Advertisement
০৩ মে ২০২৪

সেই খ্যাপাটে সময়টা

বউ আর বাচ্চাদের নিয়ে সিনেমা দেখে সবে বেরোচ্ছেন, লোকটা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ট্রাম্বোর চোখে চোখ রেখে ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তুমিই তো সেই লোকটা, যাকে একটু আগে নিউজ রিল-এ দেখলাম কমিউনিস্টদের হয়ে দালালি করছ?’

শান্তনু চক্রবর্তী
শেষ আপডেট: ১০ এপ্রিল ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

বউ আর বাচ্চাদের নিয়ে সিনেমা দেখে সবে বেরোচ্ছেন, লোকটা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল। ট্রাম্বোর চোখে চোখ রেখে ঝাঁঝালো গলায় জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, তুমিই তো সেই লোকটা, যাকে একটু আগে নিউজ রিল-এ দেখলাম কমিউনিস্টদের হয়ে দালালি করছ?’ ট্রাম্বো থতমত গলায় হ্যাঁ বলতেই, লোকটা হাতের গেলাসের আধ-খাওয়া পানীয়টা ট্রাম্বোর দিকে ছুড়ে দিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, বেইমান! তাঁর পুরু চশমার কাচে, শার্টের গায়ে তরলের বিজবিজে ফোঁটা যেন আধ গেলাস ঘেন্নার মতো ফুটে রইল! ট্রাম্বো, চার হাজার ডলার হপ্তা পাওয়া, হলিউডের সবচেয়ে বেশি রোজগেরে চিত্রনাট্যকার তথা গল্পলেখক, ঔপন্যাসিক ডালটন ট্রাম্বো বুঝতে পারছিলেন, সময়টা খুব হুড়মুড়িয়ে পালটাচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য তো তিনি সেই তিরিশের দশক থেকেই। হলিউড কলাকুশলীদের নানা দাবিদাওয়া নিয়েও তো কবে থেকেই মিটিং-মিছিল করছেন। কিন্তু চল্লিশের দশকের শেষের বছরগুলোয় আমেরিকায় ম্যাকার্থি-রাজের এই ভরা জমানায়, সবটা আর আগের মতো সহজ থাকছে না। ইয়া পরাক্রান্ত মার্কিন রাষ্ট্র নিজের দেশের কয়েক মুঠো কমিউনিস্টদেরও ভয় পাচ্ছে। তাই মার্কিন কংগ্রেসের ‘হাউস কমিটি অন আন-আমেরিকান অ্যাক্টিভিটিজ’! তাই কলেজের ক্লাসঘরে, গবেষণাগারে, নাটকের মঞ্চে, সেনাশিবিরে চিরুনি দিয়ে ডাইনি খোঁজা।

ম্যাকার্থির ইচ্ছেকে জো-হুজুর করে বড় বড় স্টুডিয়োর মাথারা হলিউডে ‘ঘাপটি মেরে থাকা’ কমিউনিস্টদের হাতে না হলেও ভাতে মারার বন্দোবস্ত সেরে ফেলেন। কালো তালিকায় ট্রাম্বো-সুদ্ধ আরও ন’জন অভিনেতা-কাহিনিকার-চিত্রনাট্য লেখকের নাম উঠে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গেই হলিউডের সমস্ত স্টুডিয়োর দরজা তাদের মুখের ওপর বন্ধ হয়ে যায়। এখান থেকেই ছবিটা ঢুকে পড়ে ট্রাম্বোর নিজের গল্পে। তাঁর নিজস্ব ট্র্যাডেজিতে। যেটা কমবেশি তাঁর বাকি ‘কমরেড’দেরও জীবনের গল্প। এবং একটা বিশেষ সময়ের ট্র্যাজেডিও!

‘অ-আমেরিকানসুলভ কাণ্ডকারখানা’র জেরে ট্রাম্বোর শুধু চাকরি যায়নি, তাঁকে জেলেও যেতে হয়েছিল। তাঁর সাধের বাংলো বেচে দিতে হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সংসার চালাতে তাঁকে অন্যের নামে চিত্রনাট্য লিখতে হয়। এমনি করেই তিনি লিখে ফেলেছিলেন হলিউডের চিরকালের জনপ্রিয় ব্লকবাস্টার— ‘রোমান হলিডে’। লেখক হিসেবে নাম যায় তাঁরই এক বন্ধুর। সেরা চিত্রনাট্যকারের অস্কারের ট্রফিটাও তিনিই হাতে নেন। ট্রাম্বো পরিবার ঘরে বসে টেলিভিশনে সে দৃশ্য দেখেন। খেয়ে-পরে বাঁচতে হবে, তাই দিন-রাত এক করে, দু’হাতে লিখে যান সস্তা, বি-গ্রেড ছবির চিত্রনাট্য! সেখানে ‘কেমন লিখেছেন’-এর চেয়ে ‘ক’টা লিখলেন’টাই আসল কথা। আদরের মেয়ের জন্মদিনের কেক কাটার সময়টুকুতেও তিনি বাথটবে শুয়ে লিখে যাচ্ছেন। তাঁর মন ভারী, মেজাজ খিটখিটে হয়ে থাকছে। পরিচালক টানা সরল রেখায় ট্রাম্বোর জীবনের গল্পটা বলে গেছেন। পুরনো নিউজ-রিলের আর্কাইভ ফুটেজের সঙ্গে ছবির জন্য তোলা সাদা-কালো দৃশ্যগুলোকেও মসৃণ মেলানো হয়েছে। সেখানে হলিউডের ‘অ্যাক্টর্স গিল্ড’-এর প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগনকেও কমিউনিস্ট-বিরোধী বক্তৃতা দিতে দেখা যায়!

সিনেমার ক্লাইম্যাক্স-এর মতোই ট্রাম্বোর জীবনের চিত্রনাট্যেও কোথাও ‘পোয়েটিক জাস্টিস’-এর একটা জায়গা থেকে যায়। যে হলিউড তাঁর সম্মান-স্বাধীনতা-রুজি কেড়েছিল, ১৯৭০ সালে তারাই আবার ট্রাম্বোকে সংবর্ধনা দেয়। সেই মঞ্চে বলতে উঠে ট্রাম্বো যখন চল্লিশ-পঞ্চাশের ফেলে-আসা সময়টার দিকে তাকান, তখন কোনও নায়ক, কিংবা ভিলেন, কাউকে তাঁর চোখে পড়ে না— সেখানে সবাই কোনও না কোনও ভাবে আক্রান্ত। সবাই ওই খ্যাপাটে সময়টার শিকার। জাতীয়তাবাদের বেমক্কা জিগির তোলা আজকের ভারতবর্ষে দাঁড়িয়ে আমরাও ভিন দেশ, অন্য সময়ের এই আখ্যানটাকে মোক্ষম চিনে নিতে পারি।

sanajkol@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE