Advertisement
০২ মে ২০২৪

সাধক জমিদারের ভিটেয়

সেই বাড়ির উত্তরপুরুষরা দেশভাগের পরেই পালিয়ে এসেছিলেন একবস্ত্রে। কিন্তু শ্রীহট্টের গ্রামে সেই সাধক জমিদারের বাড়ি, ভোলাগিরির মন্দির এখনও অটুট। সামরিক শাসন, একাত্তরের যুদ্ধ এবং জামাত-জমানা সেখানে বিন্দুমাত্র আঁচড় কাটতে পারেনি।তারই ফাঁকে খাঁটি সিলেটিতে আগন্তুকের সঙ্গে টুকরো টুকরো কথোপকথন।

স্মৃতিময়: তুলসীমঞ্চ, একচালা মাটির ঘর।

স্মৃতিময়: তুলসীমঞ্চ, একচালা মাটির ঘর।

অগ্নি রায়
সিলেট শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ২৩:৪৬
Share: Save:

অন খোনোদিন অত্যাচার অইছে না বা!’ (এখানে কোনও দিন অত্যাচার হয়নি)। বলছেন এক গাঁয়ের বধূ। নিয়মিত পূজা পাওয়া প্রাচীন বাসুদেব, ভোলানন্দগিরি এবং অধুনা প্রায়-পরিত্যক্ত এক শিবমন্দির থেকে প্রায় সমদূরত্বে টলটল করা ‘পদ্মপুকুর’-এ মন্দিরের বাসন ধুতে এসেছেন তিনি। তারই ফাঁকে খাঁটি সিলেটিতে আগন্তুকের সঙ্গে টুকরো টুকরো কথোপকথন।

শ্রীহট্ট তথা সিলেট শহর থেকে প্রায় আড়াই ঘণ্টা ঢাকা-সিলেট হাইওয়ে ধরে এসে হবিগঞ্জের পেট্রোল পাম্প ছাড়িয়ে মীরপুর মোড় থেকে বাঁ দিকে নেমে তুঙ্গেশ্বর গ্রামের পথে যাওয়া কার্যত আলপথ ধরেই। শীতের নরম রোদে নিজেকে সেঁকতে সেঁকতে যার দু’পারের দিগন্তকে চুমু খাচ্ছে ধানখেত। দশ কিলোমিটার আগে থেকেই তুঙ্গেশ্বর এবং তার ‘মাসো (মহাশয়) বাজার’ এবং ‘মাসো বাড়ি’-র সন্ধান দিচ্ছে মাঠ-ফেরত চাষি, হাটুরে, জনতার মশগুল আড্ডা। যে বাড়ি, বিরাট জমিদারি ছেড়ে প্রাণরক্ষার্থে স্বাধীনতার কিছু পরে কলকাতা চলে এসেছিলেন এই গ্রামের ‘মাসো’ বা সাধক-জমিদার বংশ। ঘটনাচক্রে এক বারের জন্যও ফিরে যেতে পারেননি নিজেদের ভিটেমাটির কাছে।

কিন্তু আজ এত বছর পরেও সেই গ্রাম, এবং জমিদারদের ঘরবাড়ি, মন্দির, পুকুর, জমি রয়ে গিয়েছে। অবশ্যই পুরোপুরি অক্ষত নয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ধসে গিয়েছে অনেকটাই। কিন্তু যে সেবাইতের হাতে সব ছেড়ে চলে এসেছিলেন, সেই জমিদার সেনমজুমদার পরিবারই বংশানুক্রমে রক্ষা করেছেন ভিটেমাটি। ‘‘উত্তাল সামরিক শাসন, জামাত জমানা এবং একাত্তরের সেই মরণপণ যুদ্ধের সময় আমরা সব আগলে রাখতে পেরেছিলাম। বড় কোনও বিপদ হয়নি কারও।’’ জানালেন সেবাইত পরিবারের রাজেন্দ্র চক্রবর্তী। ‘‘জমিদারদের ভিটেতে গত ৫০ বছরের উপরে বাস করছি আমরা। কিন্তু কোনও দলিল নেই আমাদের কাছে। ওরা শুধু পঞ্চাশের গোড়ায় চলে যাওয়ার আগে আমার বাবাকে বলেছিল, সব দেখে রেখো। আজও সেই দেখে চলেছি। মৃত্যু অব্দি ছাড়ান নেই।’’

সিলেটের গ্রামে ফেলে-আসা বাস্তুভিটে

এই গ্রাম বাংলাদেশের আরও অজস্র প্রাচীন সংখ্যালঘু মানুষের গ্রামের বিষণ্ণ ইতিহাসকেই বুকে ধরে রেখেছে যেন। ও পার থেকে মানুষ এলে পঞ্চমে যার স্বর বেজে ওঠে। আর কেঁপে উঠতে থাকে একচালা মাটির ঘর, মলিন জীর্ণ তুলসীমঞ্চ, ভেঙে যাওয়া মন্দির। বাংলাদেশের আরও অজস্র প্রাচীন সংখ্যালঘু জনপদের প্রজন্মবাহিত কথা যেন এখানকার বাতাসে মিশে। তুঙ্গেশ্বরে যেমন এখনও মানুষের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে সাত পুরুষ আগের সেই শক্তির উপাসক এবং সিদ্ধপুরুষ হরিশরণ সেন মজুমদারের নাম। জাহাঙ্গিরের পাঞ্জার সিলমোহর-সহ এই তুঙ্গেশ্বরের জমিদারির যে সাধক পুরুষ আজও এখানে পরম আরাধ্য।

‘‘গোটা গ্রাম খানসেনারা ঘিরে ফেলেছিল একাত্তরে। রোজ রাতে ভাবতাম বুঝি আজই আগুন লাগিয়ে দেবে। পাকিস্তানের মিলিটারির বুটের শব্দ এই মীরপুর পর্যন্ত শোনা যেত। কিন্তু কী আশ্চর্য, মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা মানুষের গায়েও (প্রায় পাঁচশো পরিবাররে ভিটে এখানে) আঁচড়টি কাটতে পারেনি আমাদের গ্রামে,’’ জানালেন এক বাসিন্দা, গোবিন্দ কর্মকার। এখনও মোটামুটি অটুট রয়েছে হরিশরণ সেন মজুমদারের সমাধিস্থলের উপর শিবমন্দিরটিও, যার বয়স ছাড়িয়েছে সাড়ে তিনশো। ‘‘শুধুমাত্র কষ্টিপাথর ভেবে শিবলিঙ্গটা ভিতর থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ওরা,’’ জানাচ্ছেন গোবিন্দবাবু।

মুসলমানপ্রধান জেলা সিলেট। হবিগঞ্জ থেকে মীরপুরে এক সময়ে বিএনপি-র আধিপত্য ও প্রভাবও ছিল বিস্তর। সদ্য-সমাপ্ত নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ঝড়েও এখান থেকে দুজন বিএনপি-জোট প্রার্থী জিতেছেন। রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, এখানে সশস্ত্র জামাতের চোরাগোপ্তা ঘাঁটি বড় হেলাফেলার নয়। কিন্তু এই ‘মাসো বাড়ি’ বরাবরই মনে রাখে সেই সিদ্ধপুরুষ হরিশরণের কীর্তিকে। পার্শ্ববর্তী সুরমা অথবা খোয়াই নদীতে নৌকা ঝড়ের মুখে পড়লে ‘হরিশরণের দোহাই’ বলে বিপদ থেকে ত্রাণ পেয়েছে মানুষ, এমন সব কথা ও কাহিনি মুখে মুখে ফেরে।

এই সিলেটেরই সন্তান সৈয়দ মুজতবা আলীকে অল্প বয়সে প্রথমবার দেখে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ওহে, তোমার মুখ থেকে তো কমলালেবুর গন্ধ বেরোচ্ছে! কমলালেবুর জন্য বিখ্যাত ছিল সিলেট, আর আলিসাহেবের বাংলায় ছিল কাঠ সিলেটি টান, যার মর্মোদ্ধার করা ঢাকার বাঙালের পক্ষেও মুশকিল! সিলেট শহর থেকে তুঙ্গেশ্বর সফরনামায় দুজন সঙ্গী জুটে যাওয়ায় শোনা গেল গ্রামের এই সব গল্পের টুকরো। হরিশরণের চতুর্থ প্রজন্ম নীরদচন্দ্র সেনমজুমদার (যিনি দেশভাগের পর কলকাতায় চলে আসেন) সান্নিধ্যে আসেন পঞ্জাবের শৈবসাধক ভোলানন্দ গিরির। ভোলানন্দ গিরি নিজেই এই পরিবারের সাধনখ্যাতির কথা শুনে বাংলায় এসে আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন জমিদার নীরদচন্দ্রের। তিনি প্রয়াত হওয়ার পর তাঁর একটি মন্দিরও বানিয়েছিলেন নীরদচন্দ্র। সেখানে আজও প্রতিদিন পূজা হয়। মন্দির প্রাঙ্গণেই এখন একটি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাকেন্দ্র খুলেছে হিন্দু ধর্মীয় কল্যাণ ট্রাস্ট।

দেশভাগের সময়েই শুকিয়ে গিয়েছিল এই মাসো বাড়ির গৌরব। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় এই পরিবার দেশ ত্যাগ করার কিছু আগে এখানে দুর্গাপুজো চালু ছিল। জমিদারবাড়ির এক জামাই শিবপদ সেন কলকাতা থেকে এসেছিলেন পুজো দেখতে। তাঁর চিঠিতে রয়েছে— ‘বেশিরভাগ হিন্দু গ্রাম ছেড়ে চলে গিয়েছে। বাদবাকি যারা আছে তাদের বেশিরভাগ বৃদ্ধ আর শিশু, প্রৌঢ়া কিংবা বিধবা। তাদের স্বপ্নের হাসি নিভে গিয়েছে। কথায় কথায় তাদের চোখ ছলছলিয়ে ওঠে। ভবিষ্যতের কোনও হাতছানি নেই। অতীত গৌরবের জাবরকাটা দিনগুলি দ্বিধায়–দুর্বলতায় অনিশ্চিত আশঙ্কায় হোচট খেতে খেতে এগিয়ে চলে। তাদের গৌরব ছিল এই মাসোর বাড়ি। তাদের আশাভরসা ছিল এই মাসোর বাড়ি।’

এই চিঠির সময়কাল প্রায় সত্তর বছর অতিক্রান্ত। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বয়সও প্রায় পঞ্চাশ ছুঁই-ছুঁই। ধর্মনিরপেক্ষতার শপথ নেওয়া শেখ হাসিনা সরকারেরও তৃতীয় পর্যায় শুরু হল। কিন্তু সিলেটের এই তুঙ্গেশ্বর গ্রামে এখনও তো কোনও উন্নয়নের ছোঁয়া দেখলাম না। প্রাণ যায়নি বা সরাসরি অত্যাচার হয়নি এখানে কারও উপর বরাতজোরে, কিন্তু এত বছর পরেও আশার আলোও তো বিশেষ দেখা গেল না।

এই দৃশ্য কি বাংলাদেশের আতঙ্কপীড়িত, দরিদ্র সংখ্যালঘুদের গ্রামের একটি চুম্বকদৃশ্য নয়? ফেরার পথকে বিষণ্ণতর করল এই প্রশ্ন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sylhet
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE