হৃষীদা’র দাবা খেলার নেশা আমায় কাঁদিয়ে ছেড়েছে। ব্যাপারখানা এই রকম— হৃষীদা আর তাঁর স্ক্রিপ্টরাইটার ডা. রাহী মাসুম রেজা সেট-এ দাবা খেলতে বসেছিলেন, তার পর শুটিং শেষ হয়েছে, রাত হয়েছে। যখন পরের দিন কী শুটিং হবে এই নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, দেখা গেল, পরের দিন যে সিন শুট করা হবে সেটা লেখাই হয়নি। কারণ স্ক্রিপ্টরাইটার তো নৌকার চাল দিচ্ছিলেন আর ডিরেক্টর বাজি মাত করার প্ল্যান কষছিলেন। তখন সেই রাতে গুল্লুর খোঁজ পড়ত। হৃষীদা বলতেন, ‘ছোটু, গুল্লুকে দিয়ে সিনটা লিখিয়ে নিয়ে আয় তো।’ ছোটুদা, মানে হৃষীদার ছোট ভাই, ডি এন মুখোপাধ্যায়, আসতেন আমার বাড়ি, আর আমি পরের দিনের সিন লিখতাম রাত জেগে। কখনও বা ভোরবেলায় দরজায় কড়ানাড়া ছোটুদার। বাসি মুখে সিন লিখছি।
স্ক্রিপ্ট নিয়ে খুনসুটি, তর্কাতর্কি, মতের অমিল, সবই চলত, কখনও আমি জিততাম, কখনও হৃষীদা। কিন্তু ওই প্রসেসগুলোই ছিল শিক্ষা। ‘গুড্ডি’র শুটিং চলছে। সিন লেখাও চলছে। ওই সিনেমাটা আবার আমার বেশি প্রিয় ছিল কারণ গুড্ডি আমারই একটা ছোট গল্প। শুটিং চলাকালীন অন্য একটা সিনেমার খুব বড় একটা সেট পুড়ে যায়। হৃষীদা আমায় বললেন, একটা সিন লেখ, যেখানে এক জন স্টিল ফোটোগ্রাফার ধর্মেন্দ্র-র ছবি তুলতে আসে আর ধর্মেন্দ্র বলে, আমার ছবি তুলে কী হবে, এই সব কর্মীদের ছবি তোলো, এই সব স্পট বয়দের ছবি তোলো, যাদের ক্ষতি হল তাদের ছবি তুলে বলো কী অবস্থা এদের। আমি বললাম, ‘হৃষীদা, ভীষণ মেলোড্রামাটিক হয়ে যাবে।’ এক বকুনি লাগিয়ে বললেন, ‘যা বলছি, তাই কর।’ সিন লেখা হল, শুটিং হল, কিন্তু আমি আর ছোটুদা বলতেই থাকলাম, এই সিনটা বাদ দিন, ঠিক যাচ্ছে না সিনেমার সঙ্গে। হৃষীদা শুনলেন না। রিলিজের দিন আমরা একটা শো-এ হলের পেছন দিকে দাঁড়িয়ে দর্শকদের রেসপন্স দেখছি। আমাদের সামনে হৃষীদা। যেই ওই সিনটা এল, দর্শক চেঁচিয়ে বাহবা দিল, হাততালিতে ফেটে পড়ল গোটা হল। হৃষীদা পেছন ফিরে আমার আর ছোটুদার দিকে কটমট করে তাকিয়ে দিলেন।
হৃষীদা স্বাধীনতাও দিতেন প্রচুর। ‘আনন্দ’-এর ডায়লগ লিখছি। আনন্দ প্রথম হাসপাতালে ঢুকছে। আমার মনে হল, ওর চরিত্রটা যেমন, তাতে চুপচাপ ও হাসপাতালে ঢুকে যাবে, এটা ন্যাড়া দেখায়। আমি আনন্দের মুখে একটা ডায়লগ দিয়ে দিলাম, ‘এ মোটু!’ বলে একটা লোককে টিজ করে ও ঢুকে যাচ্ছে। জানতাম ডায়লগটা বাদ যাবে, কারণ একটা মাত্তর ডায়লগের জন্য আবার আর্টিস্ট খোঁজা, তাকে নিয়ে আসা, অনেক ঝামেলা। কিন্তু স্পটে গিয়ে দেখি হৃষীদা শুধু মূল চরিত্রের ফ্লেভারটা আরও ফোটাতে, ঠিক এক জন মোটা মানুষকে নিয়ে এসে শুটিং করছেন।
অথচ, এই হৃষীদা ‘আনন্দ’ সিনেমায় আমার নামটাই টাইটেল কার্ডে দিতে ভুলে গেলেন। রিলিজ করার পর প্রথম আমার বোন আমায় বলল, আমার নাম নেই। ভাবলাম, ওর ভুল হয়েছে। তার পর অন্যরাও একই কথা বলল। এ দিকে শুনতে পাচ্ছি রিলিজের দু-তিন দিনের মধ্যেই ডায়লগ হিট করেছে। মনটা খারাপ হয়ে গেল। কিন্তু নিজে বলতে পারলাম না। অন্য এক জন বললেন আমার হয়ে। তখন সব প্রিন্ট ফেরত এনে আবার আমার নাম ঢোকানো হল।
এ রকম আরও একটা ঘটনা রয়েছে। সেটার জন্য একটা চিনচিনে ব্যথা আমার এখনও রয়েছে। ‘অভিমান’ সিনেমাটা করেছিল অমিত-এর সেক্রেটারি আর জয়া-র সেক্রেটারি, দু’জনে মিলে। সিনেমায় কেউ পারিশ্রমিক নেয়নি। না অমিতাভ, না জয়া, না হৃষীদা। ওরা দুজন যখন এই সিনেমাটা করার কথা বলেছিল, হৃষীদা বলেছিলেন, ‘আমি পুণে যাচ্ছি দশ দিনের জন্য। যদি ফিরে এসে স্ক্রিপ্ট রেডি পাই, তা হলে করব।’ হৃষীদার করার খুব গরজ ছিল না। কারণ আফটার অল সবটাই ফ্রি-তে করতে হচ্ছিল। আমি আর ছোটুদা মিলে খান্ডালায় চার দিন চার রাত জেগে স্ক্রিপ্ট তৈরি করলাম। অথচ এই সিনেমাটার কোথাও আমার বা ছোটুদার নাম নেই। অন্য যাঁদের নাম রয়েছে, তাঁরা কতটা জড়িত ছিলেন, ঠিক বলতে পারব না।
এই হৃষীদার মধ্যেই আবার একটা শিশুসুলভ ব্যাপার ছিল। বিমলদা হয়তো কোনও কাজের জন্য ডেকেছেন, ‘হৃষীইইই...!’ হৃষীদা খুঁড়িয়ে হাঁটতে আরম্ভ করলেন। হৃষীদার একটা পায়ে অবশ্য গাউট ছিল। হৃষীদা খুঁড়িয়ে এগোচ্ছেন বিমলদার দিকে, এমন সময় এক জন বললেন, ‘গাউট তো আপনার বাঁ পায়ে, আপনি তো ডান পা খুঁড়িয়ে চলছেন।’ হৃষীদা তক্ষুনি পা বদলে বাঁ পা খুঁড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলেন।
লন্ডন গিয়েছি হৃষীদার সঙ্গে, একটা তথ্যচিত্র বানানোর কাজে। প্রচণ্ড ঠান্ডা। তার মধ্যে শুটিং। হৃষীদা দেখি রোজ সবার আগে রেডি হয়ে যান। আর গা থেকে ভুরভুর করে সুগন্ধ। কী ব্যাপার হৃষীদা, কী করে এত তাড়াতাড়ি তৈরি হন? ‘কারণ আমি তোমাদের মতো রোজ চান করি না। গায়ে বেশি করে পাউডার দিয়ে নিলেই হয়ে গেল। পাগল যত, এই ঠান্ডায় রোজ কেউ চান করে? আয়ু ক্ষয়ে যাবে হে!’
হৃষীদা খুব কুকুর ভালবাসতেন। পোষা কুকুরকে একেবারে মানুষের মতোই ট্রিট করতেন। এক বার এক জন গিয়েছে হৃষীদার সঙ্গে দেখা করতে। হৃষীদা হেঁকে বললেন, ‘এই একটু চা দিয়ে যাও তো।’ ছেলেটি তাড়াতাড়ি কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, ‘না না ঠিক আছে, আমি চা খাব না।’ হৃষীদা অবাক হয়ে বললেন, ‘আমি তো তোমার জন্য বলিনি। আমার কুকুর খাবে। ও এই সময়টায় রোজ চা খায়।’ এই মানুষটাকে কথার বাঁধুনিতে কি বাঁধা যায়?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy