Advertisement
১০ মে ২০২৪

একলা পাগল

শেক্সপিয়রের মৃত্যুর ৪০০ বছর নিয়ে এত হইহই, স্পেনের মহালেখক সের্ভান্তেসের মৃত্যুর ৪০০ বছর নিয়ে পৃথিবী চুপ। কেন?স্পেনের পার্লামেন্টে সম্প্রতি বিরোধী দলের বিশাল অভিযোগ: সর্বকালের সেরা স্প্যানিশ লেখক মিগেল দে সের্ভান্তেস-এর মৃত্যুর ৪০০ বছর চলছে, অথচ সরকারের গা-ই নেই! ও দিকে শেক্সপিয়রের মৃত্যুরও চারশো বছর চলছে, তা নিয়ে ইংল্যান্ডে হুলুস্থুলু স্মরণোৎসব! খোদ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা দিচ্ছেন শেক্সপিয়রের ভাষার ব্যবহার নিয়ে!

দন কিহোতে নিয়ে ছবি করতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা বিষয়ে টেরি গিলিয়াম করেছেন তথ্যচিত্র। তার পোস্টার।

দন কিহোতে নিয়ে ছবি করতে পারেননি। সেই ব্যর্থতা বিষয়ে টেরি গিলিয়াম করেছেন তথ্যচিত্র। তার পোস্টার।

শিশির রায়
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৬ ০০:০৩
Share: Save:

স্পেনের পার্লামেন্টে সম্প্রতি বিরোধী দলের বিশাল অভিযোগ: সর্বকালের সেরা স্প্যানিশ লেখক মিগেল দে সের্ভান্তেস-এর মৃত্যুর ৪০০ বছর চলছে, অথচ সরকারের গা-ই নেই! ও দিকে শেক্সপিয়রের মৃত্যুরও চারশো বছর চলছে, তা নিয়ে ইংল্যান্ডে হুলুস্থুলু স্মরণোৎসব! খোদ ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী সংসদে বক্তৃতা দিচ্ছেন শেক্সপিয়রের ভাষার ব্যবহার নিয়ে! আর, যিনি কিনা হাতে ধরে স্প্যানিশ ভাষাটাকে দাঁড় করালেন, সেই ১৬০৫-এ লিখে ফেললেন বিশ্বের প্রথম ‘মডার্ন নভেল’ যা কিনা বাইবেলের পরেই দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত বই, সৃষ্টি করলেন এমন এক চরিত্র যা এত যুগ পরেও স্নব থেকে মব সক্কলের মগজে মনে টাট্টুঘোড়া ছোটাচ্ছে, সেই সের্ভান্তেসের স্মরণ নেহাত দায়সারা নমো নমো?

দুই জমানার খেলোয়াড় হলেও লোকে তেন্ডুলকর আর কোহালির মধ্যে তুলনা করে, আর এ তো সমসময়ের দুই য়াব্বড় লেখক বলে কথা! শুধু শেক্সপিয়র ‌লিখছেন ইংল্যান্ডে, লন্ডন আর স্ট্র্যাটফোর্ডে বসে, আর সেরভান্তেস স্পেনে। কখনও মাদ্রিদে, কখনও উড়নচণ্ডী জীবন যেখানে উড়িয়ে নিয়ে ফেলেছে, সেই সব আন-শহরে। আর বাউন্ডুলে জীবনও একখানা! শেক্সপিয়র ‌যেখানে খোদ রানির (পরে রাজার) আশ্রয়-প্রশ্রয়ে, নিজের ব্যবসার লাভের গুড় খেয়ে নিশ্চিন্ত পয়সাওলা পেজ-থ্রি জীবন কাটাচ্ছেন, সেখানে সের্ভান্তেস? নেভিতে যোগ দিয়ে যুদ্ধে যাচ্ছেন, গুলিতে বাঁ হাত খুইয়ে প্রায়-নুলো, জলদস্যুদের হাতে পড়ে পাঁচ বছর আলজিয়ার্সে পড়ে আছেন বন্দি ক্রীতদাস, অন্যের দয়ার দান মুক্তিপণে নবজীবন ফিরে পেয়ে মাদ্রিদে ফেরত। কিছু দিন নাটক কবিতা লিখেটিখে দেখছেন ধুস এ-সব আমার দ্বারা হওয়ার নয়, তাই কাজ নিচ্ছেন ট্যাক্স ইন্সপেক্টরের, কেননা হেঁ-হেঁ, ওতে কাঁচা পয়সা আর উপরি, দুই-ই বহুত। আর কান টানলেই মাথার ইনস্ট্যান্ট হাজিরার মতো তাঁর চাকরির ল্যাজে ল্যাজে আসছে বেহিসাব, দুর্নীতি, দেনার অপবাদ-বদনাম, যার জেরে এমনকী জেল! বোহেমিয়ান জীবনে দারিদ্র নিত্যসঙ্গী, ১৬১৬ সালে যখন মারা যাচ্ছেন, উনি কানাকড়িহীন খিটখিটে লোক। এই পার্ট-টাইম লেখকের সঙ্গে চকচকে কেরিয়ারিস্ট উইলিয়াম শেক্সপিয়রের তুলনা? হয়?

হয়তো উচিত নয়, কিন্তু অবধারিত তুলনা চলেও আসে, ওঁরা দুজন ইংরেজি আর স্প্যানিশ এই দুই ভাষা-সাহিত্যের দুই লাইটহাউস বলে। দাঁড়িপাল্লার এক দিকে যদি হ্যামলেট, লিয়ার, ম্যাকবেথ, ওথেলো আর দুর্দান্ত বুদ্ধিমান ভাঁড়েদের চাপাই, অন্য পাল্লায় সের্ভান্তেসের পাগলা নাইট ‘দন কিহোতে’ আর তাঁর শাগরেদ সাঞ্চো পান্‌সা চুপচাপ দাঁড়িয়ে পড়লে দেখা যাবে, দু’দিকই সমান ওজনদার। অথচ, ১৫৪টা সনেট, অন্তত ৩৮টা নাটক ভর্তি শেক্সপিয়রের ‌রচনাবলির পাশে, সের্ভান্তেসের দু’খণ্ডী উপন্যাস ‘দন কিহোতে’ আর খান বারো গল্প, কিছু কুচো পদ্য ও খুচরো নাটকওলা অমনিবাস আদৌ নজরই কাড়বে না। কেন তবে পুঁছব?

কারণ: ওই এক ‘দন কিহোতে’ লিখেই সের্ভান্তেস তামাম বিশ্বসাহিত্যকে তাঁর কেনা গোলাম করে রেখেছেন। লা মাঞ্চা-র ওই একটা সাধারণ মানুষ আলোন্সো কিহানো, মধ্যযুগের নাইটদের হিরোপনা নিয়ে লেখা কাঁড়ি বই পড়ে যে নিজেকেই দেখছে এ যুগের মসিহা রূপে, আর ঘোড়ার পিঠে পথে বেরিয়ে দেখছে এই পৃথিবীটা জঞ্জাল-দুর্নীতি-অপরাধ-শোষণে কিলবিল, আর ভাবছে আরে, এই আমিই তো ধর্মসংস্থাপনার্থায় এই যুগে সম্ভবেছি! ওই সামনে যেগুলো সে তো লোকে দেখছে উইন্ডমিল আর আমি দেখছি সাঁইসাঁই শত্রু, পথের ধারে নিরীহ সরাইখানা দুর্ভেদ্য দুর্গ বনে যাচ্ছে আমার কাছে, আমি মনে করছি ওই সুন্দরী মেয়েটা ভয়ংকর বিপদে পড়েছে আর এই আমাকেই হয়ে উঠতে হবে ওর রক্ষক, বাক্সবন্দি সিংহকে ছেড়ে দিতে বলছি কারণ আমি চাই ওর সঙ্গে লড়ে জিততে আর অমন হিংস্র জন্তুটাও কে-জানে কী কারণে আমায় ছুঁয়ে না দেখলেও ধরে নিচ্ছি যাযাঃ, কেমন জিতে গেলুম!

ঠিক এইখানটাতেই সের্ভান্তেস হয়ে ওঠেন মানবচরিত্রের এক স্পট-অন ভাষ্যকার। দন কিহোতে-কে সমাজ দেখে এক বদ্ধ উন্মাদ হিসেবে, দুয়ো দেয়, খুব মারে। কেউ বোঝে না, এই স্বঘোষিত নাইটের কৃৎকৌশল ভুল হতে পারে, কিন্তু আদর্শের প্রতি সে প্রশ্নাতীত তন্নিষ্ঠ। আর কে না জানে, চারপাশের দুনিয়াটা আসলে খুব স্থিতাবস্থা-প্রেমী, সবাই চায় সরকার থেকে সিরিয়াল সব যেমন চলছে চলুক, তাই যখন ‘নবযুগনায়ক এনু’ বলে কেউ ভুলগুলো শোধরাতে পথে নামে, সমাজের খুব অস্বস্তি হয়। নেমে আসে সমষ্টির চাবুক: ও ‘অন্য রকম’, ও পাগল, হেসে ওড়া ওকে, নিন্দের শূলে চড়া! সেই আঘাত সবাই সইতে পারে না। দন কিহোতেও যেমন গল্পের শেষে নিঃসঙ্গ একাকী মরে যায়। আর এই সত্য নিয়ে মরে: সে আসলে নাইট নয়, সমাজ-সংস্কারক নয়, সে কিস্যু নয়। বরং ঢের বাস্তববাদী তার স্যাঙাতটি, সাঞ্চো পান্‌সা, যে স্রোতের সঙ্গে ভাসতে জানে, পরিবর্তনের জমানায়ও হাসতে জানে। কিন্তু তা হলে সত্যিই জিতল কে? আগাগোড়া সূক্ষ্ম স্যাটায়ার আর বোদা ভাঁড়ামোর পেঁয়াজ-পরতগুলো ছাড়াতে ছাড়াতে সের্ভান্তেস আমাদের দাঁড় করিয়ে দেন এই অমোঘ প্রশ্নে। মৃত্যুর চারশো বছর পরেও।

iwritemyright@gmail.com

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lost in La Mancha Robibashoriya Shishir Roy
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE