সুইডেনের রাজার হাত থেকে অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার নিচ্ছেন অমর্ত্য সেন। ১০ ডিসেম্বর ১৯৯৮। ছবি: এএফপি
অধ্যাপক অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার নিতে যাচ্ছেন সুইডেনের স্টকহল্মে, সঙ্গে তাঁর স্ত্রী এমা রথসচাইল্ড। একই বিমানে একটু দূরে বসে দেখছি, গভীর মনোযোগে ল্যাপটপে নোবেল লেকচার লিখতে লিখতে চলেছেন।
অনেক বছর ধরেই শুনতে পাচ্ছিলাম, এ বারে হয়তো অমর্ত্য সেন অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পাচ্ছেন। যখন খবরটা সত্যি হল, অমর্ত্যদা আমেরিকা থেকে তাঁর মা, অমিতা সেনকে ফোন করলেন। অমিতাদি বিশ্বাস করলেন না, বললেন, কই, দূরদর্শনের খবরে তো বলল না! অমিতাদি আমাকে অল্প বয়স থেকেই খুব স্নেহ করতেন। তিনি নিয়মিত দূরদর্শনের অনুষ্ঠান দেখতেন। প্রথমে অমর্ত্যদার নোবেল পুরস্কারের খবরটা যে বিশ্বাস করেননি, সেটা অমিতাদিই আমাকে বলেছিলেন।
নোবেল পাওয়ার অনেক বছর আগেই অমর্ত্যদার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম আমি। আর এক বার স্বপন মজুমদারকে দিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার রেকর্ড করেছিলাম আমরা। দু’বারই তিনি ওঁর প্রতীচী বাড়ির বারান্দায় বসে আমাদের সঙ্গে কথাচারিতায় বলেছিলেন, তিনি মনে করেন, পৃথিবীর বিভিন্ন এগিয়ে-থাকা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থাকে গ্রহণ করেছে, এখনকার বিশ্বভারতীর উচিত সেগুলো সম্পর্কে সচেতন হওয়া। অমর্ত্যদার একটা অহংকার যে তিনি শান্তিনিকেতনে জন্মেছেন। স্টকহল্মে নোবেল নেওয়ার পর সেখানে বসবাসরত বাংলাদেশের মানুষরা তাঁকে সংবর্ধনা দিলেন, তখন উত্তরে বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে জন্মাননি কিন্তু আমি শান্তিনিকেতনে জন্মেছি।
অমর্ত্যদার ছেলেবেলার সন্ধানে আমরা ঢাকাতেও গিয়েছিলাম। সেখানে যে-বাড়িতে তিনি বাবা-মা’র সঙ্গে থাকতেন, স্কুলে যে ক্লাসঘরে বসতেন, সে-সব যেমন শুটিং করে আনি, তেমনই অমর্ত্যদার নোবেল প্রাপ্তিতে ঢাকার মানুষের প্রতিক্রিয়াও রেকর্ড করি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়েও গিয়েছিলাম তাঁর সহকর্মীদের মতামত জানতে। তখন সেখানে বেশ কয়েক জন নোবেল লরিয়েট তাঁর সহকর্মী। এক ভারতীয় অর্থনীতির অধ্যাপকের সঙ্গে কেমব্রিজে কথা হল। বলেছিলেন, অমর্ত্যদা ছাত্রজীবন থেকেই খুব প্রমিনেন্ট ছিলেন। এক জন তুখড় ডিবেটার হিসেবে তখনই তাঁর কথা সবার মুখে মুখে ফিরত। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর জীবনযাত্রা আমি ফিল্ম করে আনি।
লন্ডনে অমর্ত্যদার বন্ধুরা ছড়ানো। তাঁদের সঙ্গেও দেখা করি, সাক্ষাৎকার নিই। অমর্ত্যদার জীবনের নানা দিক নিয়ে খুব প্রশংসাসূচক কথা বলেছিলেন ওঁরা। কিন্তু যখন ওঁর সাংবাদিক বন্ধুদের জিজ্ঞেস করি, এখানকার কোনও মিডিয়াতে অর্মত্য সেনের নোবেল প্রাপ্তির কোনও খবর নেই কেন, তিনি ভারতীয় নাগরিক বলেই কি না, তার উত্তরে তাঁরা একেবারে নীরব ছিলেন।
তখন কলকাতা দূরদর্শনের ডিরেক্টর ছিলেন অরুণ বিশ্বাস। তিনি আমাকে বললেন, আপনি তো অমর্ত্য সেনের পরিবারকে জানেন, দেখুন তো কিছু করতে পারেন কি না! অমর্ত্যদাকে কেমব্রিজে ফোন করলাম, তিনি সেখানে নেই। নানা জায়গায় খোঁজ করতে লাগলাম। কেউ কিছু বলতে পারছে না। হঠাৎ এমার সঙ্গে যোগাযোগ হয়ে গেল। জানলাম, অমর্ত্যদা নিউ ইয়র্কে। যে হোটেলে আছেন তার নম্বর নিলাম, কিন্তু উনি হোটেলে নেই, কোনও টিভি স্টুডিয়োতে গেছেন সাক্ষাৎকার দিতে। এর মধ্যে খবর পেলাম, অমর্ত্যদার বোন মঞ্জুদির স্বামী মারা গেছেন। এত ব্যস্ততার মধ্যে কি উনি খবরটা পেয়েছেন? ভাবলাম, এই খবরটা নিয়েই আমাকে ঢুকতে হবে। ‘মিডিয়া থেকে বলছি’ শুনলে তো ফোনটা অমর্ত্যদাকে দেবে না। ওই শহরের নানান টিভি সেন্টারের নম্বর সংগ্রহ করে ফোন করতে লাগলাম। একটা টিভি নেটওয়ার্কের অফিসে বলল, হ্যাঁ, তিনি আছেন, কিন্তু রেকর্ডিং-এ। বললাম, একটা ডেথ নিউজ দেওয়ার আছে। রেকর্ডিং বন্ধ করে তাঁরা অমর্ত্যদাকে লাইন দিলেন। উনি লাইন ধরেই বললেন, ‘আর ইউ ইন নিউ ইয়র্ক?’ বললাম, না, কলকাতা থেকে বলছি। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি নোবেল পাওয়ার খবর কখন পেলেন? বললেন, ‘ভোর সাড়ে পাঁচটায় স্টকহল্ম থেকে ফোন এল।’ আপনার কি কোনও ইন্টারভিউ ব্রডকাস্ট বা টেলিকাস্ট হয়েছে? ‘না, এই তো প্রথম একটা টেলিভিশন স্টুডিয়োতে এলাম, এখন রেকর্ডিং চলছে।’ নোবেল পাওয়ার পর তাঁর প্রতিক্রিয়া নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করলাম। শেষে অনুরোধ করলাম: আপনার কাছে ইংরেজিতে একটু জানতে চাই। বললেন, ‘হোয়াট! আর ইউ রেকর্ডিং?’ বললাম, হ্যাঁ, বুঝতেই পারছেন এখানে কী ভীষণ আলোড়ন। ইংরেজিতেও আমার নানা প্রশ্নের উত্তর দিলেন। রেকর্ডিং শেষ হওয়ামাত্র দূরদর্শনে তখন যে-অনুষ্ঠানটি প্রচারিত হচ্ছিল, সেটি বন্ধ করে জরুরি ভিত্তিতে অমর্ত্য সেনের সাক্ষাৎকার প্রচার করে দেওয়া হল। ফলে ওটাই হল অমর্ত্য সেনের নোবেল পুরস্কার পাওয়ার পর পৃথিবীর যে কোনও মিডিয়ার মধ্যে তাঁর প্রথম ইন্টারভিউ প্রচার।
কথা হল সামনাসামনি অমর্ত্যদার ইন্টারভিউ নেওয়ার জন্য কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ার। ফোন করলাম। বললেন, ‘আমি এখন খুব ব্যস্ত। নোবেল লেকচারও লেখা হয়নি। তুমি বরং সুইডেনে এসো, ওখানে নোবেল সেরিমনির জন্যে তো কয়েক দিন থাকব।’ কিন্তু নোবেল সেরিমনি অ্যাটেন্ড করার প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র তো সংগ্রহ করা হয়নি, আর বেশি সময়ও নেই। বললেন, ‘আমি তোমায় পার্সোনাল গেস্ট করে নেব।’ লন্ডন চলে গেলাম। ওঁর সঙ্গে একই ফ্লাইটে সুইডেন গেলাম। নোবেল সেরিমনির পরে কেমব্রিজে গিয়েছিলাম অমর্ত্যদার কাছে।
স্টকহল্ম-এ সুইডিশ টেলিভিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করে, শুটিং করার জন্যে ক্যামেরা টিমের ব্যবস্থা করলাম। নোবেল প্রদান অনুষ্ঠান সে বার দূরদর্শনে সরাসরি দেখানো হয়, যেহেতু অমর্ত্য সেন নোবেল পেয়েছেন। এর মধ্যে দেশে কেউ কেউ বিতর্ক তুলেছিলেন, অর্থনীতির নোবেল পুরস্কার প্রকৃত নোবেল পুরস্কার নয়। এ নিয়ে পার্লামেন্টেও প্রশ্ন ওঠে। অমর্ত্যদাকে এ সব কিচ্ছু না বলে আমি হিথরো এয়ারপোর্টে ওঁকে অনুরোধ করলাম, নোবেল কমিটির কোনও কর্তাব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতে, ইন্টারভিউ করব। স্টকহল্ম এয়ারপোর্টে রয়্যাল সুইডিশ অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস— যে প্রতিষ্ঠান নোবেল দেয়— তার কর্মকর্তা, ড. আর্ল নরবি এলেন অমর্ত্যদাকে রিসিভ করতে। অমর্ত্যদা আলাপ করিয়ে দিলেন। পর দিনই তাঁকে ইন্টারভিউ করলাম। মূল প্রশ্ন ছিল, এটা প্রকৃত নোবেল প্রাইজ কি না। তিনি বললেন, যদিও অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার দেওয়া পরে শুরু হয়েছে, কিন্তু এটা অ্যাকচুয়াল নোবেল প্রাইজ। একই দিনে, একই স্টেজে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
এই ইন্টারভিউ রেকর্ডিং-এর ক্যাসেট দিল্লিতে পাঠানোর জন্য সারা রাত ধরে চলল লড়াই। স্টকহল্ম থেকে দিল্লির কোনও সরাসরি ফ্লাইট নেই। প্যারিসের ফ্লাইট বুক করলাম, সেখান থেকে দিল্লির ফ্লাইটে তোলা হবে। এয়ারপোর্টের লোকেদের ভুলে প্যারিসের ফ্লাইট মিস হল। কোথাও ফ্লাইট মিস হচ্ছে তো কোথাও স্টোরে ক্যাসেট পড়ে থাকছে। সারা রাত ধরে অনেক চেষ্টায় বিভিন্ন এয়ারপোর্টের লঙ্গে যোগাযোগ করে করে ফ্র্যাংকফার্ট, লন্ডন হয়ে দিল্লিতে ক্যাসেট পৌঁছল। আমার দুই সহকর্মী শর্মিষ্ঠা দাশগুপ্ত ও চম্পা ভৌমিক দিল্লিতে অপেক্ষা করছিলেন। বহু চেষ্টা করে তাঁরা দূরদর্শনের সর্বভারতীয় চ্যানেলে ইন্টারভিউটি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করলেন। ওই ইন্টারভিউ প্রসঙ্গ নিয়ে পার্লামেন্টে আলোচনার পর বিতর্ক থামল। সুইডেন থেকে অমর্ত্যদার ইন্টারভিউ এবং নোবেল সেরিমনির আরও যে-সব রেকর্ডিং পাঠিয়েছিলাম, সেগুলোও দিল্লি এবং কলকাতা দূরদর্শন থেকে সম্প্রচারিত হল।
সব কিছুর মধ্যেই লক্ষ করেছি, অমর্ত্যদা একেবারে শান্ত, সংহত। নোবেলের মতো এমন পুরস্কার পাওয়ার পরেও কোনও উত্তেজনা, উদ্বেলতার লক্ষণ তাঁর মধ্যে দেখিনি।
pankajsaha.kolkata@gmail.com
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy