটি কেটে বুঝলেন, নাঃ! জেগেআছেন। নাম, বাসস্থান সব মনে করতে পারছেন।

হঠাৎ ঝুপ করে একটা শব্দ হল। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে অন্তরা বোঝার চেষ্টা করলেন শব্দের উৎসটা কোথায়। এত ছিঁচকে চোরের উপদ্রব হয়েছে না পাড়ায়! রাস্তা পার হলেই সামন্তদের উঁচু পাঁচিলটা। সন্তর্পণে জাফরি দেওয়া অংশটায় চোখ রাখতেই পরিষ্কার হল ব্যাপারটা। একটা বস্তায় বাড়ির আবর্জনা ভরে রাখা ছিল। দুটো বেড়াল খাবারের সন্ধানে বস্তাটার উপর হুটোপাটি শুরু করেছিল। ফলে বস্তাটা নীচে পড়ে যায়। তাই ওই শব্দ। অন্তরা একটা ইট তুলে দু’বার হুশ-হুশ করতেই বিড়াল দুটো সরে গেল আস্তে-আস্তে।

একটু যেন সাহস পেয়েই এ বার অন্তরা জোরে-জোরে হাঁটতে শুরু করলেন। খেয়ালই করেননি, এগোতে-এগোতে কখন বড় রাস্তায় এসে পড়েছেন। হালকা কুয়াশার আস্তরণ চার পাশে। মাঝে-মাঝেই দ্রুতগামী সব গাড়ির হেডলাইটের আলো অন্ধকার কেটে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকাই একটা মারুতি সশব্দে ওঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ভয়ে সরে দাঁড়াতেই পরিচিত কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “জেঠিমা না, আপনি আবার রাতে একা-একা বেরিয়ে পড়েছেন!”

“না... মানে... তুমি এত রাতে?” আমতা-আমতা করে বললেন অন্তরা।

“হ্যাঁ, ইভনিং শিফট ছিল...” বলে সত্যেনদার ছেলে সার্থক অন্তরার হাতটা ধরে খানিকটা শাসনের ভঙ্গিতে বলল, “এত রাতে পাড়া ঘুরে বেড়ানো কি ঠিক? চলুন, আপনাকে বাড়ি পৌঁছে দিই। কত আজেবাজে লোক ঘুরে বেড়াচ্ছে..”

“আমার জন্য চিন্তা করতে হবে না। ওই দেখো, কী সুন্দর চাঁদ উঠেছে!” অন্তরা প্রসঙ্গটা পুরো ঘুরিয়ে একটু হেসে বললেন, “আমি আছি বলে এই পাড়াটায় রাতের চৌকিদারের প্রয়োজন হয় না, বুঝেছ!”

*****

“অন্তরা মিত্র, নেক্সট!”

রিসেপশনিস্ট মহিলার কণ্ঠস্বর ভেসে আসতেই অর্ক মাকে নিয়ে ডাক্তারের ঘরে ঢুকল। স্যুট-টাই পরা ডাক্তার অবিনাশ চৌধুরী অন্তরাদেবীকে চেয়ারে বসার ইঙ্গিত করে অর্কর উদ্দেশে বললেন, “বলুন, কী অসুবিধে? সাইকায়াট্রিস্টের কাছে আসতে হল কেন?”

“আমার মা একজন ইনসমনিয়ার পেশেন্ট। রাতে তাঁর ঘুম আসে না। রাত্রি তাঁর কাছে একটা বিভীষিকা। মা কত রকম যে কথা বলেন রাত্রিকে নিয়ে। রাত্রিকে শাসন করতে হয়… বশে রাখতে হয়… রাত্রি আসলে একটা শয়তান… মানে ক্রমশ একটা একটা লুনাটিক অ্যাটিটিউড…”

শান্ত গলায় ডাক্তার চৌধুরী বলেন, “আর একটু এক্সপ্লেন করুন।”

“ওই সময় অজানা একটা শক্তি যেন ওঁকে চালিত করে। কখনও কাউকে না জানিয়ে ছাদে চলে যান, কখনও খিড়কির দরজা খুলে পাড়ার রাস্তায় ঘুরে বেড়ান। ওই যে নিশির ডাক বলে একটা কথা আছে না... অনেকটা সেই রকম। তাই আত্মীয়স্বজনের পরামর্শে ঝাড়ফুঁক, তাবিজ-কবচ সব কিছু করানো হয়েছে। অনেক ডাক্তারও দেখিয়েছি… সবাই হয় নার্ভের, নয়তো ঘুমের ওষুধ দেয়… আর ওই সব ওষুধ দেখলেই কেমন ফেরোশাস হয়ে যান উনি। তাই আপনার কাছে...”

“ফ্যামিলি ব্যাকগ্রাউন্ডটা বলুন...”

“আমার বাবারা ছিলেন দুই ভাই, তিন বোন। পিসি ছাড়া বাবাদের জেনারেশনের কেউ বেঁচে নেই। আর আমরা এক ভাই, এক বোন। দিদি-জামাইবাবু চাকরিসূত্রে বেনারসে থাকে। আমি একটা বেসরকারি ফার্মে চাকরি করি। আর… আমাদের একটা পারিবারিক ব্যবসা ছিল... বাড়িতে গানবাজনার চর্চা ছিল। আমার ঠাকুরদা ছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতজ্ঞ। বাবা অর্চন মিত্রও ছিলেন সুগায়ক…”

“আপনার বাবা কবে মারা যান?”

“বছর তিনেক আগে, মাত্র সাতান্ন বছর বয়সে। ম্যাসিভ সেরিব্রাল অ্যাটাক। আধঘণ্টার মধ্যে সব শেষ।”

“মায়ের এই রাত-জাগা ব্যাপারটা কি বাবা বেঁচে থাকার সময় ছিল?”

“হ্যাঁ, প্রায় বছর পাঁচেক ধরে রোগটা চলছে। আসলে সংসার সামলাতে শেষ দিকে বাবা কিছুটা ধার-দেনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। তাই নিয়ে বাড়ির পরিবেশ কিছুটা…”

“দেখুন প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে আপনার মায়ের রোগটা এক ধরনের বিহেভিয়ারাল ডিসঅর্ডার। ওটা কোনও মেন্টাল শক থেকেও হতে পারে। তাই বলছি, আপনার পারিবারিক কিছু ছবি বা অ্যালবাম যদি থাকে, সেটা পরের দিন আমার কাছে নিয়ে আসবেন। ফটো, ভিস্যুয়াল এই সব পেশেন্টদের উপর খুব কাজ করে। তবে, সময় লাগবে। বেশ কয়েকটা কাউন্সেলিং দরকার হবে আপনার মায়ের মনের ভিতরটাকে বোঝার জন্য...” ডা. চৌধুরী এর পর অর্ককে বললেন, “ঠিক আছে আপনি একটু বাইরে অপেক্ষা করুন, আমি আপনার মায়ের সঙ্গে একটু কথা বলব।”

*****

আজ ডাক্তারবাবু পারিবারিক ছবি দেখাবেন অন্তরা মিত্রকে। তাঁকে বলা হয়েছে, ছবিগুলো দেখে যা-যা মনে আসে বলে যেতে—

প্রথম ছবি

অন্তরা মিত্র: শ্বশুরবাড়ির সদরের ছবি এটা। ওই যে বোর্ডটা... ‘সুরতীর্থ সঙ্গীত শিক্ষালয়’। বাব্বা! এত পুরনো ছবি অর্ক রেখে দিয়েছে এখনও! এই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আমার শ্বশুরমশাই। উমাপদ মিত্র। উনি এক জন বড় সঙ্গীতজ্ঞ ছিলেন। আমার গানের হাতেখড়িও ওঁর কাছেই। যখন ক্লাস ফাইভে পড়ি, মায়ের সঙ্গে প্রথম ওখানে যাই। কী দরাজ গলা… সঙ্গীত সম্পর্কে এত জ্ঞান… আর ওই যে, পিছনে একটু ঝুঁকে দাঁড়িয়ে, ওটা গুরুজির বড় মেয়ে সুতপা।

দ্বিতীয় ছবি

অন্তরা মিত্র: এটা একটা সরস্বতী পুজোর দিন। সে বার প্রথম শাড়ি পরে বেরিয়েছিলাম। আমাদের ছিল কো-এড স্কুল। তখন ছেলে-মেয়েরা এক সঙ্গে ক্লাস করলেও একটা দূরত্ব থাকত। আর ওই যে, পুরুতমশাইয়ের পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি দিচ্ছে... লম্বা গড়ন... ও-ই অর্চন... গুরুজির ছেলে। আমার থেকে চার ক্লাস উপরে পড়ত। খালি গলায় ওর রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে মুগ্ধ হয়ে যেত সবাই। আর একটা বড় সম্পদ ছিল ওর। গভীর কালো চোখদুটো। ওখানেই কী ভাবে যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম আমি…

তৃতীয় ছবি

অন্তরা মিত্র: বিয়ের পরদিন আমাদের দুই পরিবারের গ্রুপ ফোটো। আমার শ্বশুরমশাই আমাকে পছন্দ করে গৃহবধূ করলেও, গোপনে কিন্তু প্রেম করেছিলাম দু’জনে। উমাপদবাবু সম্ভবত বুঝেছিলেন ব্যাপারটা। তাই চার হাত এক করতে দেরি করেননি।

শ্বশুরবাড়িতে প্রথম কয়েক বছর খুব সুখে কেটেছে। আমার বর অর্চন তখন সবে আধুনিক গানের জগতে প্রবেশ করেছে। একটু নাম-টামও হচ্ছে। সঙ্গে পারিবারিক ব্যবসা। কিন্তু একটা পথদুর্ঘটনায় হঠাৎই শ্বশুর-শাশুড়ি এক সঙ্গে মারা যান। উঃ! কী দুঃসহ ছিল সেই শোক সামলানো।

চতুর্থ ছবি

অন্তরা মিত্র: এটা আমাদের নতুন বাড়ি। শ্বশুর-শাশুড়ির মৃত্যুর কিছু দিনেরই মধ্যেই শরিকি সম্পত্তি, ব্যবসা ভাগাভাগি হয়ে গেল। সম্পত্তি ভাগের টাকায় দোতলা বাড়িটা তৈরি করল অর্চন। এরই মধ্যে অর্ক এল আমার পেটে…

পঞ্চম ছবি

অন্তরা মিত্র: একটা কলেজ ফাংশনে গাইছে অর্চন। আমিও মাঝে-মাঝে ওই সব গানের জলসায় যেতাম। শ্রোতাদের হাততালি, অভিনন্দনের শরিক হতে-হতে ওর জন্য গর্বে ভরে উঠত আমার বুক। খুব উৎসাহ দিতাম ওকে। এক বার পুজোয় ওর একটা ক্যাসেট বেরিয়েছিল। ধুমধাম করে রিলিজ় হল। বিক্রিবাটাও হল ভাল। কী আনন্দ তখন পরিবারে! আমিও কিন্তু গানটা খারাপ করতাম না। তবে পাড়ার রবীন্দ্রজয়ন্তী, বসন্ত-উৎসব কিংবা ঘরোয়া অনুষ্ঠান পর্যন্ত ছিল আমার দৌড়। উচ্চাকাঙ্ক্ষী অর্চন প্লেব্যাক সিঙ্গার হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। আমাকেও প্লেব্যাক সিঙ্গার করার জন্য জোরাজুরি করতে লাগল। আমি ওই দৌড়ে শরিক হইনি। সংসারকেই বেছে নিয়েছিলাম।

ষষ্ঠ ছবি

অন্তরা মিত্র: এই ছবিটা কে তুলেছিল মনে পড়ছে না! জ্বরে বেহুঁশ আমি। ছোট্ট অর্ক আমার মাথায় জলপট্টি দিচ্ছে। পাশে আমাদের কাজের মেয়েটি দুধ গরম করছে। আসলে ব্যবসায় মন্দা, ভাইরাল ইনফেকশনে গলার স্বর নষ্ট হয়ে যাওয়া, সব মিলিয়ে হতাশায় ভুগতে শুরু করেছিল অর্চন। আমাদের আর্থিক অবস্থা ক্রমশ খারাপ হয়ে পড়ছিল। ওর মধ্যে নিষ্ঠারও অভাব ছিল। ভাবত ফ্লুকে সব কিছু পেয়ে যাবে। ওর গুণমুগ্ধরা হঠাৎই হাওয়া হয়ে গেল, অনুষ্ঠানের সংখ্যাও কমতে শুরু করল। শেষে বার-সিঙ্গার হয়ে উঠল অর্চন। নানা নেশা ধরল। আর ব্যর্থতার পুরো দায়টা চাপাতে লাগল আমার উপর। আজেবাজে কথা বলা, খোঁটা দেওয়া। কী ভাবে যে কেটেছে সে সব দিন! তবুও ওর প্রতি আমার ভালবাসা অটুট ছিল। ওকে সাপোর্ট দেওয়ার চেষ্টা করতাম। বিশ্বাস করতাম, সুখের দিন ফিরে আসবে…

সপ্তম ছবি

অন্তরা মিত্র: নাঃ, এই ছবিটা দেখে আমার চোখে জল এসে যাবে ভাববেন না, ডাক্তারবাবু। মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী ছিল অর্চনের। একটা সময়ের পর থেকে আমি ওকে ঘেন্না করতে শুরু করেছিলাম। চাইতাম না ওর সান্নিধ্যে অর্ক বড় হয়ে উঠুক।

অন্ধকার ঘরের এক পাশে পর্দা টাঙানো। স্লাইডে একটার পর একটা ছবি ভেসে উঠছিল। আবছায়ার মধ্যেই ডাক্তার থেমে-থেমে বললেন, “বুঝতে পারছি, বিপথগামী স্বামীর প্রতি আপনার ঘৃণার জন্ম হয়েছিল। কিন্তু রাত্রির প্রতি এত রাগের কারণটা ঠিক বুঝতে পারলাম না।”

একটা হালকা নীলাভ আলোকবর্তিকা আবর্তিত হচ্ছিল অন্তরাদেবীর মুখাবয়ব ঘিরে। ডা. চৌধুরী লক্ষ করলেন, ভদ্রমহিলা ভিতর-ভিতর যেন গুছিয়ে নিলেন নিজেকে। তার পর স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে বলতে শুরু করলেন, “সে ছিল অমাবস্যার রাত। পরদিন অর্কর অঙ্ক পরীক্ষা। সকাল-সকাল ওকে স্কুল নিয়ে যেতে হবে বলে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছি মা-ছেলেতে। মদ-টদ গিলে অর্চন কখন বাড়ি ফিরবে তার ঠিক থাকত না।”

একটু যেন শ্বাস নিলেন অন্তরাদেবী। তার পর আবার বলতে শুরু করলেন, “সে দিন রাতে কোনও কারণে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল আমার। বাথরুমে যেতে গিয়ে দেখি, নীচের সিঁড়িঘরে শব্দ হচ্ছে কোনও কিছুর। পা টিপে-টিপে কয়েক ধাপ নীচে নামতেই শরীরটা গুলিয়ে উঠল আমার। এ আমি কী দেখছি! আমাদের নাবালিকা কাজের মেয়েটির সঙ্গে অর্চন...! আমি ভাবতাম নেশা, হতাশা, ব্যর্থতা যা-ই থাক, আমার প্রতি অর্চন সব সময়ই বিশ্বস্ত। আমার এত দিনের বিশ্বাস টুকরো-টুকরো হয়ে গেল। সে দিন থেকেই রাত্রির প্রতি একটা ঘৃণা জন্মাতে লাগল আমার। অবিশ্বাস জন্মে গেল। অন্ধকারের সুযোগ নিয়েই তো অর্চন সম্পর্কটাকে এই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিল।”

শ্বাস ফেললেন ডা. চৌধুরী, “এই বার খানিকটা আলো দেখতে পাচ্ছি মিসেস মিত্র...”

কাতর গলায় অন্তরা দেবী বলে চলেন, “ডাক্তারবাবু, আপনি বলুন না, পৃথিবীর বেশির ভাগ অপরাধ তো অন্ধকারেই সংঘটিত হয়। বেশির ভাগ দাম্পত্য রাতেই ভাঙে, বেশির ভাগ স্ত্রী কিংবা মা চোখের জল ফেলে নিভৃত কোনও রাত্রির কোণে। তাই ধীরে ধীরে রাত জাগতে শুরু করলাম আমি। মনে হত, চাবুক হাতে অন্ধকারকে শাসন করব। পাহারা দেব রাত্রিকে, যাতে ও আর কারও অনিষ্ট করতে না পারে…”

“ওকে ম্যাডাম, আমার কাউন্সেলিং এখানেই শেষ!” ঘরের সব আলো জ্বেলে দিলেন ডা. চৌধুরী।

*****

কত টুকরো-টুকরো স্মৃতি, কত ফেলে-আসা কথা, চিলেকোঠার পাশের অ্যাসবেস্টস দেওয়া ঘরটা খুলতেই অতীত যেন ঘিরে ধরল অন্তরাকে। শরিকি বাড়ি ভাঙার পর তাঁর শ্বশুর-শাশুড়ির ব্যবহৃত জিনিসপত্রগুলো এই ঘরেই ঠাঁই পেয়েছিল। ঝুল, ধুলো, মাকড়সার জালে নারকীয় অবস্থা ঘরটার। কাঠের জানালাটা খুলে দিলেন অন্তরা। পুরনো সময়ের গায়ে হঠাৎ যেন এক রাশ আলো এসে পড়ল। খুশির মুহূর্তগুলো নানা আঙ্গিকে ধরা দিতে লাগল ওঁর কাছে।

ধীরে ধীরে ধাতস্থ হলেন অন্তরা। আলমারির উপরে রয়েছে তোবড়ানো ‘সুরতীর্থ’ সাইনবোর্ডটা। দেওয়ালে রাখা গুরুজির তানপুরাটার দিকে অনেক ক্ষণ একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

ছোট্ট অন্তরা যখন মায়ের হাত ধরে গান শিখতে যেত, তখন গুরুজির অকৃপণ স্নেহ তার উপর বর্ষিত হত। সরগমটা গলায় স্থায়ী ভাবে বসানোর জন্য নানা অভিনব পদ্ধতিতে তিনি ছাত্রছাত্রীদের রেওয়াজ করাতেন। আপাতগম্ভীর ওই গুণী মানুষটার আড়ালে কোথাও যেন একটা বাৎসল্য লুকিয়ে থাকত। নানা অভাব-বঞ্চনার মাঝেও অন্তরার মনে হয় আজ তাঁর একটাই প্রাপ্তি, একটাই গর্ব, তিনি সঙ্গীতজ্ঞ উমাপদ মিত্রর পুত্রবধূ।

‘সুরতীর্থ সঙ্গীত শিক্ষালয়’ লেখা সাইনবোর্ডটা সারিয়ে, রং করিয়ে সদর দরজার উপরে লাগিয়েছেন অন্তরা। সপ্তাহে দু’দিন তিনি ছেলেমেয়েদের গান শেখান। চিলেকোঠার ঘরটাকে ঝাড়পোঁছ করে অন্তরা নিজের সাধনক্ষেত্র তৈরি করেছেন। ডা. চৌধুরীর পরামর্শ মতো বিয়ের আগের সুসময়টাকে তিনি বর্তমানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে নিয়েছেন। অন্ধকার নয়, তাঁর চার দিকে এখন আলোককণারা ঘুরে বেড়ায় শুধু।

ট্রাঙ্ক থেকে পুরনো গানের খাতা খুঁজে পেয়েছেন অন্তরা। সুন্দর হস্তাক্ষরে গুরুজি ওখানে রাগের স্বরবিন্যাস লিখে দিতেন তাঁকে। ভৈরব, কৌশিক, হিন্দোল, দীপক। এ ছাড়া দোতলার বইয়ের র‌্যাকে অন্তরা পেয়েছেন তাঁর নিজের লেখা কবিতার খাতাটা। খাতাটার অধিকাংশ পাতাই এখনও ফাঁকা। অন্তরা ঠিক করেছেন, সাদা ওই পৃষ্ঠাগুলিকে অক্ষরের আলো দিয়ে সাজিয়ে তুলবেন। লিখবেন নিজস্ব কিছু গানের স্বরলিপি।

রাত্রির প্রতি রাগ, অভিমান, যন্ত্রণা দূর হয়ে যাচ্ছে অন্তরার মন থেকে। ডা. চৌধুরীর উপদেশে তিনি বুঝেছেন, অন্ধকার বা রাত্রির পাশাপাশি থাকে আলো বা দিন। অন্ধকারকে দোষারোপ করে লাভ নেই। জরুরি হল নিজেকে আবার আলোর কক্ষপথে ফিরিয়ে আনা; দরকার নতুন দৃষ্টিভঙ্গি, নতুন বোধ নিয়ে জীবনকে অবলোকন।

তাই আলো ফুটতেই ঘুম থেকে উঠে, মুখ ধুয়ে ছাদের ছোট ঘরটায় চলে আসেন অন্তরা। দিনকে আবাহন করেন। তানপুরায় হাত রাখেন। আঙুলের সঞ্চালনে সুরকে আমন্ত্রণ জানান। তমসো মা জ্যোতির্গময়। তাঁর মনের গহন আলোময় হতে থাকে। ভোরের আকাশ কখন যেন সেই সুরের বন্ধনে বাঁধা পড়ে যায়। পাখিরা কলতান শুরু করে। নতুন আলোর পথের দিশারি হয়ে ওঠেন অন্তরা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Short story rabibasariyo
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE