পথেঘাটে, মন্দিরে ওদের অবাধ বিচরণ। সার্কাসের খেলা দেখানোর মতো তরতর করে হেঁটে চলে যায় এক চিলতে দড়ির উপর দিয়ে। কেউ একটু অন্যমনস্ক হলেই, হাত থেকে ছোঁ মেরে নিয়ে চলে যায় খাবার। কেরলের বিভিন্ন পর্যটনকেন্দ্রে বড় বড় করে বিজ্ঞপ্তি লাগানো, ওদের গতিবিধি সম্পর্কে পর্যটকদের সতর্ক করে। পেরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের অতিথিশালার ঘরের দরজাতেও সাঁটা বিশেষ বিজ্ঞপ্তি, ‘অবাঞ্ছিত অতিথি’দের থেকে সাবধান! ঘরের জানালা খোলা রাখবেন না। হাতের সামনে যা পাবে চুরি করে নিয়ে যাবে।
বাঁদরদের দৌরাত্ম্য ভারতের প্রায় সব তীর্থস্থানেরই বৈশিষ্ট্য। চেহারায় তারা কিছুটা উনিশ-বিশ, কিন্তু স্বভাবে সবাই এক। তবে দক্ষিণ ভারতের লালমুখো বাঁদর ‘বনেট ম্যাকাও’রা বেশ বেপরোয়া। পেরিয়ার ব্যাঘ্র প্রকল্পের অতিথিনিবাসের সামনে দাঁড়িয়ে কলকাতার এক পর্যটক দলের ম্যানেজার অমিত মৈত্র এই বাঁদরকুলের দুরন্তপনার কথা শুনিয়ে পর্যটকদের সতর্ক করছিলেন। ক্যামেরা বাঁচাতে গিয়ে কী ভাবে এক অসতর্ক পর্যটককে বাঁদরের কামড় খেতে হয়েছিল, সেই বিবরণ দিচ্ছিলেন।
বিকেলে কিন্তু ওই ‘অসভ্য’ বাঁদরকুলেরই এক ‘সভ্য’ সদস্যকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। গায়ের রং কালো— শিম্পাঞ্জির মতো, তবে অনেক বেশি উজ্জ্বল। মাথা ভর্তি হালকা সোনালি চুল। মুখটা কালচে। লেজ অনেকটা বড়। শরীর ৮০ সেন্টিমিটার, সঙ্গের লেজটা আরও ৮০ সেন্টিমিটার। উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গলে থাকা ‘হুলক গিবন’-এর সঙ্গে চেহারায় মিল আছে ওদের। তবে উত্তর-পূর্বের ওরা গিবন প্রজাতির, হাত-পা খুব লম্বা। আর দক্ষিণ ভারতের নীলগিরি পার্বত্য এলাকার জঙ্গলের এরা ‘লাঙ্গুর’ (হনুমান) প্রজাতির। এদের নাম ‘নীলগিরি ব্ল্যাক লাঙ্গুর’ বা সংক্ষেপে ‘নীলগিরি লাঙ্গুর’। স্বভাবে লাজুক, খুব সকাল বা পড়ন্ত বিকেল ছাড়া ওদের দেখা মেলা ভার। নদীর বুকে যেতে যেতে দুই পাশের জঙ্গলে বাইসন, সম্বর, বুনো শুয়োর, লালমুখো বাঁদর চোখে পড়লেও, একটাও কালো বাঁদরের দেখা পেলাম না। যখন অরণ্যনিবাসে পৌঁছে আশপাশটা ঘুরছি, দেখলাম, এ ডালে ও ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে কালো একটা জন্তু। প্রথমে ‘হুলক গিবন’ বলে ভুল করেছিলাম। বন দফতরের এক অফিসার ভুলটা ভাঙিয়ে দিলেন, ‘‘ওটা এক ধরনের বাঁদর। পৃথিবীতে আর কোথাও পাওয়া যায় না এই ব্ল্যাক লাঙ্গুর।’’